গল্প - একটি উপাসনাগাহের আত্মকথা, লেখক - আবদুল মালেক
একটি উপাসনাগাহের আত্মকথা
আবদুল মালেক
আকাশে ঘন কালো মেঘের ঘনঘটা। আকাশে মেঘের ছানারা উড়ে চলেছে মনের খেয়ালে দিক থেকে দিগন্তে। আধখানা চাঁদের আলো লাজবতী বধূর মুখের হাসির মতো এক মুহুর্তে ঝলক দিয়ে লুকোচ্ছে মেঘের আড়ালে। বর্ষার ভেজা ভেজা গন্ধে ভরে আছে চারিদিক। পরিবেশটা একেবারে মায়াবী। ভাব রসে গম্ভীর। কি যেন একটা অবর্ণনীয় আনন্দের ছবি ভেসে উঠছে মনের দর্পণে। কবিতার সান্ধ্য ভাষার মতো প্রকাশিত হয়েও অপ্রকাশিত। যেন মন আর মগজের লুকোচুরি খেলা চলছে।
তো থেকে থেকে আমারও মনটা যেন কেমন একটা আনন্দ ও বেদনার ভাব অন্তরে বাইরে ফুটে উঠছে। প্রকৃতির বুকে এখন সবাই গাঢ় নিদ্রায় নিদৃত। শুধু আমিই প্রতিদিনের মতো আজও বিরহী যক্ষের মত জেগে আছি। দিন রাত শত আনন্দ বেদনা হাসি কান্নার একটা সকরুণ সুর আমার ইট কাঠ পাথরের দেয়ালে ধাক্কা মারে আর আমার ভেতরটা টনটনিয়ে ওঠে। আমার মত আর তো কেউ এই সব মানুষগুলোর খবর রাখেনা। নিত্যদিনের হাসি কান্না ভালবাসাবাসী প্রতিমুহূর্তের বেড় ওঠা আর আর সব কাজই আমার মনের খাতায় লেখা হয়ে আছে। এমনকি আমার আশেপাশে আম জাম কাঁঠাল বাঁশ ঝাড়ের ভেতর এসে পাখিরা যে গান শুনিয়ে যায় সেটা তোমাদের কাছে নিছক গান মনে হলেও আমার কাছে তার অন্য একটা মানে আছে। আমিও তো হরদম পরম প্রভুর স্তুতি গানে মেতে আছি। যখন আমার পরম প্রভুর চোখের ইশারায় মৃদুমন্দ বাতাস বয় দুলে ওঠে আম জাম বাঁশের গাছের মাথা। গায়ে এসে লাগে মৃদু শিহরণ।
তুমি হয়তো ভাবছো এত রাতে এইসব সাত পাঁচ কথা কেন। এখন পূর্ণ বিশ্রামের সময়। কেউ কোথাও নেই। শুধুমাত্র ঝিঁঝিঁ পোকা আর পাশের ডোবাটায় কয়েকটা ব্যাঙ একটানা ডেকেই চলেছে। কোথায় ঘুম ভেঙ্গে চমকে ওঠা একটা কুকুর একবার মাত্র ডেকেই আবার চুপ হল।
আজ আমার থেকে থেকে কত কথাই না মনে পড়ছে। সেই সব হাসি কান্না আনন্দ-বেদনার কথা তোমাকে শোনাবো ভাবছি। তাতে তোমার কোন কিছু লাভ না হলেও আমার একটা বিরাট লাভ আছে। সে কথা আমি ভেবে দেখেছি। আমি কত শত বছরের কত স্মৃতি গাঁথা আমি একা ভার বাহি জীবের মতো বইতে বইতে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছি। আর যেন কিছুতেই বইতে পারছি না। তাই তোমার একটুখানি বিশেষ অসুবিধা হলেও আমার কথা এখানে দু'দণ্ড বসে তোমাকে শুনতে হবে। কোনমতেই আমার কথা অসম্পূর্ণ রেখে উঠে যেতে পারবে না তা আগেভাগে বলে রাখছি।
দেখছো, ওই যে দূরে তালগাছটা কেমন সব গাছ ছাড়িয়ে আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় যেন কত তার অহংকার। গর্বে মাটিতে পা পড়ে না। তার পাতায় পাতায় বাবুই পাখিরা বাসা বনে। ঝড় বৃষ্টি হলে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকে। হাসে। গায়। খুনসুটি করে। ওদের আর তার মাঝে একটা বলবার মতো সম্পর্ক আছে। তবু মনে হয় যেন নেই। সে যেন নিঃসঙ্গ। একা।
তেমনি আমিও একা। নিদারুণ একাকীত্বে ভুগি। যদিও প্রতিদিন আমার কাছে আসে বিশ্বাসী মানুষেরা। শত কর্মব্যস্ততার মাঝেও রাত দুপুরে ছুটে আসে তাপিত শীতল হৃদয় করতে
কত কথাই না আজ আমার মনে পড়ছে। একটার পর একটা যেন উঁকি মারে মনের দর্পণে।
সে আজ অনেকদিন আগের কথা। তবু মনে হয় এইতো সেদিন, আজ যেখানে তুমি বসে আছো। সেখানে একদিন তোমার পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ শ্রান্ত অবসন্ন ক্লান্ত হয়ে এসে বসত আমার কাছে। এখানে বসেই ওরা নতুন করে প্রাণ ফিরে পেতো। আমার প্রতিটি জায়গায় সেই সব সরল প্রাণ মানুষগুলোর পায়ের ধুলো লেগে আছে। আমার প্রতিটি ইট কাঠ পাথরের ওদের সহৃদয় স্পর্শ লেগে আছে। লেগে আছে ঘাম। কত রক্ত।
আজকে আমায় যে অবস্থায় দেখছো, এইসব তো সেদিনের কথা। তখন আমার আজকের মত সবল শরীর ছিল না। দৈর্ঘ্যের প্রস্থে এতটা বড় হইনি। চারিদিকে বাঁশ চাটাইয়ের বেড়া। আর মাথার উপর খেজুর পাতার ছাউনি।
আমার যেদিন প্রথম জন্ম হয়, সেদিনের কথা বেশ ভালোভাবেই মনে আছে। আমার জন্মদাতা সেই সব মানুষগুলোর দু চারজনকে বেশ স্পষ্টই মনে আছে। আজকে দেখছো আমার পাশে কত লোক। সেদিন এসবের কিছুই ছিল না। চারিদিকে ঘন জঙ্গল। তারই মাঝে দু চার জন ভাগ্য অন্বেষণে এসে ইতিউতি আস্তানা গেড়েছে।
তখন আমার জন্মই হয়নি। হব হব করেও হচ্ছে না। আর্থিক সংকট ই প্রধান বাধা।
এই যখন অবস্থা, আমার ব্যাপারটা বুঝতেই পারছো। মায়ের পেটে রক্তে মাংসে বেড়ে ওঠা শিশু সন্তানের মত। আমার বিহনে মানুষগুলো কম যন্ত্রণা ভোগ করে না ভেতরে ভেতরে।
পথের মাঝেই একদিন কথায় কথায় বলেই ফেললেন ব্যাপারটা তোমাদের পূর্বপুরুষের একজন আরেকজনকে।। ভাবতে লাগলেন। তারপর বললেন_দৈনিক পাঁচবার নামাজের জন্য একটা ঘর খুবই দরকার। কিন্তু অর্থ কোথায়? অপরজন বললেন_কথাটা ঠিক। কিন্তু আমরা আমাদের মত করে শুরু করব বলেই ইসলামের ইতিহাসের স্বর্ণোজ্জ্বল ঘটনাটি স্মরণ করিয়ে দিলেন। মদিনায় হিজরতের পর প্রথম যে মসজিদ তৈরি হয়েছিল সেই মসজিদের ইতিহাস আমরা জানি।
তারপর কত বৃষ্টিতে ভিজেছি ।রোদে পুড়েছি ।ঝড়ে কতবার মাথার ছাদ উড়েছে তার লেখা জোকা নেই।
আমি পাষাণ দেখতে না পেলেও অনুভব করতে পারি। সারাদিন কান পেতে থাকি। কে কখন আসে যায় পায়ের শব্দে চিনতে পারি। কত মানুষের কান্না দীর্ঘশ্বাস নিশ্চুপ হয়ে ভাবলেই শুনতে পাই। সেই লোকটিকে আমার বেশ মনে পড়ছে, যে জমির শোকে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে গেছিল। তুমি হয়তো ভাবছো জমির শোকে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে গেল। কি এমন হয়েছিল যে জমির জন্য শোক করতে হবে।
ওই যে দূরে তোমাদের পাশে যেটা নদী যার একটা সরকারি ভাষায় পোশাকি নাম আছে যার জন্ম হয়েছিল কলকাতা বন্দরকে চিরযৌবনবতী করে রাখার জন্য। যার জন্য হাজার হাজার ফসলি জমি জলের তলায় চলে গেছে। ওদের বেশিরভাগই ক্ষতিপূরণ পেলেও, অনেকেই পায়নি। অন্ধ লোকটি ওদেরই একজন।
আজকে তো তোমাদের মধ্যে কেউ কারো সাথে বনিবনা নেই। একেক জন মানুষ এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বাস করছে। আজকের নোংরা রাজনীতি এসবের মূলে। নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ পূরণের জন্যই মানুষকে আজ ওরা রাজনীতির নামে ভাগ করেছে। সেই জন্যই মাঝেমধ্যে এলাকাটা হয়ে উঠছে যুদ্ধক্ষেত্র। বোমা বারুদের গন্ধে ভরে উঠছে বাতাস। চারিদিকে স্বজন হারানোর কান্না। হাহাকার। কান পাতলেই একটা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাই। কত মায়ের যে বুক খালি হয়ে গেছে তার হিসাব নেই। কত নারীর য স্বাদ স্বপ্ন আহ্লাদ অকালে মাটিতে মিশে গেছে তারও ঠিক ঠিকানা নেই। যারা সময় ও অসময়ে আমার পথের পাশ দিয়ে হাটবাজারে যেত, মোড়ের মাথায় চায়ের দোকানে বৈকালিক চায়ের আড্ডায় সময় কাটাতো, আজ ওরা অনেকেই নেই। ছিল রক্তে মাংসের মানুষ, মুহূর্তে হয়ে গেল ছবি।
সেইসব হতভাগ্য মানুষ গুলোর সঠিক হিসাব তোমার কাছে নেই কিন্তু আমার কাছে তার সব হিসেব আছে। নোংরা রাজনীতির নামে যেসব হয়ে গেছে সেসব ভাবলে আমার মাথাটা হেঁট হয়ে যায়।
আমার অদূরে কিছু অমুসলমানের বাস। ওদের দেখে আমি ভীষণ লজ্জা পাই। ওরা ইসলামের অনুসারী না হয়েও ইসলামের মূল সুর টা ওদের মাঝেই বাজে।
ভোটের রক্তাক্ত নাটকটা মাঝেমধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তাতে বাদ যায়না তোমাদের পাড়াসহ তেলিপাড়াটাও। ভোটের সময় এই পাড়াটা যেন বারুদের স্তুপ। সবাই যেন তপ্ত তাওয়ার উপর বসে আছে। একটু মাত্র অগ্নি ইস্ফুলিঙ্গের সংযোগেই হয়ে উঠবে আগুনের পাহাড়। অপরদিকে তেলিপাড়া টা যেন একটা আস্ত বরফের পাহাড়। যেন সবাই হিম শীতল। সবাই শীতঘুমে আছে। কোন তাপ উত্তাপ নেই
আমার আরো একটা করুন ঘটনা বেশ মনে পড়ছে। তখন আমার গায়ে-গতরে অসংখ্য ফাঁক ফোকর। তাতে চড়ুই পাখির বাসা। ওরা সময় অসময়ে উড়ে বেড়াতো। কিচিরমিচির করতো মনের আনন্দে। আমার খুব ভালো লাগতো।
তো সেবার গায়ে প্রথম বিদ্যুৎ এলো। সে এক মজার ব্যাপার। এতে সবার মনটা প্রজাপতির মত ফুরফুর করে উড়ছে আনন্দে। আমার মনটাও খুশিতে থেকে থেকে নিচে উঠছে। আমার ভেতরটা আলো ঝলমলে হয়ে উঠলো। পাখা ঘুরলো বনবন করে। অনাভ্যাসবশত চড়ুইগুলো প্রায় কাটা পড়তো উড়তে গিয়ে। এতে আমার মনটা টনটন করে উঠত ব্যথায়।
আর একদিন শুক্রবার কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই। বক্তব্য দিচ্ছিল তোমাদেরই একজন লোক। যে বর্তমানে কর্মসূত্রে দূরে থাকে। তিনি আমার কথা বললেন_বেশ কিছুদিন থেকে আমি অসুস্থ। মাথার উপর একটা ছাদ খুব দরকার। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। বেশ কিছু মানুষ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। যারা আছে তাদের মধ্যেও অলসতার ভাব এসেছিল। আজ সেটা ইমাম সাহেবের কথায় কেটেছে। কিছু নওজোয়ান সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে। দলীয় কোন্দলে হতচিত্ত মানুষ গুলো আবার নব উদ্দীপনায় পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যা আমাকে দেখে খুবই ভালো লাগছে।
অনেকদিন পর সব ভূলে হাতে হাত কাঁধে কাঁধে রেখে মিলেছে সে যেন নামাজের কাতারে স্রষ্টা সমীপে। ভয় কি আর! মাথার উপর ছাদটা এবার হবেই।