গল্প - এইট ফোর টু জিরো, লেখক - এস এম মঈনুল হক
এইট ফোর টু জিরো
এস এম মঈনুল হক
ছাব্বিশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর শামীম অনুভব করল যে জীবনের পথটা বড়ই কঠিন। আরও কঠিন মনে হল সংসারের দায়িত্ব নেওয়া। কিন্তু তার চেয়েও যে আরও একটা কঠিন বিষয় আছে সেটা শামীম এখনও অনুভব করতে পারেনি। শামীমা মানে তার স্ত্রী সত্যিই কি তাকে ভালোবাসে? এর উত্তর এখনও সে পায় নি। শামীমার বয়স তখন বারো কি তেরো হবে। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ত সে। শামীম তখন স্নাতক শেষ করে গৃহ শিক্ষকতার কাজ করত। একে অপরকে দেখার পরই তাদের মধ্যে আন্তরিক ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছিল। দু বছরের মধ্যেই তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। দুই পরিবারের কেউ-ই এ বিয়ে মেনে নেয়নি। স্বভাবতই তাদের অন্যত্র চলে যেতে হয়। অনেক কষ্টে তারা সংসার জীবন শুরু করে। বর্তমানে বড় মেয়ে রিহানা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছে। বড় ছেলে বিএসসি। হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করেছে তারা। এর জন্য শামীমকে অনেক ধরনেরই কাজ করতে হয়েছে। কিছুদিন বেশ কয়েকটা ব্যাচ জোগাড় করে টিউশন পড়িয়েছে। কখনও প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা করেছে। বাকি সময় আবারও টিউশন। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি না হলেও পরিশ্রম এত করতে হয়েছে যে ঠিকমতো খাবারও সময় পেত না শামীম। এর জন্য তার কোনো আফসোসও নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে শামীমার অবজ্ঞা ও অবহেলিত কিছু কথা তার মনে চরম আঘাতের সৃষ্টি করছে।
- মাছ এনেছো? রিহানা তো আবার মাছ ছাড়া ভাত খেতে পারে না।
- আজকে মাছ কেনার মত টাকা ছিল না, তাই-
- দুদিন থেকে কাজে যাওনি। টাকা থাকবে কোথায়?
- তুমি তো জানো, কিছুদিন থেকে বুকের ব্যথাটা-
- বেড়েছে, তাইতো। ওষুধ খেতে পারো না?
পকেটে পয়সা থাকলেই তো ওষুধ খাবে। বর্তমানে রাজমিস্ত্রির কাজ করে শামীম। বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের কথাটা তার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন কুদর্শনা নারী এবং পকেট শূন্য পুরুষের মতো অসহায় পৃথিবীতে আর কেউ নেই। সুতরাং আর বসে থাকা ঠিক হবে না ভেবেই শামীম কাজে চলে গেল। রাত্রে প্রত্যেক দিনের মতোই আজও শামীমা শামীমের গলা জড়িয়ে ঘুমাতে লাগল।
- হ্যাঁ গো, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে বল।
চরম যন্তনা বুকে নিয়েও শামীম বলল, কই না তো। তাছাড়া তুমি তো আমার বুকেই আছো। যন্তনা কি আর থাকে।
- বলছিলাম আমার পা টা খুব চিবোচ্ছে।
- আচ্ছা ঠিক আছে, আমি টিপে দিচ্ছি তুমি ঘুমোও।
প্রতিনিয়ত এটা তাকে করতেই হয়। কিন্তু একদিনের কথা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। আজ থেকে বছর দুয়েক আগের কথা। সেদিন খুব হাটাহাটি হয়েছিল শামীমের। রাত্রে খুবই তার পা চিবোচ্ছিলো। শামীমাকে তার পায়ে হাত দিতে বললে সে বলেছিল- কি এমন হাড়ভাঙ্গা কাজ করেছ যে পা টিপতে হবে, কেন ওষুধ খেতে পারো না?
- বলছিলাম-
- কি বলবে আমি জানি। ঘুমিয়ে পড়ো, সব ঠিক হয়ে যাবে। যত সব।
বুকের ব্যথাটা আরও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল শামীমের। শামীমা ঘুমিয়ে পড়লে বিছানার ওপর বসে অনেকদিন আগের কথা ভাবতে লাগল শামীম। বিয়ের দু'বছর পরের কথা। বাবা মায়ের সঙ্গে মেয়ের যাওয়া আসা শুরু হয়। আজ পর্যন্ত তারা কোন আর্থিকসহায়তা পায়নি । শামীমকে দিয়ে তার বাবার জন্য এটা ওটা ফাই ফরমাশ খাটাই। এখনও পর্যন্ত তার শ্বশুর জামাই হিসেবে মেনে নেয়নি শামীমকে। শ্বশুরকে সালাম দিলে উত্তরে 'উ' ছাড়া আর কিছুই বলে না। এতে সে অবহেলিত ও লাঞ্ছিত মনে করে নিজেকে। শামীমার সেদিকে কোনদিনই ভ্রুক্ষেপ ছিল না আজও নেই। স্বামীর অপমান তার কাছে কিছুই নয়। বাবাকে জয়ী করে তার কি লাভ হয় সেই জানে। এ ব্যাপারে শামীম অনেকবার তাকে বলেছে কিন্তু কোনও ভ্রুক্ষেপই দেয়নি। কিন্তু আজ সে দারুণভাবে অস্থির? কেনইবা একটা কথা তাকে বারবার কুরে কুরে খাচ্ছে? কেনো সে প্রায়ই বলে আট হাজার চারশো কুড়ি / এইট ফোর টু জিরো। তাহলে সে যা ভাবছে তাই-ই কি? পাশের বাড়ির ভাবীর কাছে গেলে এর একটা সমাধান হতে পারে এই ভেবে দরজায় শিকল নেড়ে- ভাবী বাড়িতে আছেন কি?
দরজা খুলে দিয়ে- শামীম ভাই যে। এতদিন পর ভাবীকে মনে পড়ল?
-মনে তো পড়েই কিন্তু সময় পাচ্ছি না যে ভাবী।
-বসো বসো, একটু চা করি। অনেকক্ষণ থেকে চা খাব ভাবছি, কিন্তু পার্টনার পাচ্ছিলাম না। যাক, তোমাকে পেয়ে গেলাম এবার দুজনে বসে চা টা খাওয়া যাবে।
চা খেতে খেতে- একটা কথা জানতে চাইছিলাম ভাবী। আচ্ছা, আমান কি এখনও আমাদের বাড়ি আসে?
-হঠাৎ তোমার এ ধরনের প্রশ্নে আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাচ্ছি, কেননা এটা সম্পূর্ণ তোমাদের পারিবারীক ব্যাপার। তাছাড়া বেশ কয়েক বছর থেকে শামীমার আচরণও আমার খুব একটা ভালো লাগছে না। তুমি যখন জানতে চাইছো তাই বলছি। প্রায় ১২-১৩ বছর ধরে, তুমি যখন কাজের ক্ষেত্রে বাড়িতে থাকো না বা তোমার ছেলে মেয়েরা যখন হোস্টেলে থাকে ঠিক দিন দশটা এগারোটার সময় আমান তোমার বাড়ি আসে এবং বারোটার পরই সে চলে যাই । পাড়ার অনেকেই এ নিয়ে কানাকানি করে। আমিও এটাকে খুব ভালো চোখে মেনে নিতে পারি না। তাছাড়া আমি তো ভাবি যে তুমি সবই জানো। এতদিন পর কি হল যে তুমি এটা যাচাই করতে চাইছো।
-কিছু না ভাবী,একটা বিষয় আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। তাই-। আচ্ছা এখন আমি আসি ,পরে এসে আবার গল্প করে যাব।
দিন তিনেক পরে সে আমানের বাড়ি গেল। আমান তাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বলল- অনেকদিন পর আমার বাড়ি এলি। বল, তোর জন্য কি করতে পারি।
-তুই যদি কিছু না মনে করিস তাহলে একটা কথা বলি?
- কি মনে করব আবার। একটা কেন, হাজারটা বল।
- এইভাবে আমার সংসারটাকে ভেঙে দিস না ভাই। তুই তো জানিস, শামীমা ছাড়া আমার আর কেউ নেই।
- আমি অনেক আগেই আন্দাজ করেছিলাম যে তুই এই ধরনের কথা আমাকে একদিন শোনাবিই। তাই উত্তরগুলোও আগে থেকেই মুখস্ত করে রেখে দিয়েছি।
তোরা যখন কেউই থাকিস না তখন আমি তোর বাড়ি যায়। কি ভাবছিস, তোর সংসার ভাঙ্গার জন্য? তোর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেই তো পারতিস।
- পারতাম, কিন্তু তুই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তা ছাড়া আমার অনুপস্থিতিতে আমারই ঘরে এসে-
- চুপ, আর একটা কথাও বলবি না। নিজের স্ত্রীর খবর কোনদিন রেখেছিস? কখনও ওকে জিজ্ঞেস করেছিস, কেমন আছে ও? কখনও জিজ্ঞেস করেছিস, কেন ও তোকে রেগে রেগে কথা বলে? কখনও জানতে চেয়েছিস, তুই অপমানিত হওয়া সত্ত্বেও কেন ওর বাপের এটা ওটা ফাইফরমাস খাটাই? সবচেয়ে বড় কথাটা তো এখনও বলিনি। 'এইট ফোর টু জিরো' কথাটা কেন ও তোকে মাঝে মাঝে বলে? এর আসল উত্তরটা কখনও জানতে চেয়েছিস?
- সত্যি বলছি তোকে, যেদিন থেকে সংসারের দায়িত্ব নিয়েছি সারাদিন খাটাখাটনির পর ওকে যে ভালো করে কিছু একটা জিজ্ঞেস করব সে সময়ের ফুরসতটুকুও আমার মেলে নি। তোর এতসব প্রশ্নে আমি নিশ্চয়ই অনুভব করতে পারছি কিছুতো একটা হয়েছেই ।
- উত্তরগুলো নিবি না ?
- সব খুলে বল ভাই। আমি আর নিজেকে-
- ক্ষমা করতে পারছিস না, তাইতো। কিন্তু এখনও তো কিছুই জানিস না তুই। শুনতে চাইছিস তাই বলব। মন দিয়ে শোন- মনে পড়ে নাসিমকে ভর্তি করতে যাওয়ার সময় তোর কাছে সামান্য টাকাও ছিল না। দশ হাজার টাকা তোকে শামীমাই দিয়েছিল। রাত্রে বেলায় শামীমা তোকে একটা কথা মনে রাখতে বলেছিল- এইট ফোর টু জিরো অর্থাৎ আট হাজার চারশো কুড়ি টাকা আমার কাছ থেকে ধার নিয়েছে, সেটা তোকেই শোধ দিতে হবে। এই টাকাটা কি আমাকে শোধ দিয়েছিস?
- না।
- এইট ফোর টু জিরো বলার কারণটা কখনও জানতে চেয়েছিস?
- এটা নিয়ে তো অনেক দিন থেকেই আমার মনে একটা সন্দেহের আগুন জ্বলছে। এটাই তো আমার কাছে রহস্য হয়ে আছে।
- অথচ এতো দিন পর্যন্ত জানতেও চাইলি না এর আসল উত্তরটা কি।
- আমাকে সব খুলে বল আমান। আমি বড়ই চঞ্চল হয়ে পড়ছি। আমার ধৈর্য্য আর মানছে না।
- সব বলব। তোর ভাবীকে চা করতে বলি।
- চা খেতে ইচ্ছে করছে না।
- চা খেতে খেতে গল্প করার মজাই আলাদা। কই গো, শামীম এসেছে। দু কাপ চা দিয়ে যাও।
- ঠিক আছে, তোমরা গল্প কর। আমি এখনই চা নিয়ে আসছি।
আমিনা চা নিয়ে ভেতরে এসেই বলল-কতদিন পর শামীম ভাইয়ের দেখা পেলাম। আমাদেরকে আর মনেই পড়ছে না, তাই না শামীম ভাই?
- মনে পড়ে ভাবী। কিন্তু সময় করে উঠতে পারি না।
- মানুষ এখন ব্যস্ত। আসলেই সময়ের বড্ড অভাব। ও হ্যাঁ,আমি রান্না চাপিয়ে দিচ্ছি। দুপুরে কিন্তু তোমাকে আজ এখানেই খেয়ে যেতে হবে।
- না ভাবী, আর একদিন হবে।
- কোনও কথাই শুনবো না। তোমাকে আজ খেয়ে যেতে হবে বলছি, খেয়ে যেতেই হবে।
- তোর ভাবী ঠিকই বলছে। অনেকদিন তুই এখানে আসিস নি। আজ দুপুরে খেয়েই যাবি।
- ঠিক আছে, ভাবীর আদেশ তো রক্ষা করতেই হবে।
- তোমরা গল্প কর। আমি আসি।
- শুন তাহলে, নাসিমকে ভর্তি করার দশ হাজার টাকা তোরই পকেট কাটা টাকা।
- মানে-
- মানে তোর উপার্জিত টাকা থেকে কখনও পঞ্চাশ টাকা, কখনও কুড়ি টাকা, কখনও বা ত্রিশ টাকা নিয়ে দশ হাজার টাকা জমা করেছিল শামীমা। সে জানত নাসিমকে ভর্তি করার সময় টাকার দরকার হবে। কিন্তু তুই একসঙ্গে এতো টাকা পকেট থেকে বের করতে পারবি না। তোকে তোর শ্বশুরের ফাই-ফরমাশ খাটায় কেন জানিস? তোকে ওর বাবার কাছে জয়ী করার জন্য।
- মানে -
- মানে আর দুটো জামাইয়ের থেকে তুইও যে অনুপযুক্ত নোস সেটা প্রমাণ করার জন্য।
- আমি তোর কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
- শামীমা তার বাবাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল যে যতদিন না তোকে ঐ বাড়ির শ্রেষ্ট জামাই প্রমাণ করতে না পারবে ততদিন ঐ বাড়ির জল স্পর্শ পর্যন্ত করবে না। বর্তমানে সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে। এখন তুই ঐ বাড়ির শ্রেষ্ঠ জামাই।
- আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
-কিছুদিন পরে ঠিক বুঝতে পারবি।
- এইট ফোর টু জিরো ব্যাপারটা একটু খুলে বলবি।
- এখানেই সব রহস্য লুকিয়ে আছে। তুই যেদিন নাসিমকে ভর্তি করতে যাস সেই দিন সকাল থেকেই শামীমা পিঠের দুই সাইডে খুব ব্যথায় কাতর হয়ে পড়েছিল। তবুও তোকে কিছু বলেনি। এমন কি সে যে এত কষ্ট পাচ্ছিল সেটাও তোকে অনুভব করতে দেয়নি। কারণ, নাসিমের ভর্তিটা তার কাছে খুবই জরুরী ছিল। তুই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আমি তোর বাড়ি যায় এবং দেখি প্রচন্ড যন্ত্রণায় বিছানায় কাতরাচ্ছে।
- ভাইজান, আমি আর সহ্য করতে পারছি না। প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে। দয়া করে একটু ওষুধ এনে দাও।
ওর এই অবস্থা দেখে শেষ পর্যন্ত আমি শহরে গিয়ে একজন নেফ্রোলজিস্টকে দিয়ে চিকিৎসা করায়। সমস্ত রকমের প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট করার পর জানতে পারা যায় তার দুটো কিডনিতেই ইনফেকশন হয়েছে।
সেদিন সর্বমোট খরচ হয়েছিল আট হাজার চারশো কুড়ি টাকা। এইট ফোর টু জিরো। ওর একমাত্র অর্নামেন্টস কানের দুল দুটি খুলে দিয়ে বলেছিল ভাইজান এই দুল দুটি বিক্রি করে আজকের খরচ চালিয়ে নাও। তোমার ভাই এই দুল দুটি ছাড়া আর কিছুই অর্নামেনটস আমাকে দিতে পারে নি। আমি তোর ওই উপহারটুকু নষ্ট হতে দিইনি। আমার পকেট থেকেই খরচটা চালিয়েছিলাম। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস, ও তোর সামনে কোনদিন ওষুধ খায় না। এমনকি ওর যে ওষুধ আনা থাকে তুই সেটাও জানিস না। কারণ তুই সারাদিন খাটাখাটনি করে খুব সামান্য টাকা রোজগার করিস। এতে তোর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা এবং সংসারের খরচই ঠিক মতো হয় না। বাড়তি চাপ যাতে তোর উপর না আসে সেজন্য এসবের কিছুই তোকে প্রকাশ করেনি এবং আমাকেও প্রকাশ করতে নিষেধ করে দিয়েছিল। যে টাকাটাই রোজগার করিস, ওর হাতে তুলে দিস। ওই থেকে কিছু কিছু জমিয়ে ও ওষুধের পয়সাটা যোগাড় করে। মাঝে মাঝেই আমাকে মনে করিয়ে দেয় ,ভাইজান এইট ফোর টু জিরো। যেমন করেই হোক আপনার এই টাকাটা আমি শোধ করবই। আমি কারও কাছে ঋণী থাকব না ভাইজান। আমি তোমার টাকা একটু একটু করে জমিয়ে শোধ করবই।
শামীমের চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। এত সব ঘটে গেছে অথচ আমি কিছুই অনুভব করতে পারলাম না।
- তুই তো আইডিয়াল ম্যান রে। সংসারের এত বড় বোঝা কাঁধে নিয়েও অলসতাকে দূর করে রেখেছিস। এতো শারীরিক কষ্ট সত্ত্বেও নিজে এলিয়ে পড়িস নি। কোনও দিন নির্দিষ্ট সময় তোর খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত হয় না। অথচ কারও প্রতি কোনো অভিযোগ নেই তোর। তোর মত বন্ধু যে আমার গর্ব রে।
- তুই তো একটা মদখোর ছিলি। তোর এত সব পরিবর্তন দেখে আমি খুবই অবাক হচ্ছি। আমি যা জানি না তার থেকে অনেক কিছু বেশি তুই আমার সংসার সম্পর্কে জানিস। এর মধ্যেও কি কোনও রহস্য আছে, না আমার দুর্বলতা। একটু খুলে বলবি, তুই এত সব জানলি কি করে?
- সেদিনের কথা তোকে আর না বলে পারছি না। শুন তাহলে- শামীমাকে নিয়ে আসা তোর দশ বারো দিন হয়েছে। আমি ঠিক দুপুরবেলায় মদ্যপ অবস্থায় তোর বাড়িতে প্রবেশ করেই কোরআন শরীফ পড়ার সুন্দর সুর শুনে অবাক হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি এবং শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোরআন শরীফ পড়া শুনতে থাকি। তখনই আমার অন্তর বিগলিত হয় এবং আমার মাঝে আত্মিক অনুভূতির মানুষটা জেগে ওঠে।
- বলছি, ভেতরে ডাকবে না।
- কে ভাই আপনি? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না। তাছাড়া উনি তো বাড়িতে নেই।
- আমি জানি, উনি বাড়িতে নেই। ভেতরে আসবো কি। শামীম আমার বন্ধু।
- আসুন।
- এই ভর দুপুরে আমাকে মধ্যপ অবস্থায় দেখে তোমার ভয় করে না।
- আমি মহান আল্লাহ্ ছাড়া কাউকেই ভয় পায় না। আপনি আমার স্বামীর বন্ধু। তাছাড়া অতিথি সেবা আমার কর্তব্য। বলুন, আপনার জন্য কি করতে পারি।
- তোমার সুর আমার মনকে উদবেলিত করে দিয়েছে। তোমার সুরে আমি মুগ্ধ। আমার মনের মধ্যে মহৎ আত্মার উপস্থিতি অনুভব করতে পারছি। মনে হচ্ছে, এখন আমি সত্যিকারের সঠিক জায়গায় এসেছি। তোমার ঐ কোরআন শরীফের একটা করে লাইন আমাকে শেখাবে?
- কেন শেখাবে না ভাইজান। আপনি প্রত্যেকদিন আসবেন, একটা করে লাইন আপনাকে শেখাতে শেখাতে পুরো কোরআন শরীফটাই শিখিয়ে দেবে।
- আমাকে ভাইজান বললে!
- আমরা তিন বোন। আমার তো কোন ভাই নেই। পারবেন না, আপনি আমার ভাই হতে।
- পারব, খুব পারব। আমারও তো কোনও বোন নেই। তাছাড়া শামীম আমার থেকে কিছুদিনের বড়। সেই হিসেবে তুমি আমার দিদি। তোমার পা ছুঁয়ে একটা প্রণাম করার সুযোগ দাও।
- এসবের কোনও দরকার নেই ভাই। আপনাকে ভাই হিসেবে পেলাম, এই তো আমার অনেক পাওয়া।
- না দিদি, আজ তোমাকে আমি প্রণাম করবই। আর হ্যাঁ, এখন থেকে আমাকে আর 'আপনি' বলে সম্বোধন করবে না।
সেদিন আমি আমার ঐ দিদিকে প্রণাম করেই বেরিয়ে এসেছিলাম। মদ ত্যাগ করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে শুরু করেছিলাম। এখনও পড়ি। তারপর মাঝে মাঝে গিয়ে একটু একটু করে পুরো কুরআন শরীফটা শিখেছি। ও ওর এই হতভাগা ভাইকে সব কিছুই বলে। তাই, এত সব আমি জানি। এসব কিছু তোকে না জানার কারণ হল, তুই তোর প্রাণ প্রিয় অর্ধাঙ্গিনীর এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে পাছে Depressed হয়ে পড়িস। তা সে চাই নি। এমনিতেই তোর বিষাদ মাখা মুখখানি দেখে আড়ালে ডুকরে কাঁদে।
- বেশ কিছু দিন থেকে ওকে খিটখিটে মনে হচ্ছে। ওর ভালোবাসাটাও আগের তুলনায় অনেক কম মনে হচ্ছে।
- তোর প্রতি ওর ভালোবাসা এক ফোঁটাও কমেনি, বরং বেড়েছে। ওর অসুস্থতা ওকে খিটখিটে করে তুলেছে। কেউ যদি জানতে পারে দু মাসের মধ্যে তার মৃত্যু হবে। পৃথিবীর মায়া তাকে ত্যাগ করতেই হবে। তার মানষিক অবস্থা কি হতে পারে তুই বল।
- মানে!
- রিপর্টে জানা গেছে দুটো কিডনিই আর দু মাস মত কাজ করার পর কর্ম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। সেদিন হয়তো এই পৃথিবীর সমস্ত মায়া তাকে ত্যাগ করতেই হবে। এবার তুই বল, এই অবস্থায় তুই বা আমি হলে কি করতাম। পৃথিবীর প্রতি আর কোনও মায়া ওর নেই। শুধু আমাদের চিন্তায় ও ডুবে আছে।
চোখের জল আর ধরে রাখতে পারল না শামীম। হাঁও মাও করে কাঁদতে লাগল। বিয়োগব্যথা তাকেও দংশিবে। কখনও এটা কল্পনাও করেনি সে।
- সত্যি করে বলতো, ওকে বাঁচানোর কোনও পথই কি খোলা নেই আমাদের কাছে।
- আছে, একটা পথ খোলা আছে আমাদের কাছে। কেউ যদি একটা কিডনি ডোনেট করতে পারে তাহলে সে আবারও পৃথিবীর হাসিতে হাসতে পারবে।
- তুই যা করার করেছিস, এবার আমাকে কিছু করতে দে। আমি বাড়ি গিয়ে রিপোর্ট গুলো আনছি। ততক্ষণ তুই অপেক্ষা কর। আজই আমরা ডাক্তারের কাছে যাব।
- বাড়ি গিয়ে কোনও লাভ হবে না। রিপোর্ট গুলো আমার কাছেই আছে। তুই যাতে কিছুই বুঝতে না পারিস সেজন্যেই রিপোর্ট গুলো আমার কাছেই রাখতে বলেছে।
- এতদিন ওকে হেল্প করেছিস, এবার আমাকে কর। কোন ডাক্তার দেখাচ্ছিস ওকে?
- তোরই সহপাঠী, ডাক্তার বিশ্বজিৎ রায়।
- বিশ্বজিৎ জানে, শামীমা আমার স্ত্রী?
- না।
- রিপোর্ট গুলো নিয়ে এবার আমার সঙ্গে ডাক্তারের কাছে চল। দেখি কি করতে পারি।
দুজনেই ডাক্তারের ঘরে প্রবেশ করল। শামীম বলল - স্যার, একটা পরামর্শের জন্য-
ডাক্তার বিশ্বজিৎ রায় মাথা নিচু করে কি যেন পড়ছিলেন। পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে শামীমের দিকে তাকিয়ে বললেন - শামীম! তুই আমাকে স্যার বলছিস! কোথায় ছিলিস এতদিন? প্রায়ই তোর কথা মনে করি।
- না, মানে -
- কি মানে মানে করছিস। এই চেয়ারটা টেনে আমার পাশে বস। আমান ভাই আপনিও বসেন। হালকা ঠান্ডা পড়েছে। কফি খাওয়া যাক।
- বলছিলাম, আপনি যদি -
- ঠাস করে একটা চড় কষে দেব। আমাকে তুই করে কথা বলতে পারিস না।
কফি খেতে খেতে বিশ্বজিৎ বলল - তুই কি ভাবছিস, তোর পরামর্শ ও অবদানের কথা আমি ভুলে গেছি। কোনও দিন ভুলবনা। তোর পরামর্শ না পেলে আমি কোনোদিনই ডাক্তার হতে পারতাম না। শুধু এইটুকু বল,তোর কি কাজে আমি লাগতে পারি।
রিপোর্ট গুলো হাতে দিয়ে শামীম বলল - তোর বৌদির রিপোর্ট। যা হোক কিছু একটা কর।
- এই শামীমা তোর স্ত্রী আই মিন আমার বৌদি!
- হ্যাঁ।
- কিন্তু উনি তো এই আমান ভাইয়ের সঙ্গে আসেন।
- পরে সবকিছু তোকে খুলে বলব। এখন কি করতে হবে তাই বল।
- হয়ত তুই শুনেছিস, বৌদির অসুখটা খুব ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে চলে গেছে। কেউ যদি একটা কিডনি ডোনেট করতে পারে তাহলে উনি আবারও হাসতে খেলতে পারবেন।
- আমার কিডনি তো সুস্থ আছে। আমার একটা কিডনি দিয়ে ওকে বাঁচা ভাই।
- কিন্তু গ্রুপটা তো দেখতে হবে। ভেতরে আয়, টেস্টটা করা যাক।
টেস্ট করার পর জানা গেল উভয়ের কিডনি একই গ্রুপের। O+ Blood group.
- অপারেশনে কত টাকা খরচ হতে পারে।
- সে নিয়ে তোকে কিছুই ভাবতে হবে না। তুই ক্লাসে ফার্স্ট হতিস, আমি সেকেন্ড। এর জন্য তোর প্রতি আমার চরম হিংসে হতো। কিন্তু সেই সব দিন গুলির কথা কেমন করে ভুলি বল। আমার অঙ্কের খাতা নিয়ে যেতে ভুলে গেছিলাম। তোর খাতা দিয়েছিলিস এবং তোর খাতা থেকে অঙ্ক টুকে স্যারকে দিয়েছিলাম। সেদিন তুই আর আমি ছাড়া সবাই স্যারের কাছে মার খেয়েছিল। মা আমাকে টিফিন বক্সে দামী দামী কেক ভরে দিত। তোর টিফিন বক্সে থাকত সামান্য চানা মেশানো শুকনো মুড়ি। মাঝে মাঝেই আমি টিফিন বক্স নিয়ে যেতে ভুলে যেতাম। তুই না খেয়ে আমাকে তোর টিফিন খাওয়াতিস আর বলতিস তোর ক্ষুধা নেই। আরও কত কি। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর তুই বলেছিলিস - আমি গরীব ঘরের ছেলে। ইচ্ছে থাকলেও ডাক্তারি পড়তে পারব না, কিন্তু তোকে ডাক্তার হতেই হবে। সেদিন তোর পরামর্শ নিয়ে ডাক্তারি পড়তে গেছিলাম। আমার এই কামিয়াবি শুধুমাত্র তোর জন্য সম্ভব হয়েছে। কত রকমভাবে তোকে হেনস্তা করতাম। তবুও তুই আমার উন্নতি চাইতিস। অনেকভাবে তোর কাছে আমি ঋণী হয়ে আছি। আজ যখন একটা সুযোগ পেয়েছি তখন একটু হলেও সেবা করার সুযোগ দে ভাই। কিছুটা হলেও তোর ঋণ শোধ করি। আগামীকালই বৌদিকে অ্যাডমিট করে দে। আমি সব ব্যবস্থা করছি।
- আমার হাতে হাত রেখে তোরা দুই বন্ধু কথা দে, আমার কিডনি দেওয়ার কথা শামীমা যেন জানতে না পারে।
উভয়েই কিডনি দেওয়ার ব্যাপারটা গোপন রাখার কথা দিল।
পরদিন ও.টি. থেকে বেরিয়ে এসে
- অপারেশন সাকসেসফুল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেডে দেওয়া হবে। সবকিছু ব্যবস্থা করে রেখেছি। যতক্ষণ না জ্ঞান ফিরছে কেউ যেন ভেতরে না যায়।
- ভয়ের কোনও কারণ নেই তো স্যার?
- না আমান ভাই। সে এখন আউট অফ ডেঞ্জার। খবরটা দিতে শামীমের কাছে যাচ্ছি। আপনি এখানটাতেই বসে থাকুন। ও খুব উতলা হয়ে আছে।
ডাক্তার শামীমকে গিয়ে বলল- তুই খুব ভাগ্যবান। বৌদি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। একটু পরেই ওকে বেডে দেওয়া হবে। শুধু জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা। আশা করছি, দুদিন পরেই তুই স্বাভাবিক হয়ে যাবি।
- ওর খুব কষ্ট হচ্ছে বল।
- পাগল হয়েছিস। ও তো এখন অজ্ঞান অবস্থায় আছে। ও কষ্টের কি অনুভব করবে।
- আমার মন বলছে ও ভেতরে খুব কষ্টই পাচ্ছে।
- পাগলামি করিস না তো। আসলে ওকে তুই খুব ভালবাসিস বলেই তোর এরকম মনে হচ্ছে। তুই কোনও চিন্তা করিস না। আমি আসছি। কিছু ফর্মালিটিজ আছে। সেগুলো মেনটেইন করতে হবে।
কয়েক ঘন্টা পরে জ্ঞান ফিরল শামীমার। তার প্রতি সর্বক্ষণ লক্ষ্য ছিল নার্সের। ডাক্তার কে বললেন- স্যার, আপনার বৌদির জ্ঞান ফিরেছে। কাওকে যেন খুঁজছে মনে হচ্ছে।
ডাক্তার তাড়াতাড়ি কাছে এসে চোখ দুটো পরীক্ষা করে বললেন -আপনি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন বৌদি।
- বৌদি!
- হ্যাঁ, আপনি আমার বৌদি।
- কিন্তু, ডাক্তার-
- ওসব আপনি পরে শুনবেন। শুধু এইটুকু মনে রাখুন, আপনি আমার বৌদি।
ততক্ষণে আমানকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
- আমান ভাই, শামীমকে দেখছি না তো।
- ও দুদিন পরে আসবে।
- তোমার অপারেশনের টাকা দিতে হবে। তাই জোগাড় করতে গেছে।
- আমি এই এসি ঘরে আরাম করছি। আর মানুষটা এখনও খেটে মরছে। বিধাতার কি লীলা। এমন একটা মুহূর্তে আমার প্রিয় মানুষটার মুখখানা দেখতে পাচ্ছি না। সেও তো মানুষ। তবে কেন ওকে এই পৃথিবীতে এসে এত খাটাখাটনি করতে হচ্ছে। কি অপরাধ তার।
- বৌদি আপনি বেশি কথা বলবেন না। এই মুহূর্তে আপনার বেশি কথা বলা বারণ। কারণ, আপনি উত্তেজিত হলে সিচুয়েশন খারাপ হতে পারে।
- আর কি খারাপ হবে। আমি তো সুস্থ। শুধু ওই মানুষটা-
- ও দুই একদিনের মধ্যেই চলে আসবে। আপনি চুপ করুন বৌদি।
- চুপ করা ছাড়া আমার আর কি উপায় আছে বলুন। সব থাকলেও, প্রিয় মুখখানা শুধু নেই। কি জানি, কোথায় কি করছে ও।
নার্স ম্যাডামকে ডাক্তার বললেন- আপনি ঠিকমতো ওষুধগুলো খাওয়াবেন। ভালোভাবে যত্ন নেবেন। দেখবেন যেন কোনও অসুবিধে না হয়।
সকালবেলায় ব্রেকফাস্ট সেরে খবরের কাগজটা হাতে নিলেন আনিস রহমান অর্থাৎ শামীমার পিতা।
শিরোনামে বড় বড় অক্ষরে লেখা কিডনি প্রতিস্থাপন করলেন বিখ্যাত নেফ্রলজিস্ট বিশ্বজিৎ রায়। খবরটি বেশ কয়েকবার পড়লেন তিনি এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মেয়ে শামীমার কাছে এসে পৌঁছলেন। বেডের পাশে দাঁড়িয়ে অশ্রু সজল নেত্রে শামীমাকে বললেন-জামাইয়ের কাছে আমি হেরে গেলাম মা। ছেলেটা এত বড় মন নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে আমার কৃপণ মন তা অনুভবই করতে পারেনি। অর্থের অহংকার আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। আজ আমার চোখ খুলে গেছে মা, চোখ খুলে গেছে। ও অনেক আগেই আমার শ্রেষ্ঠ জামাই প্রমান করে দিয়েছে। আজ আমার ইচ্ছে হচ্ছে ওকে একটা প্রণাম করি। আমার অহংকারকে সে চূর্ণ করে দিয়েছে। ও কোথায় মা, বল আমাকে। তাড়াতাড়ি বল মা, ওর কাছে যে আমাকে যেতেই হবে। একখণ্ড মাংসের বিনিময়ে যে তোর প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে তাকে তো একবার দেখতেই হবে মা।
ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে আমান আনিস রহমানকে বললেন- স্যার আপনি একটু বাইরে আসুন।
পিতার কথা শুনে শামীমা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন এবং বললেন- আমান ভাই দাঁড়ান, আমাকে কিছু তো একটা লুকোচ্ছেন আপনারা। আমার আব্বা এসব কি বলছেন? একখন্ড মাংস দান, এসব কি কথা?
- দিদি তুমি শান্ত হও। তোমাকে পরে সব খুলে বলব।
- না, যা বলার তুমি আমাকে এখনই বল। সত্যি করে বল, শামীম কোথায়?
আনিস রহমান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। চোখের ইশারায় আমান আনিস রহমানকে বাইরে আসার জন্য বললেন। আনিস রাজি হলেন না। তিনি ব্যাপারটা কিছুটা উপলব্ধি করে বললেন- সত্যটা প্রকাশ করাই ভালো।
তাঁর কথায় আমান রাজি হয়ে সমস্ত ঘটনা শামিমাকে খুলে বললেন। শামীমা উত্তেজিত হলেন না, বরং শান্তভাবেই বললেন- যেমন করে পারো আমাকে শামীমের কাছে নিয়ে চলো।
- আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে দেখছি স্ট্রেচার সহ আনা যায় কিনা।
ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে শেষ পর্যন্ত শামীমকে শামীমার বেডের পাশে আনা হল। চক্ষু বিনিময় হতেই শামীমা অঝোর নয়নে কান্না করতে লাগলো। শামীমের চোখ দিয়ে অবিরাম জল গড়ে পড়ছে।
- এ কি করলে তুমি! ঐ একখণ্ড মাংস উপড়ে আমার শরীরে ঢুকিয়ে দিলে। তোমার কি কোনও যন্ত্রণা হচ্ছে না!
- এতদিন তুমি যে যন্ত্রনা সহ্য করেছ সেই যন্ত্রণার কাছে আমার এই সামান্য যন্ত্রণা সামান্য আঘাত মাত্র। যদি কখনো আমার হৃদপিণ্ড উপড়ে দেওয়ার সুযোগ করে দেন আল্লাহ তোমার জন্য, সেটা দিতেও রাজি আছি। শুধু তোমাকে একটা কথা বলি, তুমি উত্তেজিত হয়ো না, কান্না করো না। বরং মন থেকে হাসো, আনন্দ কর যেন আমরা নতুন জীবনে আশার আলো দেখতে পাই এবং সুখ যেন আমাদের কখনো ছেড়ে না যায়। - যত তাড়াতাড়ি পারো আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো।
- তুমি দেখছি ভেঙ্গে পড়ছো। হসপিটালের একটা নিয়ম কানুন আছে। আর একদিন পরেই আমি ছুটি পেয়ে যাব। তারপর তোমার কাছে এসেই বসে থাকব। সাত দিনের মধ্যেই আমরা সবাই বাড়ি চলে যাব। হতাস হয়োনা লক্ষ্মীটি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার দেবাশীষ রায় রাউন্ডে এলেন। আমানকে ইশারা করে বললেন- শামীমকে ওর বেডে নিয়ে যান। বৌদিকে এক্সাইটেড করা যাবে না। এতে ওর ক্ষতি হতে পারে।
দিন সাতেক পরে শামীমা, শামীম, আমান ও আনিস রহমান বাড়ি ফিরলেন।
- মা আমাকে তোর বাড়িতে থাকতে দিবি না। তোদের সুখ দেখে আমার খুব হিংসে হচ্ছে। এখানে যে এত সুখ আছে তা আমি ঢোকা মাত্রই অনুভব করতে পেরেছি। তুই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর আমি বাড়ি গিয়ে ওই দুই মেয়ের সম্পত্তি ভাগাভাগি করে দিয়ে বাকিটা সম্পূর্ণ তোর জন্য নিয়ে আসবো। এখান থেকে আমি আর বাড়ি যাব না মা। অর্থের অহংকার আমাকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল। তাই আমার সব থেকে মহান জামাইটিকে আমি চিনতে পারিনি।
- বাবা তোমার কোনও কিছুরই আমাদের দরকার নেই। শুধু তুমি আমাদের পাশে থাকো। অর্থ সম্পত্তি আমরা কিছু চাই না।
- তোদের ভালোবাসায় এবং শ্রদ্ধায় আমার সমস্ত অহংকার বিলীন হয়ে যাক তোদের পাশে থেকে আমি এটাই চাই।
- তোমার ভালোটা তুমি বুঝে নাও বাবা। এতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই।
ঘরের ভেতর প্রবেশ করে কিছুক্ষণ পরে একটা কাপড়ের থলে নিয়ে শামীম বেরিয়ে এল। আমানের হাতে দিয়ে বলল- দ্যাখ তো গুনে কত টাকা আছে।
আমান গুনে বলল- আট হাজার চারশো কুড়ি টাকা আছে।
- এই টাকা তুই নে। কারণ আমার স্ত্রীকে কারও কাছে আমি ঋণী থাকতে দেবো না।
- কিন্তু হঠাৎ করে তুই এত টাকা কোথায় পেলি।
- অনেকদিন আগে থেকেই তোর দিদি আমাকে মাঝে মাঝেই বলত এইট ফোর টু জিরো ব্যাপারটা নিয়ে তোমার কোনও চিন্তা ভাবনা আছে কি। তখন আমি ভাবতাম এটা গণিতের কোনও অংক নয়। এটা টাকার অংক। তখন থেকে আমি তোর দিদির অগোচরে একটু একটু করে টাকা জমাতে শুরু করেছিলাম। তোর দিদিকে অপারেশনের দিন যাওয়ার আগে টাকাটা গুনে দেখলাম আট হাজার চারশো কুড়ি টাকা হয়ে গেছে। অর্থাৎ এইট ফোর টু জিরো টাকার অংকটা মিলে গেছে। আজ থেকে আমি এইট ফোর টু জিরো মুক্ত। নাও আই এম ফ্রি ফ্রম এইট ফোর টু জিরো।
( সমাপ্ত )
গ্রাম : ফুলশহরী, ডাকঘর : রমনা শেখদীখি, জেলা: মুর্শিদাবাদ, পিন কোড: ৭৪২২২৭

