গল্প - তোমার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছি, কলমে - এস এম মঈনুল হক
তোমার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছি
এস এম মঈনুল হক
শীতের সকাল। কুয়াশার পাতলা চাদরে ঢাকা কলকাতার এক পুরানো পাড়া। রাস্তার ধারে শিশির ভেজা পাতা আর দূর থেকে ভেসে আসা হকারের ডাক। অনিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল। তার হাতে একটি পুরানো চিঠি, হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজে কালির ছাপ এখনও স্পষ্ট। চিঠির প্রতিটি শব্দ যেন তার বুকের ভেতর একটা ভাঙা সেতারের তারে ঝংকার তুলছে।
চিঠিটা সে পেয়েছিল প্রায় দশ বছর আগে। তখন সে কলেজে পড়ত, জীবন ছিল রঙিন, স্বপ্নে ভরা। চিঠিটা এসেছিল অনিকেতের কাছ থেকে। অনিকেত, যার নাম উচ্চারণ করলেই অনিতার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হয়। সেই শূন্যতা সময়ের সঙ্গে আরও গভীর হয়েছে।
চিঠিতে লেখা ছিল:
প্রিয় অনিতা,
তুই হয়তো ভাবছিস, আমি কেন এই চিঠি লিখছি। কিন্তু কিছু কথা মুখে বলা যায় না, লিখে ফেলতে হয়। আমি জানি, আমাদের মধ্যে অনেক কিছু বদলে গেছে। তবু, তোর হাসি, তোর সেই চোখের ভাষা, আমি ভুলতে পারিনি। হয়তো কখনো পারব না। আমি চলে যাচ্ছি, অনিতা। অনেক দূরে। কিন্তু তুই যেখানেই থাক, আমার হৃদয়ের এক কোণে তুই থাকবি।
ভালো থাকিস।
তোর,
অনিকেত
অনিতা চিঠিটা বুকের কাছে চেপে ধরল। তার চোখের কোণে জল জমেছে। এই চিঠি তার জীবনের এক টুকরো, যাকে সে আঁকড়ে ধরে আছে। কিন্তু কেন? অনিকেত তো চলে গেছে। কোনো যোগাযোগ নেই। তবু কেন এই স্মৃতি তাকে ছেড়ে যায় না?
অনিতার জীবন এখন অনেকটা স্থিতিশীল। একটি নামী স্কুলে শিক্ষকতা করে, ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে থাকে। তার বাবা-মা গ্রামের বাড়িতে, আর সে একা শহরে। এই একাকিত্বের মধ্যেও সে কোথাও যেন অনিকেতের ছায়া খুঁজে ফেরে।
কলেজের দিনগুলো মনে পড়ে। ক্যান্টিনে আড্ডা, লাইব্রেরির শান্ত কোণে একসঙ্গে পড়া, বিকেলের আকাশের নীচে দুজনে হেঁটে বেড়ানো। অনিকেত ছিল তার বন্ধু, তার সঙ্গী, আর হয়তো তার থেকেও বেশি কিছু। কিন্তু সেই সম্পর্ক কখনো নাম পায়নি। এক অদ্ভুত টানাপোড়েনের মধ্যে তারা দুজনেই হারিয়ে গিয়েছিল।
একদিন, কলেজের শেষ বছরে, অনিকেত হঠাৎ বলেছিল, “অনিতা, আমি চলে যাচ্ছি। আমেরিকায়। পড়াশোনার জন্য।” অনিতা হেসে বলেছিল, “ভালোই তো। স্বপ্ন পূরণ করতে যাচ্ছিস। আমি তো খুশি।” কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার বুকটা ভেঙে গিয়েছিল। তারপর সেই চিঠি। আর তারপর নীরবতা।
অনিতা ভাবে, হয়তো এটা তার নিজের দোষ। সে কখনো অনিকেতকে বলেনি, তার মনে কী চলছে। সে ভেবেছিল, সময় সব ঠিক করে দেবে। কিন্তু সময় শুধু দূরত্ব বাড়িয়েছে।
এক বিকেলে, অনিতা তার প্রিয় বইয়ের দোকানে গিয়েছিল। পুরানো বইয়ের গন্ধ, কাঠের তাক, আর নিস্তব্ধ পরিবেশ তাকে শান্তি দেয়। সে একটা বই নিয়ে পড়ছিল, হঠাৎ কানে এলো একটা পরিচিত কণ্ঠ।
“অনিতা?”
সে মুখ তুলে তাকাল। তার সামনে দাঁড়িয়ে অনিকেত। দশ বছর পর। চুলে হালকা পাক ধরেছে, চোখে একটা অদ্ভুত গভীরতা। কিন্তু হাসিটা একই রকম। সেই হাসি, যেটা অনিতার বুকের ভেতর ঝড় তুলত।
“অনি?” অনিতার গলা কেঁপে গেল।
“হ্যাঁ, আমি।” অনিকেত হাসল। “কতদিন পর দেখা। কেমন আছিস?”
অনিতা কী বলবে বুঝতে পারছিল না। তার মনে হাজারো প্রশ্ন জমে আছে, কিন্তু মুখ দিয়ে শুধু বেরোল, “ভালো। তুই?”
“ভালো। কিছুদিনের জন্য কলকাতায় এসেছি।” অনিকেত বলল। “চল, কোথাও বসে কথা বলি?”
অনিতা মাথা নাড়ল। তার মনে হচ্ছিল, সে স্বপ্ন দেখছে।
কাছের একটা ক্যাফেতে তারা বসল। কফির কাপের ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে অনিকেত বলতে শুরু করল। সে আমেরিকায় একটা বড় কোম্পানিতে কাজ করে। জীবন ভালোই কাটছে। কিন্তু তার কথার মধ্যে একটা অস্থিরতা ছিল। যেন কিছু বলতে চায়, কিন্তু পারছে না।
“তোর কথা মনে পড়ত, অনিতা,” হঠাৎ সে বলল। “অনেকবার।”
অনিতার বুকটা ধক করে উঠল। “তাহলে যোগাযোগ করিসনি কেন?”
অনিকেত চুপ করে গেল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, তুই হয়তো এগিয়ে গেছিস। আমি তোর জীবনে আর ফিরে আসার কেউ নই।”
অনিতার চোখে জল এসে গেল। “আর আমি? আমি কি তোকে ভুলতে পেরেছি? তুই জানিস, আমি এখনো সেই চিঠি সঙ্গে রাখি?”
অনিকেত অবাক হয়ে তাকাল। “তুই... তুই এখনো...”
“হ্যাঁ, অনি। আমি তোমার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছি।” অনিতার গলা ভারী হয়ে এল।
সেই বিকেলের পর থেকে তারা প্রায়ই দেখা করতে শুরু করল। পুরানো স্মৃতি ফিরে আসছিল, কিন্তু সঙ্গে নতুন আশাও। অনিকেত বলল, সে কলকাতায় ফিরে আসার কথা ভাবছে। তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল অনিতাকে ছেড়ে চলে যাওয়া।
একদিন, গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে অনিতা বলল, “অনি, আমরা কি সত্যিই আবার শুরু করতে পারব?”
অনিকেত তার হাত ধরল। “আমরা চেষ্টা করব, অনিতা। এবার আর কিছু হারাতে দেব না।”
অনিতা হাসল। তার বুকের ভেতর সেই শূন্যতা আর ছিল না। সে জানত, এবার তারা একসঙ্গে এগিয়ে যাবে।