গল্প - অপরের দান মানুষকে কর্মহীন করে, গল্প - এস এম মঈনুল হক
অপরের দান মানুষকে কর্মহীন করে
এস এম মঈনুল হক
রাতের আকাশে তারারা ঝিকমিক করছে। কলকাতার একটি ছোট্ট বস্তির ঘরে, একটা পুরনো কাঠের টেবিলের উপর একটি মোমবাতি জ্বলছে। তার মৃদু আলোয় জিসানের মুখটা আবছা দেখা যাচ্ছে। তার হাতে একটা পুরনো মোবাইল ফোন, যার স্ক্রিনে একটা মেসেজ ভেসে উঠেছে। মেসেজটা এসেছে জিনাত নামের একটি মেয়ের কাছ থেকে, যাকে সে প্রায় দশ বছর পর আবার দেখছে—অবশ্য শুধু ডিজিটাল অক্ষরের মাধ্যমে।
“জিসান, তুমি কেমন আছ? তোমার কি কোনো অর্থ বা সাহায্যের দরকার আছে?”
মেসেজটা পড়ে জিসানের হাত কেঁপে উঠল। জিনাত! তার কলেজের প্রথম ভালোবাসা। সেই জিনাত, যে দশ বছর আগে একটা স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় চলে গিয়েছিল। তখন তাদের সম্পর্কটা ছিল কচি, স্বপ্নময়। তারা একসঙ্গে কলেজের বটতলায় বসে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখত—জিনাত ডাক্তার হবে, জিসান একটা ছোট ব্যবসা শুরু করবে। কিন্তু দূরত্ব আর সময়ের ঘূর্ণিতে সেই সম্পর্ক ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়েছিল। জিসান ভেবেছিল, জিনাত তাকে ভুলে গেছে। কিন্তু আজ, এত বছর পর, এই মেসেজ?
জিসানের জীবনটা তখন থেকে অনেক বদলে গেছে। একটা ছোটখাটো ফ্যাক্টরির চাকরি ছিল তার, কিন্তু সেটা হারিয়ে সে এখন রিকশা চালায়। তার স্ত্রী নাসিরা আর দুটো ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে তার সংসার। দারিদ্র্য তাকে পিছু ছাড়েনি। কখনো কখনো দিনের শেষে পকেটে মাত্র কয়েকটা টাকা থাকে। বাচ্চাদের স্কুলের ফি, ওষুধের খরচ, ঘরের ভাড়া—সব মিলিয়ে জীবনটা একটা দড়ি দিয়ে বাঁধা পড়ে আছে। জিনাতের মেসেজটা তাই তার কাছে একটা অপ্রত্যাশিত আশার আলোর মতো এলো।
জিসান দ্বিধায় পড়ল। জিনাতের কাছে সাহায্য চাওয়া কি ঠিক হবে? তার মন বলল, না। তার আত্মসম্মান তাকে বাধা দিচ্ছিল। কিন্তু তারপর নাসিরার কথা মনে পড়ল—তার বড় মেয়ে রিয়ার স্কুলের ফি বাকি, ছেলে আরিফের জন্য নতুন জুতো কেনার টাকা নেই। সে একটা ছোট্ট মেসেজ লিখল: “জিনাত, আমি ঠিক আছি। তবে… হ্যাঁ, একটু সাহায্যের দরকার।”
কয়েক দিন পরেই জিনাত ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাল। প্রথমে ছিল পঞ্চাশ হাজার। জিসানের চোখ কপালে উঠল। এত টাকা! সে তাড়াতাড়ি নাসিরাকে ডেকে দেখাল। নাসিরা প্রথমে খুশি হলেও, তার মুখে একটা ছায়া পড়ল। “এই টাকা কার কাছ থেকে এলো, জিসান? তুমি কিছু লুকোচ্ছ না তো?”
জিসান সব খুলে বলল। জিনাতের কথা, তাদের পুরনো সম্পর্কের কথা, কলেজের দিনগুলো। নাসিরা চুপ করে শুনল। তার চোখে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি। “ঠিক আছে,” সে বলল, “কিন্তু এটা যেন শুধু সাহায্য হয়। এর বেশি কিছু নয়। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, জিসান।”
জিসান মাথা নাড়ল। কিন্তু তার মনের কোণে একটা অস্থিরতা জন্ম নিল। জিনাত কেন তাকে এত টাকা পাঠাল? সে কি তাকে এখনো ভালোবাসে? নাকি এটা কেবল দয়া? সে জিনাতের সঙ্গে আরো কথা বলতে চাইল। কিন্তু জিনাতের উত্তর ছিল সংক্ষিপ্ত, আনুষ্ঠানিক। “তুমি ভালো থাকো, জিসান। আর দরকার হলে জানিও।”
মাসের পর মাস যেতে লাগল। জিনাত প্রতি মাসে টাকা পাঠাতে লাগল। কখনো ত্রিশ হাজার, কখনো পঞ্চাশ। জিসানের জীবনটা একটু একটু করে বদলাতে লাগল। সে রিকশা চালানো কমিয়ে দিল। বাচ্চাদের স্কুলের ফি, নতুন জামাকাপড়, ঘরের মেরামত—সবই সম্ভব হচ্ছিল জিনাতের টাকায়। রিয়া আর আরিফের মুখে হাসি ফিরল। নাসিরা বাজার থেকে ভালো মাছ কিনে রান্না করতে লাগল। কিন্তু এই স্বাচ্ছন্দ্যের মাঝে জিসানের মনের অস্থিরতা বাড়তে লাগল।
নাসিরা এই পরিবর্তন লক্ষ করছিল। একদিন রাতে, যখন বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে, নাসিরা জিসানের সামনে বসল। “জিসান, তুমি কি লক্ষ করেছ, তুমি আর আগের মতো পরিশ্রম করছ না? তুমি এই মেয়ের টাকার উপর ভরসা করে বসে আছ। এটা কি ঠিক?”
জিসান রেগে গেল। “আমি কি চুরি করছি? সে নিজে থেকে টাকা পাঠাচ্ছে। আমি তো তাকে জোর করিনি!”
“কিন্তু তুমি নিজেকে হারাচ্ছ, জিসান। তুমি আর চেষ্টা করছ না। তুমি ভিক্ষুকের মতো বাঁচছ।” নাসিরার কথায় জিসানের মুখ লাল হয়ে গেল। সে কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। নাসিরার কথাগুলো তার মনে গেঁথে গেল।
কয়েক মাস পর, জিনাত দেশে এল। জিসানের মন আবার অস্থির হয়ে উঠল। সে জিনাতের সঙ্গে দেখা করতে চাইল। সে ভাবল, হয়তো একবার দেখা হলে তার মনের প্রশ্নগুলোর উত্তর মিলবে। কিন্তু জিনাত তাকে এড়িয়ে গেল। একটা মেসেজ পাঠাল: “জিসান, আমি ব্যস্ত। এবার দেখা হবে না।” জিসানের মনে একটা তীব্র যন্ত্রণা জাগল। জিনাত কি তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে? নাকি তার জীবনে অন্য কেউ আছে?
একদিন সকালে, জিসান ব্যাংকে গেল। জিনাতের পাঠানো টাকার একটা বড় অংশ তখনো তার অ্যাকাউন্টে পড়ে ছিল। সে সিদ্ধান্ত নিল। সে আর এই টাকা নেবে না। তার আত্মসম্মান তাকে আর অন্যের দয়ার উপর বাঁচতে দেবে না। সে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকাগুলো ফেরত পাঠিয়ে দিল। একটা মেসেজ লিখল: “জিনাত, তোমার সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি আর এটা নিতে পারছি না। আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।”
জিনাত কয়েকদিন পর উত্তর দিল। একটা লম্বা মেসেজ। “জিসান, আমি তোমাকে আগের মতোই ভালোবাসি। কিন্তু আমার জীবন এখন অন্যরকম। আমার স্বামী, আমার পরিবার আছে। আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারি না, কারণ আমি আমার স্বামীর প্রতি সৎ থাকতে চাই। এই টাকা আমি তোমাকে দিয়েছি আমার মন থেকে, কোনো প্রত্যাশা ছাড়া। এটা আমার পবিত্র দান। দয়া করে ফেরত দিও না।”
জিসান মেসেজটা পড়ে চুপ করে বসে রইল। তার চোখে জল এলো। জিনাতের ভালোবাসা ছিল সত্যি, কিন্তু সেটা এখন অন্যরকম। সে উঠে দাঁড়াল। নাসিরার কাছে গিয়ে বলল, “তুমি ঠিক ছিলে। আমি আর এভাবে বাঁচব না।”
জিসান আবার রিকশা চালানো শুরু করল। ধীরে ধীরে সে একটা ছোট মুদির দোকান খুলল। প্রথমে ছোট ছিল, কিন্তু তার পরিশ্রম আর নাসিরার সমর্থনে দোকানটা বড় হতে লাগল। জিসানের জীবনে আবার আত্মবিশ্বাস ফিরে এলো। জিনাতের দান তাকে বাঁচিয়েছিল, কিন্তু তার নিজের পরিশ্রম তাকে আবার জীবনের পথে ফিরিয়ে আনল।