গল্প - ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল, লেখক - এস এম মঈনুল হক
ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল
এস এম মঈনুল হক
আব্বু, আপনাকে একটা কথা বলব?
- বলো।
- আমাদের হোস্টেলে আমার ছাড়া আর কারো কিপ্যাড মোবাইল নেই। তাই বলছিলাম একটা এন্ড্রয়েড মোবাইল যদি কিনে দিতেন তাহলে আমার খুব ভালো হতো।
- মারে, আমি তো একটা প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা করে মাত্র ৬০০০ টাকা সাম্মানিক পায়। এতে তোর খরচ চালাতে হয়, সংসার চালাতে হয়। মাসের শেষে তো কিছুই থাকে না। কেমন করে তোকে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল কিনে দিই বল।
- ইমোশনালি আমি কোনও আঘাত দিতে চাইনি আপনাকে আব্বু। আমি জানি আব্বু, আপনার কাছে যদি সত্যিই টাকা পয়সা থাকতো তাহলে কষ্ট করেও আমাকে আপনি মোবাইল কিনে দিতেন। আপনাকে আমি খুব কষ্ট দিলাম। আর কোনোদিন মোবাইলের কথা আপনাকে বলব না।
- না মা, তুই কোন ভুল করিস নি। এটাতো আমার একটা অভিশাপ। দারিদ্রতার অভিশাপ। তোর মোবাইলের ব্যবস্থা আমি করব মা, ঠিক করব। কিছু টিউশ্যন ব্যাচ জোগাড় করে আমি একটু বেশি সময় দিয়ে পড়িয়ে টাকা রোজগার করে ইনশাল্লাহ তোকে মোবাইল কিনে দেব। আমাকে একটু খানি সময় দে মা।
- আমার দুটো মামা তো দেশের বাইরে চাকরি করে। তাদের কাছে কি চাইবো আব্বু? আপনি এমনিতেই অসুস্থ। তার উপর আবার টিউশন ব্যাচ জোগাড় করে পড়াশোনা করলে তো আপনার স্বাস্থ্য আরো ভেঙে যাবে।
- দেখো, তোমার মামারা কি বলে।
- এবার ফোন করলে সোহেল মামাকে ব্যাপারটা খুলে বলবো। মামার তো অনেক রোজগার। তিনি ইচ্ছে করলেই একটা মোবাইল অবশ্যই দিতে পারবেন।
- দেখো, দিলে তো ভালই হয়।
- হ্যাঁ আব্বু, আমি তো আর পরের কাছে চাইছি না। নিজের মামার কাছেই তো চাইবো।
- দিবে তো, আমার তো কেমন মনে হচ্ছে। তবুও একবার চেষ্টা করে দেখো। কালকে হোস্টেল যাবে তো।
- কালকে না আব্বু। আজকে বিকেলেই হোস্টেলে যেতে হবে। কালকে ফার্স্ট পিরিয়ডে ফিলোসফি ম্যামের ক্লাস আছে। তিনি আবার ক্লাস অফ করা পছন্দ করেন না। ক্লাসে প্রেজেন্ট থাকতেই হবে।
- ঠিক আছে, তোমার আম্মুর কাছ থেকে এ মাসের টাকাটা নিয়ে নিও।
তিন মাস পরে সাদিয়া হোস্টেল থেকে এসে তার আব্বুকে বলল- মামা মোবাইল দেবো বলেছে। আর একমাস পরে মামা বাড়ি আসবেন। তখন তিনি ওখান থেকে মোবাইল কিনে নিয়ে আসবেন।
- যাক মা শুনে খুব ভালো লাগলো। অন্ততপক্ষে তোমার একটা সমস্যার সমাধান তো হবে।
সাব্বির সাহেবের মনে কেমন যেন একটা অসম্ভব ব্যাপার মনে হল এই মোবাইলের ব্যাপারটা নিয়ে। কারণ তিনি তার ছোট শ্যালককে ভালোভাবেই চেনেন এবং জানেন। সে মোবাইল দেবে তার ভাগ্নিকে এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না সাব্বির সাহেব। সাদিয়ার সঙ্গে সে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করছে না তো। কি জানি একটা মাস গেলেই বুঝতে পারবো। সাদিয়া এমনিতেই খুব সহজ সরল মেয়ে। মামাদের প্রতি তার আকর্ষণ একটু বেশি। এমনি করে আর একটা মাসও কেটে গেল। হঠাৎ একটা ফোন এলো সাদিয়ার ফোনে।
- হ্যালো সাদিয়া, বলছি ফোনটা কি আমি এখানেই কিনে নেব, না মুম্বাই গিয়ে কিনব?
- আপনি যেটা ভালো বুঝবেন মামা।
- ঠিক আছে তাহলে আমি মুম্বাইয়ে কিনে নেব।
আট দশ ঘন্টা পরে আবার ফোন এলো- হ্যালো সাদিয়া, বলছি কি মুম্বাইয়ে খুব বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। এক ঘন্টা পরেই কলকাতার প্লেন ছাড়বে।আমি কলকাতায় গিয়ে ফোনটা নিয়ে নেব।
- আপনি যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই করবেন মামা। বাড়িতে আমি ফোন পেলেই হল।
সাদিয়ার আনন্দ ধরে না। আনন্দে ভরপুর। অ্যান্ড্রয়েড ফোন হাতে পাবে এটা যেন তার একটা চরম পাওয়া। সে আনন্দে এবং কিছুটা আবেগে রাতের খাবারও খেলো না। বারবার মাকে এবং বাবাকে শোনাতে থাকে আমার ফোন আসছে, আমার ফোন আসছে, আমার ফোন আছে, আমি নতুন ফোন পাবো। মামা বলেছে কালকে আমাকে ফোন দেবে। দুদিন পরে ওর মামা আমাদের বাড়িতে এলো। মামাকে দেখে সাদিয়া আনন্দে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল। এবার ফোন পাবে সে এই ভেবে। কিছুক্ষণ পর মামা বলল- কিছু মনে করিস না ভাগ্নি, তোকে এবার আর ফোন দেওয়া হলো না আমার। কিছু দেনা ছিল সেগুলো মেটাতে গিয়ে আমার কাছে আর যথেষ্ট টাকা নেই। তবে তুই ভেঙ্গে পড়িস না। দুমাস পরে তো আবার আমি চলে যাব। ওখান থেকে তোকে পার্সেল করে পাঠিয়ে দেবো।
তার বাবার মত সাদিয়াও অনুভব করতে পারল যে এই মামা কোনোদিনই তাকে ফোন দেবে না, শুধুই ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করছে।
সাব্বির সাহেবের প্রাইভেট স্কুলে কালকে রেজাল্ট হয়েছে। আজকে স্কুল যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই স্কুলের মালিক পিওনকে দিয়ে তার ঘরে ডেকে পাঠালেন সাব্বির সাহেবকে।
- আমাদের টি আই সির মুখ থেকে আপনার সম্পর্কে অনেক কিছুই শুনলাম। হান্ড্রেড আউট অফ হান্ড্রেড পেয়েছে আটটি ছেলেমেয়ে। আর এদের কারিগর নাকি আপনি। ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে আমি ফিডব্যাক নিয়ে জানতে পেরেছি, ম্যাথ সাবজেক্টে আপনি তাদেরকে খুবই ভালো পড়ান। এর আগে এত ভালো রেজাল্টস্ আমার স্কুলে কোনো দিন হয়নি। তাই আজ আপনাকে আমি একটা উপহার দিতে চাই। আপনি না করবেন না। শুনেছি আপনি কি প্যাড মোবাইল ব্যবহার করেন। তাই রিয়াল মি কোম্পানির একটা এন্ড্রয়েড মোবাইল আমি কিনে এনেছি আপনার জন্য। এই নিন এটা বাড়ির জন্য ব্যবহার করবেন।
- এসবের কি দরকার ছিল বলুন।
- না, এটা দরকার আছে। আপনার মত স্যারেদের জন্য আমরা কিছু করতে পারলে খুবই খুশি হব। আপনি এখন আমার স্কুলের গর্ব। আর হ্যাঁ, আপনার সাম্মানিক ছয় হাজার টাকা ছিল। আমি এই বছর থেকে আপনাকে আরো দুই হাজার বাড়িয়ে আট হাজার টাকা করে দেব।
সাব্বির সাহেবের চক্ষু হতে ঝর ঝর করে অশ্রু বন্যা বইতে লাগলো।
- আপনি কান্না করছেন।
- না স্যার, এ কান্না সে কান্না নয়। এ চরম আনন্দের কান্না। যে কান্না আমি জীবনে প্রথমবারই কাদলাম।
- আজ থেকে আপনি আমাকে আর কখনো স্যার বলে ডাকবেন না। আর আপনিও বলবেন না। এটা আমার অনুরোধ। আমি আপনার ছেলের মত।
- ঠিক আছে বাবা, আর কখনো তোমাকে আপনি বলে সম্বোধন করব না। সত্যিই তো তুমি আমার ছেলে।
- দুপুরের খাবার খেয়ে আজ আপনি সোজা বাড়ি চলে যাবেন। আজকে আপনার ছুটি।
- তাহলে আসি বাবা।
- হ্যাঁ আসুন।
সাদিয়া বাড়িতেই ছিল। কাল সে হোস্টেলে যাবে। দুপুরের খাওয়া সেরে সাব্বির সাহেব খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এলেন। আনন্দ ও অনেকটা আবেগে তার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিল না। সাদিয়াকে বুকে টেনে নিয়ে অশ্রুছল নেত্রে তার হাতে এন্ড্রয়েড মোবাইলটা দিয়ে বলল- দেখ তো মা, তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা।
সাদিয়া খাপটা খুলে অবাক হয়ে বলল- এ আপনি কোথায় পেলেন আব্বু!
তারপর তিনি সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন।সাদিয়ার মা উপরের দিকে হাত প্রসারিত করে বললেন হে মহান আল্লাহ, যার কেউ নেই তার আপনি আছেন। স্কুলের ওই মালিককে আপনি মহা সম্মানে সম্মানিত করিয়েন।