সমবায় ও গ্রামোন্নয়ন - ড. মনোরঞ্জন দাস
সমবায় ও গ্রামোন্নয়ন
ড. মনোরঞ্জন দাস
ঋণ নিতে ব্যাঙ্কের কাছে ছুটতে হবে না স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে। রাজ্যের প্রতিটি পঞ্চায়েতে গড়ে তোলা হচ্ছে একটি করে মহিলা পরিচালিত সমবায় সমিতি। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে ঋণ দেবে তারাই। প্রাথমিক মূলধন হিসাবে প্রতিটি সমবায়কে ৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে। সমবায়গুলিকে এই প্রাথমিক মূলধন যৌথভাবে দেবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। বিভিন্ন জেলা প্রশাসন ইতিমধ্যেই পঞ্চায়েতভিত্তিক সমবায় গঠনের কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে রাজ্য পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতর সূত্রের খবর। একটি কবিতা,
' কাজ করে যাও হাতে হাতে, কাজই জীবন।
সমবায় আছে সাথে, এটা রেখো স্মরণ।
ব্যবস্থা তো আছে অনেক পাবে তুমি ঋণ।
কঠোর শ্রমে মত্ত থেকে নাচো তা ধিন ধিন।।
স্বনির্ভর গোষ্ঠী করো, তাতে করো মজা।
একাকারে ঋদ্ধ হয়েই হবে তুমি রাজা।।
আত্মহিতে, পরিধিতে কর্মই হলো দামী।
এর চেয়ে জগৎ মাঝে, আর কিছু নয় নামী।।
সহজ শর্তে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ তুমি পাবে।
ঋণ শোধে ঋণ নিলে উন্নতিটা হবে।।'২
পঞ্চায়েতে সমবায় গঠনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর। পঞ্চায়েতে ইতিমধ্যেই সমবায় গঠন হয়েছে। তাদের প্রাথমিক মূলধনও দেওয়া হয়েছে। বাকি পঞ্চায়েতগুলিতেও সমবায় গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। একটি কবিতা,
'সমবায় থেকে একাগ্রতায় ফেরা
সুস্থ স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপে বাঁচার স্বপ্ন
তোমার সুগঠিত সমবায় পথ ধরে
আমরা পেতে পারি স্বচ্ছল জীবন,
তুমি আছ জানি সংস্লিষ্ট উন্নয়ণে,
ক্রেডিট ঋণ আবাসন সমবায়ে ,
আর্থিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সহ
মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে।'৩
মহিলাদের স্বনির্ভর করার নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। বর্তমানে যে প্রকল্পের অধীনে এই কাজ করা হচ্ছে তা হল, ‘জাতীয় জীবন ও জীবিকা’ প্রকল্প। রাজ্যে প্রকল্পটির নাম আনন্দধারা। প্রকল্পে গরিব মহিলাদের ছোট ছোট স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে গোষ্ঠীগুলি নিজেরাই ব্যাঙ্কে প্রথমে টাকা জমা দেয়। মাস ছয়েক পরে সেই আমানতের ভিত্তিতে গোষ্ঠীগুলিকে ঋণ দেওয়া হয়। বলা যেতে পারে,
' স্বনির্ভরে এই তো জীবন, জীবন জোয়ার, অনবদ্য।
আবর্তনে অনুগ্রহ গ্রহণে থাকে।
ঋণের আবেশে ঋণ,
পরিশোধও প্রথামাফিক,
উন্নতিও সংসারে সর্বতো।
এখানে নারীর নান্দনিকতা
সতত সংযোজনে আছে
যা পরিক্রমনে মন্থনময়ে
আছে, আছে উদ্দামে।
হগোষ্ঠীবিন্যাসে প্রবাহ-প্রত্যয়,
সেইই তো সমবায়,
গ্রামীণ।'৪
গত কয়েক বছরে গোষ্ঠীগুলির কাজের পরিধি বেড়েছে। ফলে তাদের ঋণ নেওয়ার পরিমাণও বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যাঙ্কের উপর নির্ভরতা কাটিয়ে তারা যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সে জন্য উদ্যোগী হয়েছে সরকার। ইতিমধ্যেই স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে গ্রাম পঞ্চায়েতভিত্তিক সংগঠন। এগুলিকে বলা হচ্ছে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সংঘ। এই ।সংঘগুলিকেই সমবায় সমিতিতে পরিণত করা হচ্ছে বলে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতর সূত্রে খবর। পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের এক কর্তা জানান, যেহেতু ঋণ দেওয়ার আইনি অধিকার একমাত্র সমবায় সমিতিই পেতে পারে। তাই সংঘগুলিকে সমবায়ে পরিণত করা হচ্ছে। এ জন্য রাজ্য সমবায় দফতরকে বলা হয়েছে তারা যেন দ্রুত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সংঘগুলিকে সমবায় আইন অনুযায়ী নিবন্ধীকৃত করে। এ প্রসঙ্গে
বলা চলে,
' গান্ধীজি ভারতীয় গ্রামগুলির স্বনির্ভরতার ওপর জোর দিয়েছিলেন। স্বাবলম্বীতাই জীবনের মূল মন্ত্র হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করতেন। ... তিনি গ্রামগুলিকে খাদ্য, পোশাক এবং তাদের প্রাথমিক চাহিদা পূরণের জন্য স্বাবলম্বী হওয়ার পরমর্শ দিয়েছিলেন। তিনি গ্রামীণ কুটির শিল্প ও হস্তশিল্পের ঊণ্ণয়ণের ওপর জোর দিয়েছিলেন, কারণ তারা কর্মসংস্থান দিতে পারে, গ্রামবাসীর প্রাথমিক চাহিদা মেটাতে এবং গ্রামের মানুষকে স্বনির্ভর করতে পারে।' ৫
সমবায় গঠিত হলে তারা কাজকর্ম পরিচালনা করবে পঞ্চায়েত অফিস থেকে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি এই সমবায়ে তাদের প্রাথমিক আমানতের টাকা জমা দিতে পারবে। ঋণও পাবে এখান থেকে। পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের এক কর্তা জানান, ব্যাঙ্কে নানা কাজের চাপ থাকে। ফলে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি ব্যাঙ্কে গেলে তাদের ঋণ বা আমানত জমা দেওয়ার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। নিজেরা সমবায় গড়লে তাদের সেই অসুবিধা অনেকটাই কমবে। শুধু তাই নয়, স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে দেওয়া ঋণের সুদ পাবে সমবায়গুলি। এর ফলে তাদের আয়ও হবে। যা ভবিষ্যতে আরও বেশি গোষ্ঠীকে ঋণ দিতে সাহায্য করবে তাদের। এমন কী আয়ের টাকা ব্যাঙ্কে জমা রেখে সেখান থেকেও ঋণ নিয়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে দিতে পারবে সমবায়গুলি। অন্যভাবে বলা চলে,
'...পরিকল্পণায় সমবায়কে বাজার অর্থনীতিতে টিকে থাকতে হলে সমবায়ের
পরিকাঠামো উন্নয়ণের ওপর জোর দিতে প্রতিযোগিতা সক্ষম সমবায় গঠনের কথা বলা হয়। সমবায়গুলি জাতীয় সমবায়নীতি গ্রহণের মাধ্যমে তৃণমূল স্তরের সংগঠনকে শক্ত করা হয়। আবার এই পরিকল্পণায় জাতীয় অগ্রাধিকার ভিত্তিক দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্প গুলির ওপর জোর দেওয়া হয়।'৬
সর্বোপরি, সমবায়ের সঙ্গে সমবায় তথা গ্রামীণ ব্যাঙ্কগুলি সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে গ্রামের দরিদ্র পরিবারের আর্থিক উণ্ণয়ণে সার্বিক সহায়তা করে চলেছে।
..................................
১. নরুল আবসার ,স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে ঋণ দিতে গড়া হচ্ছে সমবায় সমিতি; anandabazar.com; সর্বময়ে;
২. ইমনকল্যাণ দাস; তাৎক্ষণিক কবিতা;
৩. মতিলাল পটুয়া; তাৎক্ষণিক কবিতা;
৪. লেখক; তাৎক্ষণিক কবিতা;
৫. সুদীপ রায় এবং ড. আলপনা রায়; গ্রামীণ উণ্ণয়ণ; হর্ণবিল বুকস; ২০২৩; পৃ-৩১;
৬.রামকৃষ্ণ জানা; সমবায় ও স্বনির্ভর গোষ্ঠী, মেদিনীপুর; পৃ-৬৯;

