গল্প - অনাগত সন্তানের পদধ্বনি, লেখক - অর্ঘ্য ঘোষ (বীরভূম)
অনাগত সন্তানের পদধ্বনি
অর্ঘ্য ঘোষ (বীরভূম)
গতকাল লেটনাইট পার্টি থেকে ফিরতে অন্যান্যদিনের চেয়ে একটু বেশিই লেট হয়ে গিয়েছিল। হবে নাই বা কেন ? দেবজ্যোতি এবং নীপবীথির পঞ্চম বিবাহবার্ষিকী বলে কথা। সরকারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মতোই পানাহারের এলাহি আয়োজন করেছিল দেবজ্যোতি। তাই তনিষ্ঠা বার কয়েক চোখের ইশারা করলেও উঠি উঠি করে আর ওঠা হয়নি। আসলে আয়োজন এলাহি হলেও পার্টি ছিল একেবারে অন্তরঙ্গ। দেবজ্যোতির কিছু সহকর্মী বন্ধুবান্ধব আর নীপবীথির কিছু ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। দেবজ্যোতি ওরফে দেবু আমার সহপাঠী তথা সহকর্মী। গ্রামের প্রাইমারী স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দুজনে পড়েছি একসঙ্গে। দু'জনে পড়াইও একই কলেজে। কর্মসূত্রে গ্রাম ছেড়ে এসে একই শহরের দু'প্রান্ত বাড়ি করে স্থিতুও হয়েছি ৷ ছুটিছাটায় একসঙ্গে বাড়ি যাই। দিন কয়েক হই - হুল্লোড় করে কাটিয়ে আসি। এখানেও জন্মদিন , বিবাহবার্ষিকী সহ কোন উপলক্ষ পেলেই হল। হই-হুল্লোড়ে মেতে উঠি। সেই সুবাদে এখন অনেকে পারিবারিক বন্ধুও হয়ে উঠেছে। সেইজন্য মাঝপথে পার্টি ছেড়ে আসতে পারিনি।বাড়ি ফিরতে রাত গড়িয়ে গিয়েছিল অনেক। দু'জনের শরীর আর বইছিল না। গাড়িটা গ্যারেজ করে দিয়ে কোনরকমে ফ্রেস হয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছিলাম। সকালে বিছানা ছেড়ে উঠতেও একটু দেরিই হয়ে যায়। তাও কিছুতেই লেটনাইট পার্টির হ্যাংওভার কাটতে চায়ছিল না।
শৌচাগারের পাট সেরে হাই তুলতে তুলতে ড্রয়িং রুমের সোফায় গা এলিয়ে দিতেই লেবু - নুনের সরবতের গ্লাস হাতে ঘরে আসে তনিষ্ঠা। ইতিমধ্যে স্নানান্তে প্রসাধন সেরে নিয়েছে সে। বিয়ের তিনবছর পরেও অনাঘ্রাত কুমারী মতো কমনীয় দেখাচ্ছে তাকে। শরীর থেকে সুন্দর একটা গন্ধ বের হচ্ছে। তনিষ্ঠা একসময় কলেজের সহপাঠিনী ছিল। ফার্স্ট ইয়ারেই দু'জনে প্রেমে মজেছিলাম। হাবুডুবু খেতে খেতেই আমি ভর্তি হয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলেজের পাঠ চুকিয়ে তনিষ্ঠা বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু প্রেমের ডোর ছেঁড়েনি। কলেজের চাকরিটা পাওয়ার পর উভয় পরিবারের সম্মতিতে ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিল ৷ সেই প্রেম এখনও টসকায় নি। বরং একে অন্যকে চোখ হারাই।
সরবতের গ্লাসটা হাতে নিয়ে প্রেমঘন দৃষ্টিতে তার মুখের চেয়ে থাকি। তখনই শোকেশের উপরে চোখ আটকে যায়। সেখানে শোভা পাচ্ছে একটা লাফিং বুদ্ধ। সেটা দেখে আমার ভ্রু কু'চকে যায়। কাল যখন পার্টিতে গিয়েছিলাম তখনও তো কই চোখে পড়েনি। দিন সাতেকের মধ্যে তনিষ্ঠাও বাজারে যায়নি। তাহলে ওটা এল কোথা থেকে ? প্রশ্নটা করতেই তনিষ্ঠা জবাব এড়িয়ে গিয়ে বলে , " ভালো নয় মূর্তিটা ? এখন থেকে সকালে উঠে চোখ খুলে আগে মুর্তিটা দেখবে। তাহলে আপদবিপদ সব কেটে যাবে। সংসারে শ্রীবৃদ্ধি হবে। "
বাস্তুতন্ত্র তথা লাফিং বুদ্ধের কার্যকারিতা নিয়ে আমার বিশ্বাস - অবিশ্বাস কিছুই নেই। কিন্তু তনিষ্ঠার বিশ্বাসে আঘাত করতেও চাই না। তাই ফের জিজ্ঞাসা করি , " কিন্তু ওটা পেলে কোথায় ? "
তনিষ্ঠা একটু ইতস্তত করে বলে , " সে যেখানেই পাই। কেমন লাগছে বললে না তো ?"
তার ভাবভঙ্গি দেখে আমার কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগে। মনে হয় কিছু একটা গোপন করতে চাইছে সে। কি সেটা ? মনে মনে পর্যালোচনা করতে থাকি। আচমকা আমার মাথায় যেন বিদ্যুৎ চিড়িক দিয়ে ওঠে। চোখের সামনে দেবজ্যোতিদের ড্রয়িংরুমটা ভেসে ওঠে। আরে ওই মুর্তিটাই তো কাল ওদের ড্রয়িংরুমে শোকেসের উপরে শোভা পেতে দেখেছি। তাহলে কি নীপবীথির কাছে চেয়ে এসেছে তনিষ্ঠা ? প্রশ্নটা করতেই তনিষ্ঠা শুকনো গলায় বলে , " চাইলে কি কেউ নিজের বাড়ির লাফিং বুদ্ধ দেয় ? "
" তাহলে ? "
" তোমরা সবাই যখন পার্টিতে ব্যস্ত ছিল তখন টুক করে ব্যাগে ভরে নিয়েছিলাম। কেউ টেরটিও পায়নি। "
নির্বিকার চিত্তে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে তনিষ্ঠা। তার ভাব দেখে মনে হয় যেন বিরাট একটা পারদর্শিতার কাজ করে ফেলেছে।
কথাটা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। রাগে মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। ধাতস্থ হওয়ার পর উগড়ে দিই একরাশ ঘৃণা , " ছিঃ ছিঃ এটা কি করলে তুমি ? কিসের অভাব আমাদের ? তুমি বললে আমি ঘরে ঘরে ওইরকম চারটে করে লাফিং বুদ্ধ এনে বসিয়ে দিতাম। কাজটা করার আগে নিজেদের মানসম্মানের কথাটা একবারও ভাবলে না ? কারও চোখে পড়ে গেলে আর মুখ দেখাতে পারতে ? এখন ওটা নিয়ে কি করবে ? হুটহাট করে ওরাও তো আমাদের বাড়িতে আসে। যদি ওদের চোখে পড়ে ? কি বলবে তখন ? "
তনিষ্ঠার তবুও অনুশোচনা হয়না। সে নিজের সপক্ষে যুক্তি খাড়া করে , " আসলেই বা ? কোম্পানী বুঝি ওইরকম একটাই করেছে ? লাফিং বুদ্ধটাতে কি ওদের নাম লেখা আছে ? "
" নাম লেখা না থাক যদি বিশেষ কোন চিহ্ন থাকে ? সেটা দেখে যদি ধরে ফেলে ?"
তনিষ্ঠা তবুও অকুতোভয় , "তাহলে ওটা কাউকে একটা দিয়ে দিলেই হল। "
এইরকম চট করে সস্তা সমাধানের কথা ভেবে ফেলা তনিষ্ঠার বরাবরের অভ্যাস। অন্যসময় আমি মজা পাই। ওর পিছনে লাগি। এখন আমারই রাগ বেড়ে যায় , "শেষে অন্যকে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য তোমাকে চোর হতে হল ? কিন্তু যাকে দেবে সেখানেও যদি দৈবাৎ ওরা পৌঁছে যায় ? ঝামেলা যদি থানা - পুলিশ পর্যন্ত গড়ায় ? "
এবারে তনিষ্ঠা কিছুটা দপকায় , " সামান্য একটা লাফিং বুদ্ধের জন্য ওরা থানা - পুলিশ করবে ? "
" তুমি যদি সামান্য একটা লাফিং বুদ্ধের জন্য চুরি করতে পারো তাহলে ওরাই বা সেটা উদ্ধারের জন্য থানা - পুলিশ করতে পারবে না কেন ? "
" হ্যাঁ - গো তাহলে কি হবে ? পুলিশ কি আমাকে ধরে নিয়ে যাবে ? শুনেছি পুলিশ নাকি লকআপে রেখে খুব নির্যাতন করে ? আমাকেও কি নির্যাতন করবে ? "
" না , নির্যাতন করবে না। চেয়ারে বসিয়ে মাটন বিরিয়ানি খাওয়াবে। কি আর হবে ? যেমন কর্ম করেছ তেমনি ফলভোগ করবে। তোমার জন্য আমাকেও জেলের ভাত খেতে হবে। চাকরিটাও যাবে ৷ "
" দোহাই তোমার , রাগ কোর না। তখন কি যে দুর্মতি হল আমার ! এই কান ধরছি। আর কখনও এমন কাজ করব না। এবারটি ক্ষমা করে দাও লক্ষ্মীটি। "
চোখ তুলে দেখে সত্যি সত্যি কান ধরে ছলছল চোখে মুখের দিকে চেয়ে আমার প্রিয় নারী। আমি আর কড়া হতে পারিনা। দূর্বল হয়ে পড়ি। তবুও দুর্বলতা চেপে রেখে বলি , " ওইভাবে সঙের মত দাঁড়িয়ে না থেকে আগে ওটাকে সামনে থেকে সরাও। ওটা দেখলেই নিজেকে চোর মনে হচ্ছে। "
তনিষ্ঠা শশব্যস্ত হয়ে ওঠে , "হ্যাঁ - হ্যাঁ , এক্ষুণি ওটাকে চিলেকোঠার জঞ্জলের মধ্যে রেখে দিয়ে আসছি। "
সেদিনই কলেজ থেকে ফেরার পথে জোড়া লাফিং বুদ্ধ কিনে এনে তুলে দিই তনিষ্ঠার হাতে। তনিষ্ঠা খুশীতে বাচ্চাদের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর সোহাগে অস্থির করে তোলে। সেদিন থেকে আমাদের শোওয়া এবং বসার ঘরে শোকেসের মাথায় শোভা পায় জোড়া লাফিং বুদ্ধ। সেগুলো দেখে আমার মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। চিলেকোঠায় হতযত্নে পড়ে থাকা লাফিং বুদ্ধের কথাটা অবিরাম মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। ইচ্ছা হয় সেটাকে উদ্ধার করে ওদের ফিরিয়ে দিয়ে অপরাধ স্খলন করি। কিন্তু সেটা ফিরিয়ে দিতে গিয়ে তনিষ্ঠাকে খাটো করতেও মন চাইনা। অপরাধবোধ থেকে মুক্তির বিকল্প উপায় ভাবি। পরে কোন অনুষ্ঠানে দেবজ্যোতিদের গিফটের সঙ্গে একটা লাফিং বুদ্ধও উপহার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কথাটা ভাবতে পেরে অপরাধবোধের ভারটা কিছুটা লাঘব হয়ে আসে।
ওই ঘটনার রেশ মেলাতে না মেলাতেই ফের চরম নিন্দনীয় ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে তনিষ্ঠা। সেদিন কলেজ থেকে ফিরে বাইরে দাঁড়িয়েই শুনতে পাই দোরগোড়ায় এক ফেরিওয়ালার সঙ্গে তর্ক জুড়েছে তনিষ্ঠা। গলা শুনেই ফেরিওয়ালাটিকে চিনতে পারি। নাম তার মনসুর আলি। সস্তার জামাকাপড় বিক্রি করে। মূলত বস্তি এলাকার বাসিন্দারাই তার খরিদ্দার। অভিজাত পরিবারে সে খুব একটা আসে না। তাই তার উপস্থিতিতে একটু অবাকই হই। দরজার বাইরে থেকেই দেখতে পাই প্ল্যাস্টিকের উপরে ছড়ানো একরাশ কাপড় ব্লাউজের সামনে বসে বলে সে চলেছে , " মা জননী আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনি বরং ঘরের ভিতরটা আর একবার দেখে আসুন। তাড়াহুড়োয় পড়ে - টড়ে যেতেও তো পারে। "
তনিষ্ঠা তবুও সমানে তর্পে যাচ্ছে। অগত্যা তাদের তর্কাতর্কির মাঝে আমাকে এন্ট্রি নিতে হয় , " কি হয়েছে ?"
আমাকে দেখে মনসুর যেন অকূলে কূল পায় , " দেখুন না বাবুমশাই , আমি মহাজনের কাছে থেকে একডজন ব্লাউজ নিয়ে সোজা এখানে আসি। মা জননী মাপ দেখার জন্য সেগুলি ঘরে নিয়ে যান৷ দুটি ব্লাউজ পচ্ছন্দ করে রেখে আটটি ফেরত দিয়েছেন। হলুদ রঙের একটি ব্লাউজ পাওয়া যাচ্ছে না। "
" হ্যাঁ , পাওয়া যাচ্ছে না ! দেওয়ার সময় তুমি কি আমাকে গুণে দিয়েছিলে ? "
তনিষ্ঠা ঝাঁঝিয়ে ওঠে। মনসুর তবুও বিনয় ছাড়ে না , " তা দিইনি। কিন্তু বিশ্বাস করুন , মহাজনের গদি থেকে একডজন ব্লাউজ নিয়ে সোজা এখানেই এসেছি। পথে কোথাও গাঁটারি নামাই নি। "
" তার মানে কি বলতে চাও আমি চুরি করে নিয়েছি ? মহাজনও তো কম দিতে পারে। "
চুরি কথাটা আমার কানে খট করে লাগে। আমি আর চুপ থাকতে পারি না। মানিব্যাগ থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বলি , "ঠিক আছে , ঠিক আছে। অত তর্কবিতর্কের দরকার নেই। আপনি তিনটি ব্লাউজের দাম কেটে নিন। "
মনসুর দ্রুত জিভ কেটে বলে , " না - না আর টাকা লাগবে না বাবুমশাই। দুটো ব্লাউজের দাম মা জননী তো দিয়েই দিয়েছেন। আমারই কোথাও ভুল হচ্ছে , আমারই কোথাও ভুল হচ্ছে। "
বলতে বলতে কাপড়ের গাঁটারি গুটিয়ে তুলে নিয়ে চলে যায় মনসুর। আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারিনা , "তোমার আলিমারি ভর্তি এত শাড়ি - ব্লাউজ। মাঝেমধ্যেই শপিংমলে যাও। তাও তোমাকে ফেরিওয়ালার কাছে থেকে ব্লাউজ কিনতে হবে ? "
" প্লিজ রাগ কোর না। আসলে ছোটবেলায় মা কাকীমাদের দামাদামি করে ফেরিওয়ালাদের কাছে জিনিস কিনতে দেখেছি। ফেরিওয়ালার কাছে দামদর করে জিনিস কেনার একটা মজা আছে। তাই ফেরিওয়ালার হাঁক শুনে সেই লোভটা আর সম্বরণ করতে পারি নি। "
আমার তবুও সন্দেহ যায়না , "এর মধ্যে অন্য কোন ব্যাপার নেই তো ? "
তনিষ্ঠা তৎক্ষনাৎ জবাব দেয় , "উঃহু। "
সেদিন তনিষ্ঠা অস্বীকার করলেও অন্য ব্যাপারটা কয়েকদিন পরেই ধরা পড়ে যায়। আমি তখন কলেজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। অন্যদিন জামাপ্যান্ট তনিষ্ঠাই সব বিছানার উপরে বের করে রাখে। সেদিন রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল সে। তাই প্যান্টশার্ট বের করার জন্য আমাকেই আলমারি খুলতে হয়। আলমারির পাল্লা খুলতেই আমি ' থ ' যাই। জামাকাপড়ের ভিতর থেকে হলুদ রঙের একটা সস্তার ব্লাউজের অংশ উঁকি দিতে দেখি। এক লহমায় মনসুর ফেরিওয়ালার ব্যাথাতুর মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। রাগের চোটে হ্যাঁচকা টানে বের করে আনি হলুদ ব্লাউজ। সব লণ্ডভণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আমার হাতে তখন শুধু হলুদ ব্লাউজই নয় , তার ভাঁজ থেকে বেরিয়ে আরও দুটি সস্তার ব্লাউজ। ব্লাউজগুলো যে মনসুর ফেরিওয়ালার তা নিয়ে আর কোন সংশয় থাকে না। খাওয়া - কলেজ যাওয়া মাথায় ওঠে আমার। হলুদ ব্লাউজটা হাতে নিয়ে হতবুদ্ধির মত খাটের উপরে বসে থাকি। সেইসময় রান্নাঘরের কাজ সামলে জামাপ্যান্ট বের করে দিতে এসে আমার হাতে হলুদ ব্লাউজ দেখে তনিষ্ঠার মুখটা ছাইয়ের মতো ফ্যাকাসে হয়ে যায়। আত্মপক্ষ সমর্থনে সে কিছু বলার চেষ্টা করে। তার আগেই আমি দাবড়ে উঠি , "একটা কথাও বলবে না তুমি। তোমার উপরে নয় , তোমাকে ভালো বেসেছিলাম বলে আমার নিজের উপরেই ঘৃণা হচ্ছে। এই মুহুর্তে আমার চোখের সামনে থেকে বেরিয়ে যাও। "
আমার চোখে তখন আগুন জ্বলছিল। তনিষ্ঠা আর কথা বলার সাহস পায় না। ভীতসন্ত্রস্ত পায়ে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বিছানার উপরে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ি। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কে জানে ! ঘুম ভাঙে তনিষ্ঠার আকূল কান্নার শব্দে। বিছানায় শুয়ে শুয়েই শুনতে পাই সে কেঁদে কেঁদে বলে চলেছে , " আমার মুখ দেখতে না চাও , আমাকে দূর করে দাও। তুমি বাইরে এসে খাওয়াদাওয়া করো। নাহলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তুমি দরজা না খুললে আমি মাথা ঠুকে মরব। "
কান্না ছাপিয়ে সত্যিই তখন দরজায় মাথা ঠোকার শব্দ জোরদার হয়ে ওঠে। আমি আর স্থির থাকতে পারি না। চট করে দরজা খুলতেই টাল সামলাতে না পেরে মেঝের উপরে কপাল ঠুকে পড়ে যায় তনিষ্ঠা ৷ আমি টেনে তুলি তাকে। তখন তার কপাল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। রক্ত আর চোখের জল মাখামাখি হয়ে আছে সারা মুখ। অন্যবারের মতোই আমি অস্থির হয়ে উঠি। ওই মুখেই যে আজও আমি " শ্রাবস্তীর কারুকার্য " দেখতে পাই। হাত ধরে তুলে তাকে বুকে টেনে নিই , " তনু কেন কর এমন ? তুমি নিজেও কষ্ট পাও। আমাকেও কষ্ট দাও। "
তনিষ্ঠা আমার বুকে গুঁজে দিয়ে ফুপিয়ে ওঠে , " বিশ্বাস করো মাঝেমাঝে আমার কি যে হয়ে যায় তা আমিও জানি না ? হাতটা নিশপিশ করে ওঠে। কিছুতেই নিজেকে সংবরণ করতে পারিনা। তুমি আমাকে কঠিন শাস্তি। "
কাকে শাস্তি দেব ? ওকে শাস্তি দিয়ে আমি যে নিজেই বেশি শাস্তি পাব। আস্তে আস্তে তার মুখটা তুলে ধরে কান্না ভেজা চোখের পাতায় ঠোট ছোঁয়ায়। সেদিন রাতে তনিষ্ঠাকে নতুন করে আবিস্কার করি। সে'ও আমাকে জড়িয়ে ধরে আর কোনদিন ওই ধরণের ঘটনা ঘটাবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে। আমি নির্ভার হই। কিন্তু প্রতিজ্ঞা রাখতে পারে না সে। মাঝেমধ্যে বাড়িতে নতুন শোপিস নিদেনপক্ষে কাপ - প্লেট , কাঁটাচামচ সহ বিভিন্ন জিনিস দেখতে পাই। সাধারণত কোন আত্মীয় কিম্বা বন্ধুরবাড়ি থেকে ফেরার পরই জিনিসগুলো দেখা যায়। সেগুলো যে কারও বাড়ি থেকে চুরি করে আনা হয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয়না আমার। প্রতিবারই রাগারাগি করি। প্রতিবারই তনিষ্ঠা প্রতিজ্ঞা করে। কিন্তু তার স্বভাব পাল্টায় না। লজ্জায় কাউকে সমস্যার কথাটা বলতেও পারি না। ক্রমশ মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি।
শেষে বন্ধুবান্ধব , আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়াই ছেড়ে দিই। এমনকি গিফট এবং লাফিংবুদ্ধ কিনেও দিব্যজ্যোতির পরের বিবাহবার্ষিকীতেও যাওয়া হয়না। পরের দিন কলেজে ধরে দিব্যজ্যোতি। রাগ দেখায় , " কিরে কাল এলি না যে ? ফোনে ধরার চেষ্টা করলাম তাও সুইচ অফ। "
আমি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি , " আসলে শরীরটা খারাপ ছিল তাই --। "
দিব্যজ্যোতি কথা শেষ করতে দেয়না। গভীরভাবে আমার মুখ পর্যবেক্ষণ করে বলে , "উহু , তোর মুখ তো সে কথা বলছে না। মনের ভিতরে একটা ঝড় বইছে মনে হচ্ছে ৷ ঝেড়ে কাশ তো দেখি। "
আমি আর পারছিলাম না। তনিষ্ঠার ব্যাপারটি পাষাণভারের মতো বুকের ভিতরে চেপে বসেছিল। কারও সঙ্গে শেয়ার করে হালকা হতে ইচ্ছা করছিল। দিব্যকেই সব খুলে বলি। ওর বাড়ি থেকে লাফিং বুদ্ধ চুরির কথাটাও গোপন করিনা। সব শুনে দিব্য আমাকেই তিরস্কার করে , " এই তুই কলেজে পড়াস ? ঘরের ভিতরে কতদিন ঢুকে থাকবি ? অন্ধ হয়ে থাকলে কি আর প্রলয় বন্ধ থাকে ? আরে বউদির ওটা একটা রোগ। ইমিডিয়েট চিকিৎসা দরকার।"
আমি অবাক হই , " রোগ ! তনুর আচরণ আমারও কেমন সন্দেহজনক ঠেকেছিল। কিন্তু সেটা যে রোগ তা জানা ছিল না৷ "
" আলবাত রোগ। আমার চেনা একজন নামকরা মনোবিদ আছেন। বউদিকে নিয়ে কালই চল। "
তার কথায় আমি একটু আশার আলো দেখতে পাই। আবেগে তার হাত জড়িয়ে ধরি , " তুই আমাকে বাঁচালি ভাই। তোকে কি বলে যে --। "
আমাকে থামিয়ে দিয়ে দিব্য ধমকে ওঠে , " কি বলে ধন্যবাদ দিবি ভেবে পাচ্ছিস না তাই তো ? মারব থাপ্পড় তখন বুঝবি। বন্ধুকে আবার ধন্যবাদ কিসের ? তোকে অবশ্য থাপ্পড় মারাই উচিত। এতদিন রোগটা পুষে রেখেছিস। চিকিৎসা হলে হয়তো এতদিনে সেরে যেত। "
দিব্যর কথা শুনে খুব অনুশোচনা হয়। আক্ষেপ হয়৷ সত্যিই হয়তো তনিষ্ঠা এতদিনে ভালো হয়ে যেত। তাহলে আমাদের গ্লানিময় জীবনযাপন করতে হতনা। পরদিন তনিষ্ঠাকে নিয়ে দিব্যর সঙ্গে মনোবিদ অভিলাষ সেনের কাছে যাই।
ডাক্তার সেন তনিষ্ঠার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলে আমাকে আর দিব্যকে অ্যান্টিচেম্বারে ডেকে নেন। আমার বুক দুরুদুরু করছিল তখন। ডাক্তার কি বলবেন ? তনু ভালো হয়ে যাবে তো ? আর পাঁচজন দম্পতির মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারব তো আমরা ? প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল শুধু। কিন্তু যদি ডাক্তারবাবু নিরাশ করেন ! সেই আশংকায় জিজ্ঞেস করতে সাহস হচ্ছিল না। সম্ভবত সেটা আন্দাজ করে দিব্যই জিজ্ঞেস করে , "কেমন দেখলেন ? "
" দেখুন এটা একটা মানসিক বিকার। মনোস্তত্ত্বের ভাষায় রোগটির নাম হল ক্লেপ্টোম্যানিয়া। মস্তিকে সেরোটোনিন নামক হরমোনের প্রভাবে ওই রোগ হতে পারে ৷ আবার বংশগত কারণেও হতে পারে। ওই রোগে আক্রান্তদের প্রয়োজন থাক বা নাই থাক হঠাৎ কোন বস্তু দেখলে হাত নিশপিশ করতে থাকে। কিছুতেই চুরির আকাঙ্খাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তারা। বিভিন্ন পেশার বিশ্ববিখ্যাত বহু মানুষও ওই রোগের শিকার হয়েছেন ৷ তাদের মধ্যে নামী অভিনেতা , খেলোয়াড় , রাজনীতিবিদ এমনকি চিকিৎসকও রয়েছেন। ওইসব রোগীরা তাদের কৃতকর্মের জন্য সবসময় একটা অপরাধবোধ এবং আত্মগ্লানিতে ভোগেন। তাই মনোবিদের কাছে যেতে ভয় পান। শেষে মানসিক অবসাদে ভুগতে ভুগতে অনেকে আত্মহননের পথ পর্যন্ত বেছে নেন। "
তনিষ্ঠার ওইরকম পরিনতির কথা ভাবতেই আমি শিউরে উঠি। ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করি , " ওই রোগ থেকে মুক্তির উপায় কি ? "
" সাধারণত ওষুধ দিয়ে ওই রোগ নিরাময় করা যায় না। তবে সাইকোথেরাপি চালিয়ে গেলে ভালো ফল মিলতে পারে। পাশাপাশি বাগান করা , নান্দনিকচর্চা সহ সন্তান লালনপালনের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারলে ওই ধরণের প্রবণতা কমতে পারে। আপাতত একটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি। সেটা খাওয়ান। থেরাপিটাও চলুক। তবে আমার সাজেস্ট সমস্যা না থাকলে এবার একটি সন্তান নিয়ে নিন ৷ সন্তান এলে দেখবেন তাকে নিয়েই আপনার স্ত্রী ব্যস্ত থাকবেন। সেই ব্যস্ততাই তাকে ওই রোগ থেকে দূরে সরিয়ে আনতে পারে ৷ "
মনোবিদের আশ্বাসে আমার মনের দুশ্চিন্তাটা কিছুটা কমে আসে। তাঁর নির্দেশ মতোই চিকিৎসা চলতে থাকে। নানা দিকে তনিষ্ঠাকে মগ্ন রাখার চেষ্টা করি। আবার পার্টিতে যাওয়া আসতে করতে থাকি। দিব্যজ্যোতির বাড়িও বাদ থাকে না। তবে লাফিং বুদ্ধের ব্যাপারটি যে দিব্য জানে সেটা তনিষ্ঠা আর বলি না। নীপবীথির জন্মদিনে একটা লাফিং বুদ্ধ বাড়তি উপহার দিয়ে দিই। এমনকি মনসুর ফেরিওয়ালাকেও জোর করে ঈদে একটা উপহার গছিয়ে দিই। মনের মধ্যে জমে থাকা অপরাধবোধগুলো অনেকখানিই প্রশমিত হয়ে আসে। তনিষ্ঠার রোগটাও আর মাথাচাড়া দেয়না। তার উপরে নজরদারি করার আর দরকার হয়না। মাসখানেকের মধ্যেই নবজাতকের আগমন সংবাদ দেয় সে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে জড়িয়ে ধরি তাকে। পৃথিবীটাকে আবার সুখের স্বর্গ মনে হয়। তনিষ্ঠার মাতৃত্বের লক্ষ্মণ যত স্পষ্ট হয় আমি ততই আশান্বিত হয়ে উঠি। ডাক্তারবাবু বলেছেন , কোলে সন্তান এলে তনিষ্ঠার রোগটা পুরোপুরি সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমি সেই আশায় দিন গুনি৷ তারমধ্যেই একদিন ঘটে যায় অঘটন।
সেদিন অফ পিরিয়ডে কলেজের টিচার্সরুমে বসে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছিলাম। সেইসময় অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে। অন করতেই ওপ্রান্ত থেকে ঘোষকের মতো কেউ বলে ওঠেন , " নমস্কার , আমি মধুরেণু কমপ্লেক্স থেকে বলছি। আপনি চট করে একবার এখানে চলে আসুন।"
কিছু জিজ্ঞাসা করারও সুযোগ মেলেনা। ফোন কেটে যায়। বারকয়েক চেষ্টার পর ওপ্রান্ত থেকে তীব্র বিরক্তি উড়ে আসে , " বললাম তো চলে আসুন। কি ব্যাপার এখানে এসেই শুনবেন ৷ ব্যাপারটা গোপনীয়। "
ফোনের নম্বরটা অচেনা হলেও মধুরেণু কমপ্লেক্স নামটা অপরিচিত নয়। শহরের সব থেকে অভিজাত শপিংমল। হিরে থেকে জিরে সব একছাতার তলায় পাওয়া যায়। খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। কি হতে পারে ? ব্যাপারটা গোপনীয় শুনে দিব্যজ্যোতিকেও বলতে পারিনা। বিভাগীয় প্রধানকে ব্যক্তিগত সমসার কথা বলে একরাশ উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা নিয়ে দ্রুত শপিংমলে পৌঁচ্ছোয়। গাড়িটা পার্কিং জোনে রেখে রিসেপশনে পৌঁছোতেই শপিংমলের মালিক বিরজাপ্রসাদ আগরওয়াল এগিয়ে আসেন।
দীর্ঘদিন ধরে কেনাকাটার সুবাদে আগরওয়াল পরিচিত মুখ। তিনি ইশারায় আমাকে পাশের একটি ঘরে ডেকে নিয়ে যান। ঘরে ঢুকেই আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। দেখতে পাই চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছে তনিষ্ঠা। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন সেলসগার্ল আর বয়। গাড়িতে আসার সময় এইরকমই সম্ভবনার কথা মনের মধ্যে উঁকি দিয়েছিল। তাই কি ঘটছে তাও আন্দাজ করতে অসুবিধা হয়না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আগরওয়ালের মুখের দিকে তাকায়। আগরওয়াল বলেন , " কি হয়েছে আপনি নিজের চোখেই দেখুন। "
বলেই রিমোট অন করেন। দেওয়ালের টিভিতে ফুটে ওঠে সিসিটিভির ফুটেজ। সেই ফুটেজে দেখা যায় কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে তনিষ্ঠা শাড়ি বাছাবাছি করতে করতে টুক করে একটা শাড়ি পেটের মধ্যে গুঁজে নিচ্ছে। লজ্জায় অপমানে আমার মুখ নত হয়ে আসে। কোনও কথা সরেনা। আগরওয়াল চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে শুরু করেন , "আপনাদের মতো শিক্ষিত - সম্ভ্রান্ত , অবস্থাপন্ন পরিবারের মহিলারা যদি এই ন্যাক্কারজনক কাজ করেন তাহলে পেটের দায়ে যারা চুরিচামারি করে তাদের আর দোষ কি ? সেইরকম পরিবাররের মেয়ে হলে তো এতক্ষণ উত্তমমধ্যম দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হত। আপনারা আমাদের দীর্ঘদিনের কাস্টমার । আপনি শহরের মান্যগণ্য মানুষ তাই পুলিশকে কিছু জানাই নি। শাড়িটা এখনও আপনার স্ত্রীর পেটে গোঁজা আছে। আপনাকে দেখানোর জন্যেই বের করা হয়নি। আপনি চাইলে শাড়িটা নিতে পারেন। তিনহাজার টাকা দাম। নাহলে শাড়িটা বের করে নিতে হবে। " শাড়ি বের করার দৃশ্যটা ভাবতেই আমার গাটা গুলিয়ে ওঠে। দ্রুত মানিব্যাগ থেকে তিন হাজার টাকা বের করে আগরওয়ালের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তনিষ্ঠাকে নিয়ে চলমান সিঁড়িতে পা রাখি ৷ পিছন থেকে আগরওয়াল ক্যাশমেমো নিয়ে যাওয়ার জন্য চিৎকার করতে থাকেন৷ আমি কান করি না। তনিষ্ঠার হাত ধরে সোজা গাড়িতে উঠি। কানে তখনও আগরওয়ালের বিদ্রুপগুলো তপ্তশলাকার মত বিদ্ধ করে চলে। মনে হয় যেন এলাকা ছেড়ে পালাতে পারলে বাঁচি। সেইজন্য রুদ্ধশ্বাসে গাড়ি ছোটায়। মাঝে একটুক্ষণের জন্য পরিচিত দোকান থেকে কিনে নিই তিনপাতা ঘুমের ওষুধ। সারারাস্তা কেউ কারও সঙ্গে একটাও কথা বলিনা।
সন্ধ্যার মুখে বাড়ির সামনে পৌঁছোতেই দেখতে পাই প্রতিবেশীদের উঁকিঝুঁকি। গাড়িটা কোনরকমে গারেজে রেখে দিয়ে চোরের মতোই ভিতরে ঢুকে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিই ৷ তনিষ্ঠা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গিয়ে বিছানায় নিজেকে সঁপে দেয়। আমি বসারঘরের সোফায় নিঝুম হয়ে বসে থাকি। কিন্তু তিষ্ঠোতে পারিনা। একের পর এক ফোন আসতে শুরু করে। আমিও একের পর ফোন কাটতে কাটতে তিতিবিরক্ত হয়ে পড়ি। একসময় ফোনের সুইচ বন্ধ করে দিই। আগরওয়াল পুলিশকে না জানালেও ব্যাপারটি যে সোস্যালমিডিয়া এবং সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে তা নিয়ে আর কোনও সংশয় থাকে না। সঙ্গে সঙ্গে টিভির রিমোট অন করি। আমার ধারণাই সত্যি হয়। চ্যানেলে চ্যানেলে তখন " শহরের অভিজাত শপিং মলে কেনাকাটার অছিলায় অধ্যাপকের স্ত্রীর শাড়ি চুরির চেষ্টা " শীর্ষক সংবাদ সম্প্রচারিত হচ্ছে। টিভি বন্ধ করে মোবাইল খুলি। সেখানেও একই খবর মুহুর্তের মধ্যে ভাইরাল। আমার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। সোফার উপরে এলিয়ে পড়ি। দীক্ষক্ষণ ওইভাবেই পড়েছিলাম। দূরে কোথাও রাত্রি বারোটার ঘন্টাধ্বনি শুনে সোফা ছেড়ে উঠে পড়ি। গ্লাসের জলে ঘুমের ওষুধগুলো মিশিয়ে নিই। খাওয়ার আগে শেষবাবের মত তনিষ্ঠাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করে। গ্লাসটা নিয়ে পা টিপেটিপে শোওয়ার ঘরে যাই। নীল আলোটা জ্বালিয়ে দিই। নীলাভ আলোয় দেখতে পাই চিৎ হয়ে বিছানার উপরে ঘুমিয়ে রয়েছে তনিষ্ঠা। গালে তখনো শুকিয়ে যাওয়া জলে দাগ। পেট থেকে শাড়ি সরে গিয়েছে। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মাতৃত্বের লক্ষণ। মনের মধ্যে একটা দোলাচল শুরু হয়ে যায়। এদের ফেলে যাব কি করে ? সমাজ সংসার তো তনিষ্ঠার অসুখের কথা বিবেচনা করবে না। চোর বলে দাগিয়ে দেবে। তখন কি হবে মা আর অনাগত সন্তানের ? যেতে হলে ওদের নিয়েই যেতে হবে। সেই কথা ভেবে তনিষ্ঠার মুখে চেপে ধরার জন্য পাশে পড়ে থাকা বালিশটা তুলে নিই। ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যায় তার মুখের কাছে। দু'চোখ ভরে দেখে নিই তনিষ্ঠার মুখ। তার মুখের কোথাও তখন মালিন্যের চিহ্নমাত্র নেই। সারাটি মুখ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অনাঘ্রাতা কিশোরীর সারল্য। আমি থরথরিয়ে কেঁপে ওঠি। হাত থেকে পড়ে যায় বালিশ। তনিষ্ঠার পেটে কান লাগিয়ে অনাগত সন্তানের পদধ্বনি শুনি। ভুলে যাই , কাল সকালে দরজা খুললেই প্রতিবেশীদের উঁকিঝুঁকি শুরু হয়ে যাবে। ভুলে যাই রাস্তায় বেরোলে লোকেরা আঙুল উঁচিয়ে বলবে , ওই দেখো ওই লোকটার বউ শাড়ি চুরি করে ধরা পড়েছিল। ভুলে যাই কলেজে অহরহ অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। জগত সংসার সব ভুলে যায় আমি। আমাকে সব ভুলিয়ে দেয় অনাগত সন্তানের পদধ্বনি। তনিষ্ঠার পেটে কান রেখে সেই পদধ্বনি শুনতেই থাকি।