গল্প - সন্দেহের অবসান, লেখক - এস এম মঈনুল হক
সন্দেহের অবসান
এস এম মঈনুল হক
শহরের প্রান্তে পুরনো বাড়ি, যার ছাদে শ্যাওলা, দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে। সেই বাড়ির ভেতর থাকে রঞ্জনা।
বয়স পঁইত্রিশ, গৃহবধূ, দুটি সন্তান, স্বামী সিদ্ধার্থ—সবকিছু আছে, তবু মনে সর্বদা এক অদৃশ্য শূন্যতার ছায়া।
ভোরবেলা উঠে চা বানাতে বানাতে রঞ্জনা জানালার বাইরে তাকায়। গলির একপাশে স্কুলের বাচ্চারা ছুটে যাচ্ছে, অন্যপাশে ফুলওয়ালা হেঁটে যাচ্ছে। সে হঠাৎ ভাবে, “এতসব কোলাহলের মধ্যে আমি কোথায়?”
রঞ্জনা সবকিছুই করে ঠিকঠাক—সকালে স্বামীকে অফিসের জন্য রেডি করে, ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায়, বাজার করে, দুপুরে রান্না করে, বিকেলে সন্তানদের পড়ায়। কিন্তু নিজের জন্য কিছুই করে না। এমনকি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখারও সময় পায় না।
একদিন দুপুরে সে চুপচাপ বসে মনে মনে ভাবে, “কলেজে পড়ার সময় আমি কত স্বপ্ন দেখতাম! কবি হব, গল্প লিখব, সাহিত্যিক হব… সেই মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেল?”
সিদ্ধার্থ বড় কর্পোরেট অফিসে কাজ করে। সকালে যায়, রাতে ফেরে ক্লান্ত মুখে। দু-একটা কথার পরে ফোন, ল্যাপটপ, মিটিং, ক্লায়েন্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
রঞ্জনা একদিন বলল, “শোনো, তুমি তো অফিস থেকে ফিরেও কাজ নিয়ে বসে যাচ্ছ… আমার সঙ্গে কিছু কথা বলবে না?”
সিদ্ধার্থ মাথা না তুলেই বলল, “তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় আমার কোথায়?”
এই কথাটা বুকের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধে রইল রঞ্জনার।
রাতের খাবার টেবিলে চারজন বসে—দুই সন্তান, মা, বাবা। ছেলেমেয়েরা মায়ের গল্প শুনতে চায়, কিন্তু মা নিজেই আজকাল কেমন নিঃশব্দ। স্বামী মুখ গুঁজে খায়, কথাই বলে না। রঞ্জনা ভেতরে ভেতরে আরও একা হয়ে যায়।
একদিন হঠাৎ শ্যামলীর ফোন এল। শ্যামলী, কলেজের বান্ধবী, অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না।
— “রে রঞ্জনা! কতদিন পরে কথা বলছি! তুই কেমন আছিস?”
— “ভালো… মানে, আছি…”
— “কাল আমাদের কলেজের রিইউনিয়ন পার্টি, তুই আসবি? সবাই আসছে!”
রঞ্জনা প্রথমে দ্বিধায় পড়ে গেল। কত বছর পরে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে! সাহস হবে কি? আবার ইচ্ছে হচ্ছে একবার নিজের পুরোনো সত্তাকে ছুঁয়ে দেখতে।
সিদ্ধার্থের কাছে সে বলল, “কাল রাতে কলেজের রিইউনিয়ন আছে, যেতে পারি?”
সিদ্ধার্থ কেবল মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, যাও।”
কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো কৌতূহল নেই, কোনো উচ্ছ্বাস নেই।
সেই রাতে রঞ্জনা শাড়ি পরল, হালকা মেকআপ করল, আয়নার সামনে নিজেকে দেখে চমকে গেল। এই কি সে? সেই কলেজের রঞ্জনা যেন এক মুহূর্তের জন্য ফিরে এসেছে।
পার্টি হল আলোকোজ্জ্বল। বন্ধুদের হাসি, স্মৃতিচারণ, গান, আড্ডায় ভরা।
সেখানে দেখা হল অমিতের সঙ্গে। অমিত, কলেজের অন্যতম মেধাবী ছাত্র, এখন বড় সাহিত্যিক, পত্রিকার সম্পাদক।
— “রঞ্জনা! কতদিন পরে! তুই তো ছিলি আমাদের কবি!”
— “আহ! কোথায় আর… এখন কেবল সংসারের কবি…”
— “সংসারের কবি? কেন, তোর লেখা তো আমাদের পত্রিকায় ছাপা উচিত!”
রঞ্জনা মৃদু হেসে বলল, “অমিত, তোর মতো মানুষ থাকলে হয়তো আবার শুরু করতে পারি…”
অমিতের সঙ্গে সেই রাতে অনেকক্ষণ কথা হল—সাহিত্য, পুরোনো কবিতা, হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন নিয়ে। রঞ্জনা মনে মনে অনুভব করল, কোনো এক দীর্ঘদিনের বন্ধ দরজা যেন হঠাৎ খুলে গেছে।
এরপর থেকে রঞ্জনা দিনে-দুপুরে সময় পেলেই কাগজ-কলম নিয়ে বসে। প্রথমে কেবল পুরোনো কবিতাগুলো পড়ে, পরে নতুন করে লিখতে শুরু করে। অমিত ফোনে বা মেসেজে বলত, “তোর লেখা অসাধারণ! আমাদের পত্রিকায় লিখে দে!”
রঞ্জনার ভিতরে এক নতুন স্পন্দন জেগে উঠল।
একদিন বিকেলে সে বারান্দায় বসে লিখছে, অমিত হঠাৎ চলে এল।
— “এই লেখা নিয়ে তোর যা করেছে, আমি হতবাক! তুই জানিস না, কত ভালো তোর কলম!”
রঞ্জনা লজ্জা পেয়ে বলল, “আরে, অত কিছু না… সংসারের মধ্যে এতদিন এসব ভুলেই গিয়েছিলাম।”
— “সংসার তো তোর সব নয়, রঞ্জনা। তোর ভেতরের মানুষটাকে মরতে দিস না।”
রঞ্জনা চুপ করে রইল, কিন্তু মনে মনে জানে, সে নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছে।
একদিন সিদ্ধার্থ হঠাৎ রঞ্জনার ফোনে অমিতের মেসেজ দেখে ফেলে।
— “এই অমিত কে?”
— “আমার কলেজের বন্ধু… সাহিত্যিক…”
— “তুমি আমাকে বলোনি!”
রঞ্জনা বলল, “তোমার সঙ্গে কী কিছু শেয়ার করার জায়গা আছে? তুমি কি কখনও জানতে চেয়েছ আমি কী ভাবি?”
সিদ্ধার্থ চুপ করে চলে গেল, কিন্তু তার চোখে সন্দেহের ছায়া ফুটে উঠল।
এরপর থেকে রঞ্জনার মনে ভয়, দ্বন্দ্ব, আর অপরাধবোধ ঘিরে ধরল। সে কী ভুল করছে? সংসার আর স্বপ্ন কি পাশাপাশি থাকতে পারে না?
একদিন রাতে রঞ্জনা আর সিদ্ধার্থ মুখোমুখি বসে।
— “তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাও?” সিদ্ধার্থ সরাসরি প্রশ্ন করে।
রঞ্জনা ধীরে ধীরে বলল, “আমি যেতে চাই না। কিন্তু আমি হারিয়ে যেতে চাই না। তুমি কি একবারও বোঝার চেষ্টা করেছ, আমি কী চাই?”
সিদ্ধার্থ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি নিজেও জানি না, আমি কোথায় আছি… সংসারের চাপে, কাজের চাপে…”
রঞ্জনা বুঝল, তাদের তাসের ঘরের মতো সংসার আসলে ভাঙতে বসেছে, কিন্তু হয়তো এখনো কিছুটা সামলানো সম্ভব।
এক সকালে রঞ্জনা জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখে, নতুন দিনের আলো ফুটছে, পাখিরা ডাকছে। তার মনে হয়, জীবনটা হয়তো একইসঙ্গে ভাঙনের আর গড়ার গল্প।
সে ঠিক করে, অমিতের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব থাকবে, কিন্তু সীমার মধ্যে। নিজের লেখা সে চালিয়ে যাবে, নিজের স্বপ্নকে আর খুন করবে না। সংসারকেও ছেড়ে যাবে না, বরং নতুনভাবে মেরামত করবে, কথা বলবে, বোঝার চেষ্টা করবে।
সন্ধ্যায় যখন সিদ্ধার্থ বাড়ি আসে, রঞ্জনা তার হাতে এক কাপ চা দেয়। সিদ্ধার্থ অবাক হয়ে তাকায়। রঞ্জনা মৃদু হাসে। সিদ্ধার্থও হাসে, সামান্য, দীর্ঘদিন পর।
রঞ্জনা নিজের টেবিলে বসে কাগজে লিখছে। ছেলেমেয়েরা পাশের ঘরে পড়ছে, সিদ্ধার্থ টিভি দেখছে। হ্যাঁ, সংসারের গন্ডির ভেতরেই সে আবার নিজের স্বপ্নের দিকে হাঁটছে।
সে জানে, জীবনটা অনেকটাই তাসের ঘরের মতো—অস্থির, নড়বড়ে, কিন্তু নিজের হাতেই সেটা মেরামত করা যায়। প্রতিদিন সে নিজেকে মনে করায়:
“আমি শুধু মা, স্ত্রী, গৃহিণী নই। আমি একজন মানুষ, একজন স্বপ্ন দেখা মেয়ে, একজন লেখক।”
সে জানে, এবার থেকে সে আর কখনও নিজের সেই সত্তাটাকে হারিয়ে ফেলবে না।