গল্প - কামাখ্যা কম্পাউন্ডারের কান্ড, লেখক - অর্ঘ্য ঘোষ
গল্প - কামাখ্যা কম্পাউন্ডারের কান্ড
অর্ঘ্য ঘোষ
এলাকার লোকের কাছে কামাখ্যাঠাকুর হিসাবেই তাঁর পরিচিতি বেশি। আসল নাম ছিল কামাখ্যাচরণ চ্যাটার্জী। তিলডাঙা গ্রামে বাড়ি। ঠাকুর পদবি পেলেও পুরুতগিরি তাঁর পেশা নয়। তিনি ছিলেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কম্পাউণ্ডার। তবে কেউ কোনদিন পুরোহিত না পেলে অনুরোধে ইতু, সত্যনারায়ণ, লক্ষ্মীপুজোও করে দিতেন।
তাঁর বেশভুষা , চলনবলন এতই সাধারণ ছিল যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কম্পাউণ্ডার তো দুরের কথা , সাধারণ সরকারি কর্মীও মনে হতো না তাঁকে।একেবারে ভোলেভালে টাইপের চেহারা। পায়ে সব সময় হাওয়াই চটিও থাকত না। হাঁটুর নিচে থেকে মোটা ধুতির উপর থাকত হাফ হাতা গেঞ্জি। ঘাড়ে উপর ঝোলানো থাকত ফতুয়ার মতো জামা। জামা পড়তে তাকে কালেভদ্রে দেখা যেত।
তাঁর জামা না পড়া নিয়ে এলাকায় নানা ঘটনার কথা এখনও প্রচলিত রয়েছে। একবার বন্যার সময় এলাকায় ব্যাপক পেটের রোগ দেখা দিয়েছে। রোগীরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা করাতে হাজির হচ্ছেন। কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একমাত্র টিউবওয়েলটি তখন বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে। বারবার স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আর্কষণ করেও টিউবওয়েল মেরামতের কোন ব্যবস্থা হচ্ছে না। রোগী , তাঁদের পরিজন এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। শেষে তিতিবিরক্ত হয়ে ঘাড়ে জামাটি ফেলে সিউড়ির বাস ধরে সোজা মুখ্যস্বাস্থ্য আধিকারিকের অফিস হাজির হন তিনি।
সেই সময় মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ছিলেন একজন ভদ্রমহিলা। কামাখ্যাঠাকুর জোড় হাত করে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বলেন , ' মা তোমার দ্বারস্থ হলাম। এবার তুমি উদ্ধার করো '।
ভদ্রমহিলা তাঁকে দেখে হকচকিয়ে যান । চাষাভুষো টাইপের লোকটা তাকে মা সম্বোধন করছে , তুমি - তুমি করে কথা বলেছে কেন ? ভেবে কোন কুল কিনারা পান না তিনি। তাই কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলেন , ' কে আপনি , কি চান ? '
জবাবে কামাখ্যা ঠাকুর বলেন , ' মা আমি তোমারই অধস্তন। ঢেকা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কম্পাউণ্ডার '।
পরিচয় জানার পর মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের বিস্ময় আর ধরে না । সেটা চেপে রেখে তিনি বলেন, ' তা অফিসে গেঞ্জি পড়ে চলে এসেছেন কেন ? '
কামাখ্যাঠাকুর ঘাড়ে হাত দিয়ে দেখেন তখনও ঘাড়ের উপরেই পড়ে রয়েছে জামাটা। সঙ্গে সঙ্গে জিভ কেটে বলেন , ' বড় ভুল হয়ে গিয়েছে মা।কেমন ভাবে তোমাকে সমস্যার কথাটা বলব , সেই কথা ভাবতে ভাবতেই জামা পড়ার কথা ভুলে গিয়েছি '।
তারপর বাইরে গিয়ে জামা পড়ে এসে সমস্যার কথা বলেন তাঁকে। বলাবাহুল্য পরদিনই টিউবওয়েল মেরামত হয়ে যায়। আর মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে থেকে সেদিনের ওই ঘটনার কথা ডাক্তার , স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে এসে পৌঁছোয় এলাকায়। সব থেকে মজার ঘটনাটি ঘটেছিল বেলেড়া গ্রামে। একটি বাচ্চা ছেলে জ্বরে কাহিল হয়ে পড়েছিল বিছানায়। বাড়ির লোকেরা খবর পাঠিয়েছিলেন কামাখ্যা ঠাকুরের কাছে। বিকালের দিকে যথারীতি ঘাড়ে জামাটি ফেলে ছেলেটির বাড়ি পৌঁছোন তিনি। জামার পকেটেই থাকত তার ইঞ্জেকশান দেওয়ার সিরিঞ্চ সহ টুকিটাকি ওষুধপত্র। ছেলেটিকে দেখার পর গৃহকর্ত্রীকে বলেন , 'ইঞ্জেকশান দিতে হবে। একটু গরম জল করে দাও তো মা '। যথাসময়ে গরম জল আসে। পকেট থেকে সিরিঞ্জ , ওষুধপত্র বের করার জন্য ঘাড় থেকে জামাটা নামিয়ে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। জামা কোথায় ? এ তো তাঁর স্ত্রীর সায়া। পাশাপাশিই ছিল , আনমনে সেটাকেই ঘাড়ে ফেলে চলে এসেছেন। আবার সায়া নিয়ে লোক ছোটে তাঁর বাড়ি। জামা এসে পৌঁছোয়।কিন্তু ততক্ষণে জল ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। সেদিন ওই বাড়ির বধূটিকে আরও একবার জল গরম করতে হয়েছিল।
আলাভোলা গোছের হলেও আজকের ' আসি যাই , মাইনে পাই ' কর্মসংস্কৃতির বাজারে কিন্তু দৃষ্টান্ত হতে পারেন তিনি।সেই সময় আজকের মতো আলো , পাখা , ট্যাপ ঘুরিয়ে জলের সংস্থান ছিল না স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। তাঁর বাড়িও ছিল কাছে। কিন্তু রোগীদের কথা ভেবে তিনি সস্ত্রীক পড়ে থাকতেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কোয়ার্টারে। দিনের পর দিন ডাক্তারহীন স্বাস্থ্যকেন্দ্র সামলেছেন। আবার শয্যাশায়ী রোগীকে দেখতে ছুটেছেন বাড়িতে। কারও কাছে পয়সা টাকা নেননি। জমির বেগুনটা-মুলোটা , যে যা হাতে তুলে দিয়েছেন তাই নিয়েছেন। আমাকেও অনেকবার বাড়িতে এসে দেখে গিয়েছেন। বাবা তাঁকে কাকা বলতেন। আমরা বলতাম দাদু। যাওয়ার সময় মা হয়তো গাছের চারটে পেঁপে দিয়েছেন। তখন উনি কুণ্ঠার সঙ্গে বলেছেন , প্রভাত ( আমার বাবার নাম ) চারটে কাঁচা কলা দিবি নে ? মাগুর মাছ জিয়ানো আছে। তোর কাকীর জ্বর। মুখে স্বাদ নেই। কিছু মুখে দিতে পারছে না। গোলমরিচের ঝাল দিয়ে ঝোল করে দিতাম '। বলাবাহুল্য বাবা চারটের জায়গায় এক ডজন কলা পাড়িয়ে দেন। আজ মনে মনে ভাবি সে কালের মানুষজনের চাহিদা কত অল্প ছিল।
আজ কামাখ্যাঠাকুর নেই। ডাক্তারহীন ঢেকা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কোয়ার্টারে আর কেউ থাকেন না । গবাদি পশুর খোঁয়াড়ে পরিণত হয়েছে গোটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বর। কোয়ার্টারগুলিও সাপখোপের বাসা হয়ে উঠেছে। কিন্তু যে কোয়ার্টারে তিনি বাস করতেন সেটিকে এখনও এলাকার বাসিন্দারা কামাখ্যা ঠাকুরের কোয়ার্টারই বলে থাকেন।
--------o-----------
লেখক পরিচিতি:
পেশায় সাংবাদিক। নেশা রয়েছে লেখালিখিরও।পোশাকি নাম ইন্দ্রনীল ঘোষ। কিন্তু অর্ঘ্য ঘোষ নামেই চেনেন সবাই। বীরভূমের ময়ূরেশ্বরের লোকপাড়া গ্রামে বাড়ি। স্কুলজীবন থেকেই লেখালিখির নেশা। স্কুল জীবনেই ছাপা হয় নাটকের বই 'এইতো সমাজ' এবং কবিতা সংকলন ' বিরহী'। পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয়েছে ১৫ টি উপন্যাস এবং ৫ টি গল্পগ্রন্থ। বর্তমানে একটি সর্বভারতীয় দৈনিক সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। সেই সুবাদে জীবনকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ ঘটেছে। উপলব্ধি করেছেন মানুষের জীবন যন্ত্রণা। সেইসব জীবন যন্ত্রণাকে লেখার উপজীব্য বিষয় করেছেন। কিন্তু রচনায় কোথাও সাহিত্যের উপরে সংবাদের ছায়া পড়েনি। বরং অনাস্বাদিত মেলবন্ধনের স্বাদ মেলে লেখায়। মনে হয় যেন প্রতিটি চরিত্রই বাস্তবের উঠোনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
No comments