সম্প্রীতি - ড. মনোরঞ্জন দাস
প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায় :
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি চাইই চাই
ড. মনোরঞ্জন দাস
আবহমানকাল ধরে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষের বাস এই বঙ্গদেশে। দেহের গঠন, আকৃতি আর রঙেও রয়েছে বৈচিত্র্য। রয়েছে হাজার বছরের ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধন। এই বিচিত্রতা একদিকে যেমন দেশকে করেছে সৌন্দর্যময়, অন্যদিকে তেমনি সম্প্রীতির বন্ধনকে করেছে অটুট ও আস্থাময়। এ দেশ যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য লীলাভূমি ও প্রাণকেন্দ্র। সনেটকার লেখেন,
' ভাইয়ের সুসান্নিধ্যে, ভাইকে রাখো হে,
সে হোক মুসলমান কি হিন্দু। সবাই
তো মানুষ। মনুষ্যত্বের প্রিয় যুগবাহে
থাকতে তো হবে। সবে মোরা ভাই ভাই।
উসকানিতে কখনো কান দেবো মোরা
না, কভূ। স্বার্থান্বেষী ঐ চারিদিকে দৃষ্টি
ফেলে আছে জেনো, জেনো বিষবৃক্ষ তারা,
রক্তরাঙা মাটিতেই তাদের যে
কৃষ্টি।
একসাথে, পাশাপাশি হাতে হাত রেখে,
হাত ধরাধরি করে চলবো এদেশে
মোরা, সম্বচ্ছর আর উদারতা থেকে
শিক্ষা নেবো, নেবো শুধু, নেবো শুদ্ধতাকে।
মানুষের মাঝে আছে হে আল্লা- ঈশ্বর
তিনি সযতনে করে যান উপকার।'২
এ দেশে ধর্মীয় উৎসব হিসেবে উদযাপিত ও উপস্থাপিত হয় মুসলিমদের ঈদ, হিন্দুদের পূজা, খ্রিস্টানদের বড়দিন এবং বৌদ্ধদের বুদ্ধপূর্ণিমা। এসব উৎসব উপভোগ ও আনন্দময় করার জন্য থাকে সরকারি ছুটি। সবাই স্বাধীনভাবে পালন করে থাকে নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসব ও অনুষ্ঠান। বিদ্বেষ তো নেই, বরং আছে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা আর সাহচর্য। কাছে টেনে নেয় ভালোবেসে বিভিন্ন উৎসবে তারা একে অন্যকে, দূর থেকে। বিনিময় করে একে অপরের সঙ্গে প্রীতি ও শুভেচ্ছা। কবি লেখেন,
' সমাহারে সেইই প্রিয়হার হোক
মানবতায়;
সবাই মানুষ,
শুদ্ধ মনুষ্যত্বের অংশে একাকার
হও সবে, হও একীভূত।
সমস্বরে তুমিও বলে ওঠো,
' ও কোনো জাতের নয়,
ও মানুষ,
প্রিয়ময়ে, শুভময়ে;'
এইই হোক মন্ত্র সবার,
উচ্চারণে,
উদ্ভাবনে।'৩
একই গ্রাম কিংবা পাড়ায় বা অঞ্চলে, পাশাপাশি বসবাসের ফলে সম্প্রদায়গত ও জাতিগত পার্থক্য থাকলেও তা কখনো সম্প্রীতির ও ভাতৃত্বের বন্ধনে কোনো চিড় ধরাতে পারে নি। কিছু কিছু কুমতলববাজ বা ধান্দাবাজ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হীন স্বার্থ বা আত্মস্বার্থ হাসিল করতে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিতে চাইলেও এ দেশের ছাত্র-জনতা, নারীপুরুষ সকলেই সাম্প্রদায়িকতাকে কখনো প্রশ্রয় দেয়নি। বরং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে , পাশাপাশি থেকে কাজ করেছে বিভিন্ন জাতের ও সম্প্রদায়ের মানুষ খেত-খামার, কল-কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অফিস-আদালতসহ নানা কর্মক্ষেত্রে। শরিক হয়েছে সুখে-দুঃখে একে অন্যের এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বাক্ষর হয়ে আছে নানা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে গভীর সংহতি ও ঐক্যের।
শৈশবের সাম্প্রীতির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই,
'মহিম রহিম দুটি ছোট ছেলে
এক মন, এক প্রাণ;
মহিম সে গোঁড়া হিন্দুর ছেলে,
রহিম মুসলমান।
তাহলে কি হয়,—বন্ধু যে তারা,
তফাৎ কে করে ভাই,—
দুটি ছোট প্রাণ, তাজা দুটি ফুল,
কোনো মলিনতা নাই।
বালক রহিম মক্তবে পড়ে,
মহিম পাঠশালায়,—
একই পথে রোজ মহা-উৎসাহে
হাত ধ’রে তারা যায়।
মক্কা ও কাশী এক ক’রে দিল
দুটি ছোট শিশু ভাই,—
জম্জম্ জল গঙ্গায় এলো—
কোনো সন্দেহ নাই।
মন্দিরে আর মস্জিদে হ’ল
প্রাণে প্রাণে পরিচয়—
চেরাগের বাতি পঞ্চপ্রদীপে
গলাগলি ক’রে রয়।
রহিম মহিমে কোলাকুলি হ’ল
খোলাখুলি হ’ল প্রাণ,
এক হয়ে গেল উল্লাসে আজি
আল্লা ও ভগবান।
হিন্দুর ঘরে শিশুর মহলে
কে আছ মহিম ভাই,
মোল্লা ঘরের রহিম যে ডাকে,
আয় আয় ছুটে তাই।
আজ সে রহিম জুড়ে থাক্ ভাই
প্রতি মুস্লিম ঘর,
মহিমের স্মৃতি ভরে থাক্
নিতি হিন্দুর অন্তর।'৪
ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব সম্প্রদায়ের মানুষ।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি, ব্যবসায়, বাণিজ্য, চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সব সম্প্রদায়ের মানুষের সমান সুযোগ এবং অধিকার স্বীকৃত।
মদিনা সনদের একটি ধারা ছিল পৌত্তলিক, ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমসহ সব সম্প্রদায়ের মানুষ এক উম্মাহভুক্ত। আল্লাহর রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘সাবধান! যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকের ওপর অত্যাচার করে বা তার অধিকার কম দেয় কিংবা সামর্থ্যবহির্ভূতভাবে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয় অথবা জোর করে তার কোনো সম্পদ জোর করে নিয়ে যায়, তবে কিয়ামতের দিন আমি সে ব্যক্তির বিরুদ্ধে নালিশ করব।’ (আবু দাউদ)
‘চতুর্দশ খ্রিস্টাব্দের বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাস বলেছেন, ‘শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ বস্তুত, এ দেশে সংখ্যালঘিষ্ঠ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বলতে কোনো শব্দ নেই। সবার একটাই পরিচয় আমরা বাঙালী, বাংলা আমাদের প্রিয় ভাষা। কবি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, দেশে দেশে শাসকগোষ্ঠীর হীন স্বার্থে ও কুটিল বাসনা চরিতার্থ করতে, তাদেরই প্ররোচনায় হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ ও শুভবুদ্ধির কাছে তা পরাজিত ও পরাভূত হয়। হিংসা নয়, স্নেহ, ভালোবাসা ও সম্প্রীতির মধ্যেই মানুষ বেঁচে থাকে। সাধারণ মানুষের অশিক্ষা ও কুশিক্ষার সুযোগে ক্ষমতাধর সুবিধাভোগী শ্রেণি সাম্প্রদায়িকতার মতো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটাতে সাহস পায়। তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে মানুষকে শুভবুদ্ধি ও উদার মানবিকতায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘কান্ডারী হুশিয়ার’ কবিতার মতো ডাক দিয়ে বলতে হবে- ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী বলো, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’
এ দেশের প্রত্যেকটি মানুষ নদীর পাশ দিয়ে যখন পথ চলতে গিয়ে দেখেন একটা লোক ডুবে মরছে, বিবেকের তাড়নায় তখন তার মনে এই প্রশ্ন উঁকি দেয় না যে, লোকটি হিন্দু না কি মুসলিম, বৌদ্ধ না কি খ্রিস্টান কিংবা অন্য জাতের! বরং তাকে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। মনে আত্মতৃপ্তি পেয়ে বলে, ‘যাক, একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি তো।’ বস্তুত, সব বিপদ-আপদে এক সম্প্রদায়ের দুঃখে অন্য সম্প্রদায় বাড়িয়ে দিয়েছে সহানুভূতির হাত। এদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই ঐতিহ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ ও ক্ষতবিদ্ধ করতে কখনো ব্যক্তিগত আক্রোশ, কখনো বা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে তা নস্যাৎ করার চেষ্টা করলেও কখনো সফল হয়নি। দেশের মানুষ সম্মিলিতভাবে , ভালোবাসার বন্ধনে থেকে তা রুখে দিয়েছে, সেখানে হিংসা বা সাম্প্রদায়িকতার কোনো ঠাই নাই । দুই বন্ধু হাত ধরাধরি করে হেটে চললেও সেখানে ফুটে ওঠে না জাতের বজ্জাতি। কবি লেখেন,
'এসো হাতে হাত রেখে শপথ করি
আজ আমরা একে অপরের ভাই
নেই হিংসা বিবাদ জাতিভেদ নাই
মৃত্যুকালে সবার এক জায়গায় ঠাঁই,
তবে কেন শুধু এই মিথ্যা হানাহানি
অর্থ বিত্ত বিষয় সম্পত্তিতে টানাটানি
সবই ক্ষণস্থায়ী মৃত্যুকালে মূল্য নাই
কীর্তি-যশ-সেবার কোন মৃত্যু নাই।'৫
যাই হোক, কোনো দুষ্টু প্রকৃতির মানুষ যাতে যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে ফায়দা লুটতে না পারে, সে জন্য ধর্মীয় অনুশাসনগুলো প্রতিপালনের পাশাপাশি সবকিছু বিচার করতে হবে বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি দিয়ে। প্রসার ঘটাতে হবে আমাদের মানবিক ও হৃদয়স্থিথ দৃষ্টিভঙ্গির। চর্চা করতে হবে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মুক্ত ও মৌলিক বুদ্ধির। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে কি না তা উপলব্ধি করতে হবে নিজের বিচারবুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে।
বুঝতে হবে, মনেও রাখতে হবে,
' এক ভাব এক মন
মোরা ভাই ভাই
মিলেমিশে মিশেমিলে
সবে থাকা চাই।।
একের বিপদ হলে
অন্যরাও যাবো
উপকারে উপাচারে
মোরা সবে রবো।।
ওহে করিম, ওহে রাম,
ছুটে ছুটে আয়
মোরা থাকি ওহে ভাই
এক বিছানায়।।
ভাত যাহা আছে ভাই
ভাগ করে খাই
ক্ষুধার কি আছে জাত
এটা বোঝা চাই।।
হিন্দু আর মুসলিম
রক্ত সব লাল
কেন তবে ভেদাভেদ
ওহে মহীপাল!!'৬
সর্বোপরি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে, রুখে দিতে হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে চিড় ধরাতে চাওয়া অপশক্তিকে। তাহলেই চিরকাল ধরে সমাজে সম্প্রীতি বজায় থাকবে।
..................
তথ্যসূত্র
১. এম. এ. মাসুদ- সাম্প্রদায়িক সাম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে, Net;
২. তাৎক্ষণিক সনেট; লেখক ;
৩ . লেখক, তাৎক্ষণিক কবিতা;
৪. মহিম রহিম; সুনির্মল বসু; Net;
৫. তাৎক্ষণিক কবিতা; মতিলাল পটুয়া;
৬. লেখক, তাৎক্ষণিক ছড়া;
তৃতীয় অধ্যায়:
হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি : পথের খোঁজ
ড. মনোরঞ্জন দাস
একই পরিবারের দু ভাই যখন শান্তিতে, স্বস্তিতে ও সুস্পর্কে থাকে, তখন আমরা তাকে বলি ভাইয়ে-ভাইয়ে সম্প্রীতি আছে। তেমনি হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষ যখন পড়শিজ্ঞানে বা আত্মীয়জ্ঞানে মিলেমিশে একসাথে বসবাস করে তখন আমরা বলি দেশে সম্প্রীতি আছে।
ভারতবর্ষ নানা ভাষা, নানা ধর্ম, নানা সংস্কৃতির দেশ। এত বিভিন্নতা ও সম্প্রদায়গত বিভাজন, পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জাতীয় সংগীতে এই বিভিন্নতার কথা সুন্দরভাবে উল্লেখ করে গেছেন। যথার্থ ও সাজুয্যময়ে। যে দেশে সাতটি বড় ধর্ম, ১২২ টি ভাষা এবং ১৬০০ উপভাষায় লোকে এবং কথা বলে, তাদের আচার আচরণে, বেশভূষায়, খাদ্যাভাসে এবং সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্য তো বিপুল এবং বিস্তৃত হবেই। আবার অনেকে বলে বসেন, হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতি কোনো কালেই হবার না, হয়নি এবং হবেও না। কী ভীষণ কথা! কথাটা মেনে নেওয়া নির্বুদ্ধিতা যদি হয় তাহলে মিলনের প্রচেষ্টাতে থাকা দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে মঙ্গলকর বটেই।
যিশুখৃষ্ট এবং হজরত মহম্মদের জন্মের পর থেকে ধর্মের সাম্রাজ্যবাদ শুরু। খৃষ্টধর্ম প্রচারের নামে অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে গেছে আর ইসলাম সমাজকে দুভাগে ভাগ করেছে – মুসলমান ও অ-মুসলমান। ইসলাম ধর্মের প্রকৃত অর্থ আত্মসমর্পণ ও আত্মজ্ঞানী হওয়া। মুসলমানদের নিয়ে হিন্দুদের যত অশান্তি! আমাদের দেশের মুসলমানেরা গভীর মূলে হিন্দু, সমাজে অন্ত্যজ ছিল। তারা হিন্দুদের অত্যাচারের শিকার। বাধ্য হয়ে তারা ধর্ম বদল করেছেন – হিন্দু এলাকা থেকে সরে গিয়ে অন্যত্র বসবাস করতে শুরু করেছেন এবং অন্যধর্ম তথা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। আজও তার চিহ্ন বর্তমান।
ভারতবর্ষের ইতিহাস শুরু যাদের নিয়ে, তারা হল মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন। এরপর বাইরে থেকে অনুপ্রবেশ শুরু হল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পাঠান-মোগল-ইংরেজ। একমাত্র জাতি ইংরেজরা চলে গেল, বাকিরা অন্যান্যরা রয়ে গেল। ভারতে মোগলরা থেকে যাওয়ায় কোরান পেল দেশ। ভারতবর্ষ পেল মুসলমান ও মুসলিম সংস্কৃতি। মোটামুটি হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতেই বসবাস করছিল। ইংররেজদের কুটনৈনিক চালেই হিন্দু মুসলমান দ্বন্দ্ব বা বিভাজন শুরু হয়। তবু সনেটকার সম্প্রীতির সপক্ষে লেখেন,
' প্রিয় সোপানেই নাম তোমার, মানুষ,
তুমি প্রেমময়ে নিত্য পরার্থে। তোমার
অকপট প্রচলনে আছে বেশ হুশ
হে, স্পর্শমায়ায়, আর এইই আধার।
হিংসার নগ্ন রূপ তুমি নিজ হাতে
পুড়িয়েই করো ছাই। হে, হৃদয়াধারে
তুমি পুষ্ট হও নিজে ।ঊজ্জ্বল প্রভাতে
তুমি নিজেকেই ঋদ্ধ করো, সর্বসারে।
মধুময়ে সমস্থিত হও, হে সম্প্রীতিতে
নিজে হও মহীয়ান। সন্নিহিত সত্যে
সাবলীল হও, যেথা শুদ্ধ পরিধিতে
হয় প্রেম জয়গানে রুচিশীল তীর্থ।
প্রীতিময় পার্বনে ,হে যাও তুমি, তুমি
অবারিত রথে হও এক শুদ্ধ ভূমি।'২
ভারতীয়দের মধ্যে মুসলমান ও মুসলিম দুই-ই রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মুসলমান জনগণ মুসলমান, আর ভারতের বাদবাকি অংশে বসবাসকারীরা মুসলিম। মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিপত্তি
ও প্রভাবশালী যাঁরা, তারা জাতীয় জীবনে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও পরিসরে শিক্ষিত, সুপ্রতিষ্ঠিত, পরিচয়ে যাঁরা বিদ্বজন, তাঁরা ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মেনে ও গ্রহণ করে শান্তিতে আছেন। বাদবাকিরা ভারতের বুকে আছেন বটে, কিন্তু চিন্তাভাবনা ও মননে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির ধারক-বাহক। গোঁড়ামিতে বুঁদ এবং পরিবাহী হয়ে আছেন বলে এঁরাই রাজনীতির সহজ শিকার। এ-কারণেই এঁরা বিদ্রুপের ও বক্র হাসির শিকার। বলা হয় মুসলমান ও মুসলিম, ইসলামে এক, হজযাত্রায় এক, আত্মীয় পরিজনবোধে এক। বিদেশে উভয়ে 'ইন্ডিয়ান' পরিচয় দেন এবং দৃঢ়তার সঙ্গে গর্ব বোধ করেন। ভাষায়, আচার-বিচারে, সংস্কারে, ধর্ম পালনে তাঁরা আরবীয় সংস্কৃতির অংশী। মূল কোরান আরবি ভাষায় রচিত, কাজেই মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরবি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক। মুসলিম উমরাহদের মতে, পৃথিবীর পবিত্র ভাষা হল আরবি। জীবিত কালে যার ভাষা যাই হোক না কেন মৃত্যুর পর মানুষের ভাষা হবে একমাত্র আরবি। এটা তাদের বিশ্বাস।
এখন প্রশ্ন, আমাদের দেশে হিন্দু মুসলমানে সম্প্রীতি ও সহাবস্থান ছিল কি? সকালে ছিল, বিকালে ছিল না এবং রাত্রিতে দ্বন্দ্ব। কিন্তু সম্প্রীতির প্রচেষ্টা সব কালেই চলমান ও গতিশীল ছিল। ছিল আচারে বিচারে, সাহিত্যে,শিল্পে, সংস্কৃতিতে, গানে-কবিতায়-নাটকে। প্রচেষ্টা সবসময় দানা বাঁধেনি, সুষ্ঠ রূপ পায় নি, গতি পায় নি, পথ পায় নি এবং আন্দোলনও হয় নি তেমনভাবে। এমনটা হত অতীতে, বর্তমানে রূপটা বদলে গেছে অনেকখানি। দুই সম্প্রদায়ে কোন ঘটনা ঘটলে, একপক্ষে এসে দাঁড়ান কোন রাজনৈতিক নেতা, অন্যপক্ষে যদি কোন ধর্মীয় প্রতিনিধি তাহলে, ঘটনার চরিত্র বদলে যায়, জটিল হয়-কুটিল হয় ; সংঘাতের রূপ ধারণ করে। তবু কবি লেখেন,
' আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি
মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্বে
আর ধর্মের নামে যা চলছে
তা কেবল সংস্কার
মৌলবাদের চাপে মনুষ্যত্ব আজ
বড় ক্লান্ত;
জেগে উঠছে সংস্কার।
মসজিদ-মন্দির ভেঙে
যে কার ধর্মকে বড় করতে চায়!
তাই বুঝি মানুষ তুলেছে হাতিয়ার।'৩
মহামানবদের কথাএবার বলা যাক। বাঙ্গালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের সকাল সন্ধ্যা, সাহিত্য-সঙ্গীত-শিল্পকলা এবং সংস্কৃতি রবীন্দ্রনাথকে ঘিরেই। সৈয়দ মুজতবা আলীর সাথে রবীন্দ্রনাথের একটি বহুশ্রুত রসালাপ মজার হলেও বিষয়ের গভীরতায় অপূর্ব। সেটি হল,
-'হ্যাঁ রে বলতে পারিস সেই মহাপুরুষ কবে আসবেন কাঁচি হাতে করে?'
- 'মহাপুরুষ তো আসেন ভগবানের বাণী নিয়ে অথবা শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম নিয়ে; কাঁচি হাতে করে?'
- 'হ্যাঁ, হ্যাঁ, কাঁচি হাতে নিয়ে, সেই কাঁচি দিয়ে সামনের দাড়ি ছেঁটে দেবেন, পেছনের টিকি কেটে দেবেন। সব চুরমার করে একাকার করে দেবেন। হিন্দু মুসলমান আর কতদিন এরকম আলাদা হয়ে থাকবে।'
মহামতি-সম্রাট আকবর ছিলেন উদার মানুষ। নিরক্ষর, কিন্তু পাণ্ডিত্যের আকরে ছিলেন ভীষণ দৃঢ়। হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতি প্রসঙ্গে তিনি আজও প্রাসঙ্গিক এবং পারম্পরিক। তাঁর প্রবর্তিত ধর্মমতের নাম দীন-ই-ইলাহি, ঈশ্বরের ধর্ম, মানুষের ধর্ম। তাঁর ধর্মের বাণী সুলজ-ই-কুল; মানে, সর্বজনীন ও সার্বিক শান্তি। তাঁর শাসন ব্যবস্থার মূল কথা ছিল বহুত্ববাদ, সার্বজননীতাবাদ ও নৈতিকতা। হিন্দুদের সাথে পূর্ণভাবে মৈত্রী স্থাপনে তাঁর নানাবিধ পদক্ষেপ ইতিহাস হয়ে থাকবে চিরকাল এবং হিন্দু ও মুসলমান তাঁকে স্মরণ করে যাবে। রাজপুত রমণী যোধাবাইকে পত্নীরূপে গ্রহণ এবং শাসন ব্যবস্থায় হিন্দুদের নিয়োগ, দুটি বড় দৃষ্টান্ত মাত্র, তার কাজের।
স্বামী বিবেকানন্দের বিখ্যাত উক্তি, 'ভবিষ্যৎ ভারত গড়ে উঠবে ইসলামীয় দেহ এবং বৈদান্তিক মস্তিষ্ক নিয়ে।' নজরুল, হিন্দু না মুসলিম! তিনি দুই-ই। তাঁরও একটা উক্তি দেখা যাক। নজরুল বলেছেন, 'আপনারা বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি এসেছিলাম হিন্দু মুসলমানের শ্যেকহ্যান্ড করিয়ে দিতে।' তাঁর এই উক্তিতে একটা আর্তি লুকানো আছে যা আন্তরিক, আশ্চর্যজনক ও বিস্ময়কর। এ প্রসঙ্গ হৃদয়ে ধারণ করে কবি লেখেন,
'কে বলে হিন্দু কে বলে মুসলিম
কে বলে মারাঠি কে বলে পাঞ্জাবি
কে বলে গুজরাতি কে বলে জৈন
আমরা একই রক্তে গড়া মানুষ ,
আমাদের একই প্রাণ একই স্বত্বা
একই মন একই বায়ু একই দেশ
একই বিশ্ব পিতা একই বিশ্ব মাতা
আমরা একই আকাশে ওড়া ফানুস ।'৪
রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজি যে যাঁর মতো নিজ নিজ চিন্তাধারায়, ভাবনায়-চেতনায়-কর্মকাণ্ড ও তার রূপায়ণে সারাজীবন একনিষ্ঠ ছিলেন সামাপ্রদায়িক সম্প্রীতিতে। এঁরা বিরল উদাহরণ। গান্ধীজি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ' হিন্দু মুসলিম ইউনিটি হ্যাজ বিন মাই প্যাশন ফ্রম মাই আর্লি ইয়ুথ। আই মে নট লিভ অ্যা সিঙ্গল স্টোন আনটার্নড টু অ্যাচিভ ইট।'
রবীন্দ্রনাথ 'হিন্দু মুসলমান' প্রবন্ধে লিখছেন, ' পৃথিবীতে দুটি সম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র - সে হচ্ছে খৃষ্টান আর মুসলমান ধর্ম। তারা নিজের ধর্মকে পালন করেই সন্তুষ্ট নয়, অন্য ধর্মকে সংহার করতে উদ্যত। এইজন্যে তাদের ধর্মগ্রহণ করা ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলবার অন্য কোন উপায় নেই।'আর একটি উক্তিতে বলেছেন, ' খিলাফৎ উপলক্ষে মুসলমান নিজের মসজিদে এবং অন্যত্র হিন্দুকে যত কাছে টেনেছে, হিন্দু মুসলমানকে তত কাছে টানতে পারেনি। আচার হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানু ষের সম্বন্ধের সেতু। সেখানেই পদে পদে হিন্দু নিজের বেড়া তুলে রেখেছে।' আজ এটা পরীক্ষিত সত্য - আদানপ্রদান হবে কী করে? শহরে গ্রামে আমাদের এই মহান দুই জাতি বিচ্ছিন্দনতার পর্বে
দগদগে ঘায়ের মতো নিশ্চিত দূরত্ব রেখে বসবাস করে চলেছেন —সম্প্রীতি হবে কী করে?
এটা সর্বতো বোঝা যায়, সবাই সম্প্রীতি চেয়ে এসেছেন, সম্প্রীতি আসেনি। আদৌ আসবে কিনা ভাবতে বুকটা দুরুদুরু কাঁপে , আতঙ্ক চেপে ধরে। তাহলে কি বাবরি ভাঙ্গা হতেই থাকবে আবার নুতন করে গড়াও হবে। তবে কি পরমাণু যুদ্ধ নয় ধর্মযুদ্ধ বর্তমান সভ্যতার শেষ পরিণতি।আর তার শুরু ভারতে না মধ্যপ্রাচ্যে? তবু কবি সম্প্রীতির অনুরণনে
থাকেন এবং লেখেন,
' মানুষের জ্যোতির্ময়ে থাকে যদি মানব ধর্ম
তবে তাকে সাদরে লালন করো তুমি
নিজবৃত্তে।
যে আচার মানুষের উপকারে
আসে না কোনোদিন
তাকে দূর করে দাও
নির্দিধায়।
মনে আর মননে পবিত্র প্রেমের চাষ করো তুমি
অনুক্ষণ।'৫
সম্রাট আকবরের কাল ধরলে সম্প্রীতি-গীতির বয়স সাড়ে পাঁচশো বছর পেরিয়ে গেছে। সম্প্রীতি আসেনি। বরং সাম্প্রদায়িক বিবাদ বিসংবাদ বেড়েই চলেছে অনবরত, রক্ত ঝরছে, ঘর পুড়ছে মসজিদ- মন্দির মাটিতে লুটোচ্ছে প্রায়শই।
অবাক হবার বিষয়, 'সম্প্রীতি চাই না!' আমরা জানি কিন্তু বুঝতে চাই না, ধর্মই সম্প্রীতির প্রধান এবং শেষ অন্তরায়। আমরা জন্মেই ধর্মের দ্বারা চিহ্নিত হই ; ধনী গরিবের চিহ্ন পড়ে যায় ললাটে। ধর্মের নামে নাম, ধর্মের নামে সব শুভ কাজ; ধর্মের নাম নিয়ে খুন খারাপি, ধর্মের নামেই নেতা-মন্ত্রী ও রাজ্য শাসনের প্রার্থনা আর সব শেষে ধর্মের নামে চিতায় ওঠা বা কবরে ঘুমানো। এ ছাড়া মানবজীবনের গতি নেই যেন! সব শুভ ভাবনা, আদর্শ ধর্মে এসে ঠেকে যায়। অন্য পথ চাই। কিন্তু তার জন্য সচেষ্ট হবে কে? বিকল্প চাই, কিন্তু ধর্মের উপর কথা বলবে কে?
প্রকৃতই, মূল ও বিকল্প পথের পথিক নিচুতলার মানুষ-- কৃষক, শ্রমিক আর খেটে খাওয়া মানুষ যারা ধর্ম-রাজনীতি কোনটাই বোঝে না, বোঝার সময় নেই; এদের কাছে পৌঁছনোর প্রয়োজন ছিল। এরা ধর্মকে ডরায়, শাসককে ভয় পায়। আর ওই বিশাল সংখ্যার ভীরু মধ্যবিত্ত শ্রেণি যাঁরা দাবী-দাওয়া নিয়ে পথে নামেন তাদের কাছে যাওয়া হয়নি বোঝানোও হয়নি; বিরাট সংখ্যাক ছাত্র ও যুব সমাজ এদের কাছেও যাওয়া হয়নি। ফলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি একটা বিক্ষিপ্ত রূপে থেকেছে। সামাজিক বা জাতীয় প্রয়াস হয়ে ওঠেনি। তবুও কবি বলেন,
' স্থাপণায় উদার হও, হও ঋদ্ধ,
যেখানে সম্প্রীতি সব করে খেলা।
সারাবেলা শুদ্ধ সংস্কারে থাকো,
থাকো তুমি ঐশ্বর্যের বৃত্তে মহীয়াণ।
উৎকর্ষে তুমি একাকার হও, হও
সংস্পর্শে আলোর পূর্ণ ধারা এক,
মগ্নতায় নিজ নির্মানে মানুষের
কাছে যাও, যাও যাবতীয় যোগে।
বলো উদাত্ত কন্ঠে,' এসো সবে, মোরা
এক সাথে পথ চলি, চলি নির্বিকার;
মরমী মন্থনে থাকি, থাকি মোরা
ভেদাভেদ, ' জাতের নামে বজ্জাতি' দূরে ঠেলে।'৬
এতকাল, ভিন্নমুখী দুটি সম্প্রদায়কে মিলেমিশে থেকে নিজ নিজ ধর্মের ক্রিয়াকর্ম পালনে সংযত আচরণের ও জীবন যাপনের কথা বলা হয়েছে। মিলনের কথা বলা হয়েছে বটে, তবে সরাসরি স্পষ্ট করে নয়। এখন সময় হয়েছে স্পষ্টতার, স্বচ্ছতার, দৃঢ়তার। এখন প্রয়োজন নতুন ডাক, সুস্থ সবল সাহসী মানুষের ক্রিয়াকলাপের পূর্ণ পদক্ষেপ। ধর্মের বাধা সরিয়ে ভালবেসে বিয়ে-শাদি। প্রেমকে স্বীকৃতি দেওয়া, যা নিষ্কলুষ ও পবিত্র। প্রেম কালের পরীক্ষায় একমাত্র মিলনের পথ। প্রেম জোর করে হয় না, ঘটে যায়। আমার বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রয়োজন। প্রথমেই ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন। সরকারি শিলমোহর পড়ার পর পুরোহিত বা ইমামের উপস্থিতি ছাড়া হবে প্রথাগত কিছু আচার অনুষ্ঠান পালন। যেমন, টোপর মাথায় শুভদৃষ্টি; সাত পাক ঘোরা শেষে ফুলমালা বিনিময়; তারপর কবুলনামায় স্বাক্ষর। সমাজের বিদগ্ধ মানুষেরা মালাবদলে এবং কবুলনামা পড়াতে সাহায্য করুন।
হ্যাঁ, আর্থিক সাহায্যও প্রয়োজন। প্রেমে অর্থ ও ধর্ম কোনটাই লাগে না। জীবনযাপনে অর্থ লাগে।, অবশ্যই। ধর্মটা স্বেচ্ছানির্ভর। পারিবারিক সমর্থন ছাড়া যে বিবাহ তা হবার উপযুক্ত স্থান গণবিবাহের আসর। দুর্বল প্রার্থীকে অর্থ সাহায্য দিয়ে বল যোগাতে হবে; জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে, সর্বোপরি। এই উদ্দেশ্যে সরকারি বেসরকারি সাহায্য নিয়ে তহবিল গড়া একান্তই আবশ্যিক। স্বনির্ভর দম্পতি সম্প্রীতির আন্দোলনে অগ্রণী যোদ্ধা। অথ, ইতিহাস নির্ভর একটি কবিতা,
' ১৯৪৭
হিন্দু বলে হিন্দুস্থান
মুসলমানের পাকিস্থান
বাংলার কেউ নেই
নেতাজি শুধু পোস্টারে।'৭
মূল কথা এই যে, হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতিকে করে তুলতে হবে একটি পরিপূর্ণ আন্দোলন। এই আন্দোলন সমাজের একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে হতে হবে ঊর্দ্ধমুখী এবং সর্বত্রগামী। স্থানীয় স্তরে ছোট ছোট কেন্দ্র, শহরাঞ্চলে সংগঠন ও জাতীয় স্তরে মহাসংগঠন গড়ে তুলতে হবে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কেন্দ্র বা সংগঠনের অধীন হয়ে আন্দোলনে সামিল হবে এবং সুদুর প্রসারী হবে। বহুমাত্রিক মেলা-মেশায়, আদানপ্রদানে ধর্মের শিকল ভেঙে যাবে।
অর্থ ছাড়া এমন মহাযজ্ঞ সম্ভব না। তাই তহবিল গড়তে ধনীর দান এবং সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য প্রয়োজন। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বিবাহিত অভিবাসী মানুষেরা পুঁজি গড়তে উদার হাতে সাহায্য করতে পারেন। আর দেশের অভ্যন্তরে এমন বিবাহিত মানুষের সংখ্যা কম নয়। পরিচালনায় থাকবেন, দার্শনিক, শিক্ষক, চিন্তকেরা, আদর্শে বিশ্বাসী সংগঠকেরা।
বলা হয়ে থাকে, আর্লি ম্যারেজ আর্লি ফ্রুট। নবদম্পতিকে একটি সাবধান বাণী শুনিয়ে রাখা মঙ্গলের। তারা যেন তাদের সন্তানের নাম রাখার ব্যাপারে সজাগ থাকেন-- এমন নাম সন্তানের যেন হয় যা ভারতীয়, ধর্ম-বংশ-পদবী বিহীন। সে হবে নূতন পরিচয়ে নূতন ভারতের নাগরিক। সমাজের মানুষের এটা সর্বতো ভাবা দরকার।
সামনে মরুদ্যান। পুষ্পিত হচ্ছে, সবার অগোচরে - সবুজে সবুজে। আমার মতো যারা পারের কড়ি হাতে নিয়ে বসে আছি তারা বাদ থাকুন, বেদ-কোরান-বাইবেল পড়তে পড়তে শেষ ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ুন। এর বাইরে যারা তিরিশ থেকে আশি, ধর্ম নিয়ে ‘কচাল’ করুক নতুবা সম্প্রীতির বুদ্বুদ কেটে মহান মানুষ হয়ে যাক। এর বাইরে তিরিশের নিচে যারা, আগামীর ভবিষ্যৎ--সবার নাতি-নাতনি—ওরাই সবুজে সবুজে পুষ্পিত মরূদ্যান। ওরা ধর্মের কথা শুনতে চায় না, বুঝতে চায় না। উদ্দাম ঝর্না ওরা - চোখে আগামীর স্বপ্ন, বাধাবন্ধহীন স্বাধীনতাকে ছোঁয়ার ইচ্ছে। ওরা গোকুলে বাড়ছে — স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, গবেষণাগারে; নানান ক্রীড়াঙ্গনে, শিল্পকলা ও সংস্কৃতির শিক্ষাপ্রাঙ্গনে। বড়ো সম্প্রীতিতে আছে - যেন ভাই-ভাই, যেন ভাই-বোন। ওরা লিঙ্গবোধে ভাবিত না, জাত-পাত-বর্ণ বোধেও পীড়িত না — নিষ্কলুষ, পবিত্র। হ্যাঁ, আর যারা দেশ রক্ষার কাজে নিযুক্ত, শ্রমিক-কৃষক-মজুর-দলিত-দরিদ্র, ব্যতিক্রমী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, তারাও এক রকম সম্প্রীতিতে চিরকাল থেকে এসেছেন এবং আছেন। এরা ধর্মে বিভক্ত থেকেও নিশ্চুপ। ধর্ম বুঝতে চান না। হতভাগ্য। তবে বিস্ফোরক। সম্প্রীতি সম্পর্কে একটি ছড়া,
' জাত নিয়ে করছো খেলা
জাতের ভাই আছে কি?
মানুষই হল শুধু জাতি
একথাটা বোঝো নি।।
সমারোহে সবে চলো,
বলো, মোরা ভাই, ভাই,
ভেদাভেদ করো কেন?
তার কোনো মূল্য নাই।।
সহানুভূতি সাথে নিয়ে
পথ তুমি চলো,
'মানবের জয়, মানবের জয়,'
এই শুধু বলো।।
অন্যের প্রতি তুমি নিজে
হও ক্ষমাশীল
তাহলেই মানব জাতি
হবে সাবলীল।।
আত্মার সাথে আত্মার
হোক ওহে মিল
তাহলে জগৎ হবে
হবে প্রিয়শীল।।'৮
একটা কাহিনী দিয়ে শেষ করা যাক। এক মহাশয়ের ভিয়েতনামি নাতবৌ বৌদ্ধ না মুসলিম তা নিয়ে সংসারে কোন ভাবনা-চিন্তা নেই; আমেরিকান পুত্রবধূ খ্রিস্টান; তুতো ভাইঝির স্বামী মুসলিম। বিয়ের আগে বা পরে এঁরা কেউই ধর্ম পরিবর্তন করেনি। কিছু-না-কিছু অভাব অভিযোগ অশান্তি সংসারে যেমন থাকে তেমনি ছিল কিন্তু ধর্ম নিয়ে অশান্তি ছিল না। আচার-পালন একান্তই যার যার ইচ্ছানির্ভর। আমাদের মত বহু ধর্মের দেশে এমন হতেই পারে। এমনটা যদি আরও আরও হয়, ভারতবর্ষ একশো ভাগ সম্প্রীতির সমারোহে ও সাজুয্যে থাকবেই থাকবে।
.............................
তথ্যসূত্র
১. অসীম সেন; হিন্দু- মুসলিম সম্প্রীতি: পথের সন্ধান; Net; সর্বস্তরে
২. লেখক; তাৎক্ষণিক সনেট;
৩. মাসুদুল হক; ধর্ম ; Net;
৪. মতিলাল পটুয়া; তাৎক্ষণিক কবিতা;
৫. লেখক; তাৎক্ষণিক কবিতা;
৬ . লেখক; তাৎক্ষণিক কবিতা;
৭. ৩-নং-এর মতো;
৮.লেখক; তাৎক্ষণিক ছড়া;
চতুর্থ অধ্যায়:
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ইসলাম ও শান্তির প্রবাহ
ড. মনোরঞ্জন দাস
'হে মানবজাতি! আমি নর ও নারী থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছি। আর আমি বিভিন্ন গোষ্ঠী ও গোত্রে তোমাদের বিভক্ত করেছি যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পার’। (সূরা আল হুজুরাত, আয়াত : ১৩)।
।এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, মানুষ হিসাবে আমরা সবাই এক জাতি। আদম ও হাওয়া (আ.) থেকে সৃষ্ট মানবমণ্ডলীর সদস্য হিসাবে সবাই আল্লাহতায়ালার কাছে সমমর্যাদার অধিকারী।
কবি লেখেন,
' অসীম যোগসূত্রে এসো
সার্বজনীন হই,
হই প্রকাশে বাস্তব বেলা।
ঘৃণার ঘরে আগুন ধরাই,
পোড়াই তার সব;
প্রিয় স্তবে বলে উঠি:
যথার্থ যোগে যৌগিক হবো,
প্রেমময়ে পার্বণ হবো, হবোই।দূ র্দম শান্তি আর প্রশান্তিতে
অনিবার্য হবো,
ভোরের আলোর ধারায়,
ধারাপাতে।
প্রথায় প্রেরণার চাষ করবো
হৃদয়-জমিতে।
এখানেই সম্প্রীতি এসে হাত
ধরে নিয়ে যাক সর্বস্তরে
শুভেচ্ছা বিলোতে।'২
চামড়ার রং, ধনসম্পদের পরিমাণ, সামাজিক মর্যাদা, বংশ ইত্যাদি দ্বারা মানুষের মর্যাদার মূল্যায়ন হতে পারে না। জাতি, উপজাতি, বর্ণ, বংশ ইত্যাদির বিভক্তি কেবল পরস্পরকে জানার জন্য, যাতে পরস্পরের চারিত্রিক ও মানসিক গুণাবলি দ্বারা একে অপরের উপকার হতে পারে।
মহানবি (সা.) বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে উদাত্ত কণ্ঠে বলেছেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদি পিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের ওপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচার্য বিষয় হবে, কে তাকওয়া তথা আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করল। এর দ্বারা আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ’ (বায়হাকি)।
কবি লেখেন,
'হে ভগবান হে মেহেরবান আল্লা
কবে বোধ জাগবে মানুষের
হে গড হে শত সহস্র দেব দেবী
কবে বন্ধ হবে রক্তক্ষয়ী খেলা ,
বন্ধ করো জাতপাতের অবক্ষয়
জাগাও মানুষে মানুষে বোধ
হিন্দু মুসলিম জৈন্ বৌদ্ধ খ্রিস্টান
এদের নিয়ে গড়ো মিলন মেলা ।'৩
আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর এ মহান বাণীতে ইসলামের অনন্য আদর্শ বিশেষত জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মমতের অনুসারীরা পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে মিলেমিশে একত্রে বসবাসের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বা আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার নির্দেশনা উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে। খোদার পৃথিবীতে বহু জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও ভাষাভাষী মানুষের বসবাস।
ছড়াকার লেখেন,
' মানবপ্রেমে মত্ত হও
জাতবিচার কেন?
' জাতের নামে বজ্জাতি'তে
দুঃখ আছে জেনো।।
শুদ্ধ প্রেমে মেতে ওঠো
মনটা করো ঠিক
ক্ষমার মাঝে ঋদ্ধ হয়ে
চলবে সবদিক।।
আচরণে মধুর হবে
বলবে মিষ্টি কথা
শুদ্ধ হয়ে ঋদ্ধ হয়ে
যাবে যথাতথা।।
স্নেহ তুমি মিলিয়ে দেবে
ছোট্ট যারা আছে
ছোটদের বাসবে ভালো
যাবে তাদের কাছে।।
প্রিয় মায়ায় সঠিক হবে
হবে যত্নবান
সমাজটা ঊজ্ল হবে
পাবে উচ্চস্থান।।'৪
এসব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যকার ঐক্য, সংহতি ও পারস্পরিক সহযোগিতার নামই হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। মানবসমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্ব অপরিসীম। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মানুষের মধ্যে ধৈর্য, সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ ঘটায়। সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশ ও জাতি উন্নতির শিখরে আরোহণ করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত না করে কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনুপস্থিতিতে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সংঘাতের সূত্রপাত ঘটায়, গৃহযুদ্ধেরও রূপ নেয়। অনেক ক্ষেত্রে ইহকাল-পরকালের সব নেকির কাজও ধ্বংস হয়ে যায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কারণে। কবি লেখেন,
'রক্ত দিয়ে গড়েছি যে দেশ
চাই না রক্ত দিয়ে ভাঙতে ,
ধন ধান্যে পুষ্পের সে দেশে
পারবে কি বিষাদ ঢালতে।
তোমার আমার সবার রক্তে
গড়েছি এ দেশ মনে রেখো ,
তার সম্প্রদায় সম্প্রীতি রক্ষায়
মানুষ সর্বদা সজাগ থেকো।'৫
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম। এটি এমন এক সার্বজনীন ও শান্তিময় জীবনব্যবস্থা, যেখানে শুধু মানব সম্প্রদায়ই নয় বরং পশুপাখি ও প্রকৃতির অধিকারও সংরক্ষিত রয়েছে। এ ধর্মে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ-সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কোনো স্থান নেই। যারা সামাজিক পরিমণ্ডলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ইসলাম কায়েম করতে চায়, তারা কখনো শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী হতে পারে না। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো বল প্রয়োগ নেই। কারণ সৎপথ ও ভ্রান্তি উভয়ের মধ্যে পার্থক্য অমুসলমানদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য বাধ্য করতেন এবং মক্কায় বসবাসের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি! এতে প্রমাণিত হয়, ধর্মের জন্য বল প্রয়োগ ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলামের আদর্শ হলো শত্রুর সঙ্গেও বন্ধুসুলভ আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। সবার সৃষ্টি যেহেতু একই উৎস থেকে, তাহলে কেন একে অপরের সঙ্গে বিরোধ? কুরআন-হাদিস ও রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত পথের বাইরে যা কিছুই করা হবে তা ইসলাম নয়। আজকের সমাজে অতি উৎসাহী কিছু মানুষ ধর্মের নামে বল প্রয়োগ, ভিন্নধর্মাবলম্বীদের প্রতি জুলুম-অত্যাচার করতে চান-যা মোটেও ইসলাম সমর্থন করে না।
কবি লেখেন ,
' সম্পর্কে প্রেম ঢালো তুমি
নিরন্তর।
অনুভবের গভীরে নির্মলতা
আনো অনবদ্য,
যেখানে প্রীতির পার্বন সর্বদা
সরল সত্যে
একাকারে থাকে, অধিকারে
থাকে।
প্রত্যয়ের পরিধিতে মানবিক
গুনগুলোকে সমাহারে রাখো,
সংস্কারে রাখো।
সুতীর্থে তোমার মনন হোক
মন্থনে সারাবেলা।
আনবিক আধারে ফুলেল
প্রবাহ প্রাসঙ্গিক হোক;
হোক সুদুর সমারোহে সমৃদ্ধ
ভোর,
ভৈরব অধ্যায়ে, সমধিক,
নিদারূণ।'৬
ইসলাম সব ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। ধর্ম পালনে কেউ বাধাগ্রস্ত হবে না। তাই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ, উপাসনালয় ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে কোনোরূপ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা কোনো মুসলমানের জন্য সমর্থনযোগ্য নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা ডাকে, তাদের তোমরা গালি দিও না। তাহলে তারা সীমালংঘন করে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকেও গালি দেবে।’ (সূরা আনয়াম : ১০৮) অমুসলিমদের জান-মাল-ইজ্জত সংরক্ষণের ব্যাপারে রাসূল (সা.) কঠোর সতর্কবাণী দিয়ে বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ চল্লিশ বছরের দূরত্বে থেকেও জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।’ (বুখারি) অন্য হাদিসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সাবধান! যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকের ওপর অত্যাচার করে অথবা তার অধিকার থেকে কম দেয় কিংবা সামর্থ্যবহির্ভূতভাবে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয় বা জোর করে তার কোনো সম্পদ নিয়ে যায়, তবে কেয়ামতের দিন আমি সে ব্যক্তির প্রতিবাদকারী হবো (আবু দাউদ)।’
কবি লেখেন,
' শুদ্ধিতে সমাবর্তন চাই মহিমার
যেখানে
সব উপাচারে আবৃত আছে
আধিপত্য, প্রেম আর প্রেমের
পরশ।
আকরিক আবর্তনে মুহূর্তের
পাতায় মুহূর্ত ইতিহাস হয়ে রয় যেন
প্রত্যয়ে যাওয়া-আসা,
আসা-যাওয়া।
আবার প্রশ্রয়ে পার্বিক হয়ে আসে বর্তমান, যুগান্তরে,
যেখানে শরতের সমূহ সংস্কার
ফির ফিরে আসে জীবনের
জীবনের স্রোতে, প্রসারে।
তৃপ্তিতে তর্পণ চাই সম্প্রীতির
যেখানে প্রসারে আবৃত আছে
বাস্তবতা, আবেগ আর আবেগের অংশ বিশেষ।'৭
মহানবি (সা.) মক্কা থেকে মদিনা হিজরত করার পর যে ‘মদিনা সনদ’ ঘোষণা করেন, এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য ধারা রয়েছে। মদিনায় মুসলমান, ইহুদি এবং আওস ও খাযরায গোত্রসহ ১২টি উপগোত্রের বসবাস ছিল। চরম গোষ্ঠীগত মতানৈক্য ও সংঘাতের মধ্যে সব গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে কীভাবে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করা যায় মহানবি (সা.) মদিনাকে তার একটি অতুলনীয় দৃষ্টান্ত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। মদিনা সনদের মাধ্যমে শান্তির বার্তাবাহক বিশ্বনবি (সা.) ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার মাঝে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, সাম্য-মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন রচনা করে আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের অদ্বিতীয় নজির স্থাপন করেন। যেমন-সনদে স্বাক্ষরকারী সব গোত্র-সম্প্রদায় ‘মদিনা রাষ্ট্রে’ সমান অধিকার ভোগ করবে, সব ধর্ম সম্প্রদায়ের স্ব স্ব ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে; কেউ কারও ওপর কোনোরূপ আক্রমণ করবে না, সন্ধিভুক্ত কোনো সম্প্রদায় বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে ওই আক্রান্ত সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করতে হবে এবং শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে, কোনো নাগরিক কোনো অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। বহু ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্রে মদিনার সনদ একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মদিনার সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তৎকালীন সমাজের গোত্রগুলোর অন্তর্কলহের অবসানসহ নৈরাজ্যমুক্ত, মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
কবি লেখেন,
' সম্পৃক্ত সত্যে তুমি মানুষ
মৌলিক,
যৌগিকও হতে পারো।
অনন্য অনুধ্যানে এই উপকরণ,
সম্পূর্ণ সংবাহনে শুদ্ধ সম্পর্কের চাষ করো তুমি
উর্বর মননে মনের অসীম মাঠে।
সাজুয্যে সমধিক ভোর রাতের অন্ধকার শেষে প্রেম কীর্তন করতে গেছে পৃথিবীর
পথে পথে।
বর্ধনে আর বিশ্লষণে তুমি মানুষ
মন্থনে আর মগ্নতায়, উন্নত
উপযোগক্রমে।'৮
সাম্প্রদায়িকতার নামে যারা বিশৃঙ্খলা করে তাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, যারা সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে এবং সাম্প্রদায়িকতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয় (আবু দাউদ)।’
কবি লেখেন,
' অমৃতের মন্ত্র দাও
হায় পিতা
উর্বরতা দাও আজ নিভৃত মননে
দাও ঝঞ্ঝা বারিপাত অন্ধকার বনে।
শোনাও ধূসর শেষে প্রত্যাশার গান
পৃথিবীতে বেঁচে থাক পরিশুদ্ধ
মানব সন্তান।'৯
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ইসলাম এতই সোচ্চার, রাসূল (সা.) নিজেদের জানমালের পাশাপাশি সংখ্যালঘু অমুসলিম সম্প্রদায়ের জানমাল রক্ষায় সচেষ্ট থাকার জন্যও মুসলমানদের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অন্য ধর্মাবলম্বী ও তাদের উপাসনালয়ের ওপর আঘাত-সহিংসতাও ইসলামে চিরতরে হারাম ও নাজায়েজ ঘোষণা করা হয়েছে।
.....................................
তথ্যসূত্র
১. মাওলানা মুহাম্মদ মহিল্লাবুল বাকী নদভী; ইসলাম ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি; Net, সর্বাধারে;
২. লেখক; তাৎক্ষণিক কবিতা;
৩. মতিলাল পটুয়া; তাৎক্ষণিক কবিতা;
৪. লেখক; তাৎক্ষণিক ছড়া;
৫. মতিলাল পটুয়া; তাৎক্ষণিক কবিতা;
৬. লেখক; তাৎক্ষণিক কবিতা;
৭. ইলা দাস, শুদ্ধিতে; এখানে বৃষ্টির শব্দ; দি ফিউচার পাবলিকেশান;২০০৭;
৮.লেখক; তাৎক্ষণিক কবিতা;
৯. আশিস সান্যাল; রক্ত ঝরে; একুশ শতকের কবিতা; মেইনস্ট্রীম পাবলিকেশন;২০১১;

