গল্প - ভারসাম্য, লেখক - এস এম নিজামুদ্দিন



ভারসাম্য
এস এম নিজামুদ্দিন (মুর্শিদাবাদ)

অশ্বত্থ গাছতলায় ঘাটের সিঁড়িতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। স্পিডবোটে ভিড় দেখে সাহস করে আর উঠতে পারেননি। ফেরি নৌকায় রিজার্ভ করে খুব

সহজে চলে যাবেন ভেবে ছিলেন, কিন্তু এখানেও একই অবস্থা।

আট বছর রিটায়ার্ড জীবনে এই প্রথম এখানে এসেছেন।

আসার ইচ্ছা ছিল না। কলেজের দীর্ঘ অধ্যাপনার টান বড় গভীর। তাঁর সময়ের ছাত্রছাত্রীরা না থাকলেও কলিগদের মধ্যে এখন অনেকেই আছেন। আবার নতুনও কেউ কেউ এসেছেন। আলাপ হবে। অনুষ্ঠানে যোগদান করতে ওরাই বিশেষ কার্ড পাঠিয়েছেন।

কলেজে আজ সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান। বিশেষ এই অনুষ্ঠানে তাঁকে সম্মানিত করা হবে।

বারবার ঘড়ির দিকে দেখছেন। প্রায় দশটা বাজতে চলল। এগারোটায় শুরু হবার কথা। একটু বিশ্রামের দরকার। বাসের ধকল গেছে খুব। আনন্দে উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠছেন।

এমন সময় একটা খালি নৌকা আসতে দেখলেন। সাবধানী দৃষ্টি দিয়ে নেমে গেলেন কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে। নৌকায় চেপে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে বললেন মাঝিকে।

নৌকা কিছুদূর এগিয়ে যেতে কয়েকটা ছেলে দুদ্দাড় করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে চেঁচামেচি শুরু করে দিল। ধস্কে বলল, লাটসাহেবের নাতি। দেখছে নৌকা নেই, রিজার্ভ করে একা একা পালাবে!

ছেলে-ছোকরাদের কথার খোঁচা ভালো লাগল না তাঁর। একবার মাঝির দিকে তাকালেন। কিছু বলতে পারলেন না। কারণ মাঝির দৃষ্টিটাও বড় করুণ। স্কুল কলেজের ছেলেদের একটু খাতির করে চলতে হয়। ওদের হাড়ে হাড়ে চেনে মাঝিরা। তাঁকে জিজ্ঞেস না করে মাঝি নৌকা ভিড়িয়ে দিল।

চারটে সাইকেল নিয়ে ছজন হুড়মুড় করে উঠে পড়ল। ওদের বিশৃঙ্খলভাবে উঠতে নৌকা একদিকে কাত হয়ে গেল। তিনি কোনরকম ভাবে টাল সামলে নিলেন। ভাগ্যিস পেছনে সরে গিয়ে নৌকার হালটা দ্রুত ধরে ফেলেছিলেন। খুব বিরক্ত হলেন ছেলেদের উপর। তবু নিজেকে সামলে গলা নরম করে বললেন, একটু ধীরেসুস্থে চাপো না বাবা।

একজন মেজাজ চড়িয়ে জবাব দিল, আমরা ঠিকই চাপছি। দেখছেন নৌকা নেই। আপনি কী রকম ভদ্রলোক, একা একা রিজার্ভ করে পালাচ্ছিলেন? বুড়ো হয়ে গেলেন আক্কেল হল না? একটু থতমত খেলেন তিনি। অবাক হয়ে দেখলেন ছেলেদের ঔদ্ধত্য। দু'জনের পরনে স্কুল-ইউনিফর্ম, বাকি চারজন সিনিয়র মনে হল। সম্ভবত কলেজের ছাত্র। মনটা খারাপ হলেও একটু সহানুভূতি জেগে উঠল।

এরা ছেলেমানুষ, চঞ্চল স্বভাবের হতেই পারে। এই কলেজের এক সময়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপককে এরা চেনে না। আগের সময়ের ছাত্রদের কাছ থেকে খুব সম্মান পেতেন। নদীর এপারটায় তখন বাসা ছিল। কলেজ চলাকালীন দিনে দু'বার যাতায়াত করতে হত। ফিরবার সময় চার-পাঁচ জন ছাত্র মিলে নৌকা রিজার্ভ করে নিত। পয়সা দিতে চাইলে নিত না।

নৌকা ছেড়ে দিতে বাঁদিকটায় আরও একটু কাত হয়ে গেল। ভিতরে জল ঢুকে পড়ার অবস্থা। তিনি একটু নার্ভাস হলেন। ধুতির কোঁচা সামলাতে সামলাতে চেঁচিয়ে বললেন, এই এই, ডানদিকে একটু চেপে যাও...

তাঁর এই অবস্থায় ওরা হো হো করে হেসে উঠল। মজা পেয়ে একজন বলল,

কী হল দাদু, ভয় লাগছে না কি?

তিনি করুণদৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে বললেন, "ডান দিকে একটু চেপে যাও না বাবা, ভারসাম্যটা ঠিক থাকে।" সাইকেল ধরে মোটাসোটা ছেলেটা গমগম শব্দ তুলে বলল, "বুড়োটা আবার বলে কিরে..."

পাশের আর একজন ফোঁড়ন কাটল, কী দাদু, কোন কলেজে পড়েছেন?

অন্যজন বলল, কলেজ বলিস কিরে, ডক্টরেট কোথায় করেছেন তাই বল?

যত্তোসব...

ওদের কথা শুনে হতাশ হয়ে চুপ থেকে গেলেন। তরুণ অশ্বথের গাছটা ক'বছরের মধ্যে পত্র-পল্লবে মহীরুহের আকার নিয়ে ফেলেছে। স্পিডবোটের দু'বার যাতায়াত হয়ে গেল। বড় সাধ ছিল, নৌকার উপর থেকে যাত্রী বোঝাই বোট দেখবেন। উপভোগ করবেন তার গতির ছন্দটা। তাঁর সময় স্পিডবোট ছিল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। ছেলে ক'টার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। লজ্জা ও ক্ষোভে ভীষণ কাতর হয়ে উঠলেন। দেশের শিক্ষার কি এই হাল? বয়স্কদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় তাও জানে না এরা। তাঁর সময়ে এই অবস্থা ছিল না। আজ কেন এমন হল? দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য কখনও গড়ে উঠেনি। রাজনৈতিক ভারসাম্য যেটুকু ছিল, স্বার্থান্বেষী, ক্ষমতালোভী নেতারা সেটাও হারিয়ে ফেলল। শিক্ষার জগতেও কি ভারসাম্যহীনতার এমন কঠিন ব্যাধি?

ছেলেদের মধ্যে একজন মাঝিকে ধমকাল, জোরে হাত চালাও মাঝি, আমাদের তাড়াতাড়ি পৌছাতে হবে।

অন্যজন বলল, কলেজের একজন প্রাক্তন প্রফেসার আসছেন। খুব নামকরা, তাই না?

শুধু নামকরা বলিস কেন, রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত। তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে হবে আজ। আটোগ্রাফও নেওয়া চাই।

মাঝ নদীতে এসে ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকাটা পালের হাওয়া পেয়ে তিরতির গতিতে ছুটছে। এরমধ্যে একজন ফোঁড়ন কাটল, কি দাদু, এবার ব্যালেন্সটা ঠিক আছে তো?

তাঁর ওদিকে আর কান নেই। চশমার লেন্স ভেদ করে দৃষ্টিটা সোজা চলে গেছে কলেজ বিল্ডিং-এর দিকে। আগের মত স্পষ্ট বোঝা যায় না আর। তাঁর মনে সংশয় জেগে উঠল। যে কলেজকে চেনা যায় না, বোঝা যায় না, সেখানে আর যাওয়া যাবে কি না সে ভাবনায় অস্থির হয়ে উঠলেন।

এমন সময় হই চই-এর শব্দ কানে এল। মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন। ঘাটের দিকে এবার স্পষ্ট দেখতে পেলেন, অনেক ছাত্রছাত্রী ঘাটের ওপর দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকের পরনে কলেজ ইউনিফর্ম। দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। মনটাও ভরে উঠল প্রশান্তিতে। নৌকা ভিড়বার আগে দেখতে পেলেন ইরফান সাহেবকে। একেবারে জলের ধারে এসে গেছেন। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। এক সময়ের সহকর্মী। সঙ্গে আছেন আরও দুজন তরুণ লেকচারার। এই তিনজনেই গিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে। এখানে আসার প্রতিশ্রুতি আদায় করে তবেই ছেড়েছিলেন। তাঁদের হাসিখুশি উজ্জ্বল চেহারা দেখে মনটা ভরে গেল তাঁর।

নৌকা থেকে নামতে ইরফান সাহেব হাতটা দ্রুত ধরে ফেললেন। ঘাটের অসমতল উঁচু পাড় দিয়ে উঠতে উঠতে দেখলেন, উপরে দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রীদের সম্মুখভাগে আরও ক'জন অধ্যাপক। মাঝখানে ফুলের মালা নিয়ে সহাস্যে দাঁড়িয়ে সম্ভবত প্রিন্সিপ্যাল। বছর চারেক হল এসেছেন। আলাপ হবে।

প্রিন্সিপ্যাল কয়েক পা এগিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়ালেন। শুধু দৃষ্টি বিনিময়। তারপর ফুলের মালা পরিয়ে দিলেন তাঁর গলায়। স্রোতের মতো করতালিতে ভেসে গেল নদীর এ কূল।


সুসজ্জিত মারুতিতে উঠতে উঠতে শিশিরবাবু দেখলেন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমজনতার উচ্ছ্বাস। কেবল দেখতে পেলেন না ক'জন নৌকার আরোহী-ছাত্রদের। নৌকা থেকে কখন নেমে পড়েছিল ওরা তাও খেয়াল করেননি। তাঁর চোখ দিয়ে কয়েকফোঁটা জল বেরিয়ে ঝাপসা করে দিল সব অনুভূতি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url