Header Ads

গল্প - সময়, কলমে - আবদুস সালাম

 


সময়

আবদুস সালাম


     (এক)

অবস্থাপন্ন ঘরের বউ সাঈদা । জমজমাট সংসার । লাউয়ের ডগার মত তার বাড়ন্ত বৈভব ।পরপর তিন পুত্র সন্তানের জননী। যেমন শ্বশুর বাড়িতে এনেছে খুশির ঢেউ তেমনি স্বামীর কাছে পেয়েছেন অকুণ্ঠ ভালোবাসা । নিজেকে খুব ভাগ্যবতী বলে মনে করে গর্ব অনুভব করতেন ।


         নলহাটি কলেজ মোড়ে হার্ডওয়ার্স এর দোকান। বাড়ন্ত ব্যবসা দেখে পাড়ার মাস্তানদের জুলুমবাজি ওদিন দিন বেড়ে চলেছে ।যখন তখন দোকানে গিয়ে চাঁদার রশিদ ধরিয়ে দেয়। প্রথম প্রথম অল্পস্বল্প চাঁদা কিছু মনে করতো না । সরস্বতী পূজা থেকে আরম্ভ করে মনসা পূজা, চড়ক পূজা ,কীর্তন কোন কিছুতেই বাদ পড়তো না যেন ।যম বাবাজী যেমন জলে স্হলে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে বিদ্যমান । ঠিক তেমনি সর্বক্ষেত্রে সর্বত্রই মে কোনো উৎসব অনুষ্ঠানে চাঁদার জুলুমবাজী বিরাজমান।


      মাঝেমধ্যে ভাবছেন দোকানের অবস্থান বদলিয়ে বাড়ির কাছাকাছি নিয়ে আসি ।কিন্তু এও ভাবছেন নলহাটি বাস স্টান্ড অন্তত কুড়ি পঁচিশ খানা গ্রামের মোড় ।সেহেতু ব্যবসায়ের প্লট পরিবর্তন হলে বিস্তর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ।যাক অল্প কিছু চাঁদা লাগছে লাগুক ,এসব সাত-পাঁচ ভেবে পরিবর্তনের চিন্তা আপাতত মন থেকে সরিয়ে ফেলেছে সে।

        দোকান থেকে রাত নটার আগে কখনোই আসতে পারেন না। অবশ্য শহরে রাত ন'টা এমন কিছুই নয় । বাড়তি কিছু লাভের আশায় কালক্ষেপ না করে ছেলেদের নজর দিতে মনে মনে তাগিদ অনুভব করেন । হাত মুখ ধুয়ে চা খেয়ে এগারোটা পর্যন্ত সময় ছেলেদের পেছনে ব্যয় করেন।

   এক কালে বিজ্ঞান বিভাগের সেরা ছেলে সাব্বির সাহেব । রাজনীতি আলো-আঁধারিতে পড়ে চাকরি পাওয়া হয়ে ওঠেনি ।রাজনীতির টানাপোড়েনে চাকরির বয়স কখন পার হয়ে গেছে টের পাইনি । বয়স পার হয়ে যাওয়ায় প্রথম প্রথম দারুণ মুষড়ে পড়েছিলো সে । পরে স্ত্রীর পূর্ণ মানসিক ও আর্থিক সহযোগিতায় তিল তিল করে গড়ে তুলেছে "সাব্বির এন্টারপ্রাইজ " ।কথায় আছে না " সংসার সুখী হয় রমনীর গুনে " । স্ত্রীর সহযোগিতায় তার ব্যবসাতে আরও তিন চারটে ছেলের ডাল ভাতের ব্যবস্থা হয়ে যায় অনায়াসে। । সত্যিই আল্লাহর দোয়ায় ব্যবসা উঠছে ফুলে ফেঁপে। লাউয়ের ডগার মত বেড়ে চলেছে।

       তিনটি সন্তানই সাব্বির সাহেবের মেধাবী । বিদ্যালয়ের প্রত্যেক ক্লাশে তারা প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয় নি কোন দিন। এই সাফল্যের পেছনে ছেলেরা যেমন পরিশ্রম করে তেমনি ক্লান্ত সাব্বির সাহেব ও ছেলেদেরকে শ্রম দেন যথাসাধ্য ভাবে । রাতের পড়াটা নিজে না দেখলে শান্তি পান না।    

     হঠাৎ ভূমিকম্প যেমন পৃথিবীর সবকিছুকে উলটপালট করে দেয় , তছনছ করে দেয় তেমনি একটা ঘটনা সাব্বির পরিবারে অন্ধকার নামিয়ে আনে । দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পথে কারা যেন তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। সেই যে গেলো আর ফিরে এলো না কোনোদিন-----

          ( দুই)

      সাইদা প্রথমদিকে ভেঙে পড়লেও সাব্বির এন্টারপ্রাইজ কে তাদের কর্মচারীদের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় হাল ধরেছেন । ভেসে যেতে দেননি । অবশ্য অনেকে হারানো স্বামীর জন্য কুম্ভীরাশ্রু ফেলেছেন ।সুচতুরা সাইদা অদৃষ্টের পরিহাস হাসিমুখে মেনে নিয়েছে । নিজের ব্যাবসাকে উন্নতির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সর্বোতো চেষ্টা করে গেছেন।      

     স্বামীর স্বপ্নকে কিভাবে রূপ দেবেন তা নিয়ে বিস্তর চিন্তাভাবনা । লজ্জার মাথা খেয়ে দোকানের মালিক সেজে বসতে দ্বিধা করনি । সাব্বির সাহেব নিজে যা পারেননি ছেলেদের দিয়ে তা পুষিয়ে নিতে চেয়েছিলেন । চাকরি তোদেরকে পেতেই হবে ।এর জন্য চাই ভালো রেজাল্ট। সাপ্তাহিক মীযান পত্রিকায় আল-আমিন মিশনের ছাত্র ভর্তির বিজ্ঞাপন দেখে নলহাটি বাসস্ট্যান্ডের বইয়ের দোকান" যোগাযোগ " ফর্ম তুলে ছেলেদের ভর্তি পরীক্ষায় বসান। দুটো ছেলেই ভর্তি পরীক্ষায় ভালো রাঙ্ক করে। স্বামী হারা সাইদার একটি ই স্বপ্ন ছেলেকে মানুষ করতে হবে। আল আমিন মিশন এর কর্ণধার নুরুল ইসলাম সাহেব যখন সাক্ষাৎকার নেন তখন সাইদার এই মনোভাবের দারুণ প্রশংসা করেন এবং সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দেন। এভাবেই দুটো বছর কেটে যায়।

          ( তিন)


   দুটো ছেলে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ভালো রাঙ্ক করে ভর্তি হয়ে যায় শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ঘাতপ্রতিঘাতে দিন চলে যায়।বহু ঝড়ঝাপটা এসে লাগে সংসারের পালে। তবু শক্ত হাতে দাঁড় ধরে থাকে। পড়া শেষ হতে না হতেই ক্যাম্পাসিং হয়ে যায়। দুই ভাইয়েরই টাটা মোটরসের এর আন্ডারে বাঙ্গালোরে চাকরি । বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এক্সট্রা পারফরম্যান্স দেখে পাঠিয়ে দেয় আমেরিকা। ধন্য ধন্য পড়ে যায় শহরে।নলহাটি পৌরসভা ও অর্পণ পত্রিকার তরফ থেকে দেয়া হয় বিশাল সংবর্ধনা ।সেদিন গর্বে ভরে উঠেছিল মায়ের বুক । ছুটে গিয়ে স্বামীর ছবির সামনে কেঁদে কেঁদে বলেছে আমি পেরেছি তোমার স্বপ্নকে সার্থক করতে। তুমি যেখানে থাকো ওদের জন্য দোয়া করো। আজ যদি তুমি থাকতে --------

কোন কথা আর মুখে আসেনি সাইদার।কেবল চোখ দিয়ে গড়িয়ে চলেছিল আনন্দের অশ্রু ।

  ছোট ছেলেটি ও ডাক্তারিতে পড়ার সুযোগ পেয়ে যায়। কোন উৎসব অনুষ্ঠানে নেমন্তন্ন খেতে গেলে ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার এর মা বলে আলাদা রকম খাতির পেয়ে থাকে। গর্বে তখন বুক ভরে যায়। অনেকে আবার রত্নগর্ভা বলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। মনে মনে অহংকার হয় বইকি।

        বয়স জনিত কারণে আর ছেলেদের অনুরোধে ব্যবসা দেখাশোনা করতে দোকান যান না ।সাব্বির এন্টারপ্রাইজ কে যে সকল কর্মচারীদের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় উন্নতির শিখরে উঠে ছিল তাদেরকে তিনি মালিক বানিয়ে দিয়ে অবসর নিয়েছেন। প্রতিষ্ঠিত ছেলেরা নিজেদের বউ ছেলে নিয়ে নিজেদের কর্মস্থলে চলে গেছে ।

          প্রথম প্রথম সপ্তাহে একদিন করে ফোন আসতো । সব ছেলেরা বউ- মা রা জিজ্ঞেস করতো কেমন আছেন মা । পরামর্শ দিতো শরীরের দিকে নজর রাখবেন খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। ্ ।

          (চার)

    এর পর নদী দিয়ে জল গড়িয়েছে অনেক। যত দিন যেতে লাগল ফোন করার মাত্রা দিন দিন কমতে শুরু করল ।মায়ের নামে ছেলেরা কর্তব্য করার জন্য মাস গেলে টাকা পাঠাতো । কোন কোন মাস আবার টাকা পাঠাতেও ভুল হতে লাগলো । তবে দোকানদাররা জানতো টাকা অবশ্যই ছেলেরা পাঠাবে তাই তারা কোনদিন অসম্মান করত না বুড়িকে । এভাবেই একের পর এক মন খারাপের কীর্তন গেয়ে দিন অতিবাহিত হতে শুরু করলো। যতদিন যায় বয়সের ভারে শরীর খারাপ হতে শুরু করে । কর্তব্যের খাতিরে মায়ের দেখভাল করার জন্য একজন কাজের মাসী নিযুক্ত করে যায়। মাস গেলে কাজের মাসীর দক্ষিণাও তো সময় মতো দরকার। সেটা যখন অনিয়মিত তখন কাজের মাসীর কাজ ও অনিয়মিত হয়ে দাঁড়ালো। কাজের গাফিলতি মাত্রা দিন দিন বেড়েই চললো।

  চৈত্রের ঝরা পাতারা হলুদ রং মেখে পড়ে থাকে গাছের তলায়। অবহেলা গ্রাস করে ফেলে অজান্তেই । মর্মর ধ্বনি ও বাতাস হয়ে ওঠে নিত্য সঙ্গী ।বাদুল বাতাস কানের কাছে বলে যায় মনের অনুচ্চারিত কথা। আপন মনে উল্টে যায় যৌবনের সেই পাতাগুলো। নিজেকে নিজের এই চরম পরিনতির কথা ভেবে শিউরে ওঠে। আল্লাহর কাছে জীবনের সমাপ্তি প্রার্থনা করে।

     একদিন প্রচন্ড জ্বর । চৈত্রের কড়া রোদ্দুর উপেক্ষা করে সরকারি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।টোটো ভাড়া করলে হতো। অবশ্যই হতো। কিন্তু এখন তো আর সেদিন নাই। ভেবেছিলো ঐ টাকা দিয়ে ঔষধ কিনতে পারবে। ষ্টেশনের ফটক পার হওয়ার মুখে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। ওখানের চায়ের দোকানদার শুভঙ্কর তাড়াতাড়ি ছুট্টে এসে জল ঢালে মাথায় । চোখে মুখে জল দেওয়ার পর একটু সুস্থ হলে রেখে আসে হাসপাতালে।চায়ের দোকানের কথা মাথায় নেই তখন।পরোপোকারি শুভঙ্কর হাসিমুখে মেনে নিয়েছে তার এই ক্ষণিকের লাভলোকসানের হিসাব। বৃদ্ধা মানুষ দেখলেই কেন যেন তার মায়ের কথা মনে পড়ে। কোন বৃদ্ধ বৃদ্ধা সাহায্যের হাত বাড়ালে শত খরিদ্দার ফেলে তার হিল্লে না করে ফিরে আসে না।

   হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়ার পর শুভঙ্কর জিজ্ঞেস করে তার নাম ধাম। বাড়িতে কে কে আছে---ইত্যাদি ইত্যাদি। কেননা তার বাড়িতে তো খবর খবর দিতে হবে। প্রথমে বুড়ি লজ্জায় মুখ নীচু করে ছিল। কিছুতেই তার ছেলেদের কথা মুখে আনার চেষ্টা করে নি। হয়তো ছেলেদের অসম্মান হবে।

  বহু জেদাজেদি করে জানতে পারে বুড়ির তিন টি ছেলে । দুটো ইঞ্জিনিয়ার, একটি ডাক্তার।সবাই থাকে বিদেশে ।পাল পরবে আগে তিন ভাই ই আসতো। এখন বছর তিনেক থেকে কেউ আসেনি । একটা ফোন করে কেউ দায় টুকু ও নেয় না। যে কাজের মেয়েটিকে ওরা রেখেছিল সেও আজ আসেনি।

ছেলেরা আধুনিক ও উন্নত মানের জীবন অতিবাহিত করতে ব্যাস্ত। বৃদ্ধা মা কে নিয়ে কেউ আর নতুন করে ঝঞ্ঝাট বাড়াতে চায় না। কোনো বউ কি চায় অসুস্থ বৃদ্ধা মানুষ বাড়িতে থাকুক । না বুঝে এখানে সেখানে হাত দিবে ।দামি দামি জিনিসপত্র নষ্ট করবে।নাতি নাতনী দের গেঁয়ো ভাষায় কথা বার্তা বলবে।হাড়পিত্তি জ্বলে যায় আর কি।

সংসারের অশান্তি বাড়াতে ছেলেরা ও কেউ মা কে বাড়ি আনার সাহস দেখায় না।

 এতো দিন লোকে সাইদা বেগম কে ভাগ্যবতী, রত্নগর্ভা বলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতো ।আর এখন পাড়ার লোকে ভাগ্যহীনা বলে মুখ ভেংচিয়ে চলে যায় পাশ কাটিয়ে।


No comments

Powered by Blogger.