ভারতীয় সভ্যতা সৃষ্টিতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা, লেখক - মজিবুর রহমান,

 


ভারতীয় সভ্যতা সৃষ্টিতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা

মজিবুর রহমান, প্রধানশিক্ষক, কাবিলপুর হাইস্কুল

কাবিলপুর, মুর্শিদাবাদ, ৭৪২২৩৭


       বঙ্গদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান দুটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠী হল হিন্দু ও মুসলমান। বহুকাল ধরে এই দুই জনগোষ্ঠী পরস্পরের প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করছে। সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে সাধ্যমত অবদান রাখছে। ধর্মাচরণগত কিছু ভিন্নতা ছাড়া সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে হিন্দু-মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অথবা অধিকার ভোগে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। এটাই স্বাভাবিক। তবে অনাকাঙ্খিত হলেও হিন্দু-মুসলমানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ধারাবাহিকতা কখনও কখনও ধাক্কা খায়। মাঝে মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান পরস্পরের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। এটা অনেকটা পারিবারিক কলহের মতো। তবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের আর পারিবারিক অশান্তির অভিঘাত এক নয়। পারিবারিক ফ্যাসাদ আত্মীয়স্বজনদের ক্ষুদ্র স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হলেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পেছনে থাকে বৃহৎ ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্র সংঘটিত করার পেছনে আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে থাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে তারা মানুষের বহুমাত্রিক পরিচয়ের মধ্যে ধর্মীয় পরিচয়কে বেশি প্রাধান্য দেয়। হিন্দু ও মুসলমানকে দুটি পৃথক মনুষ্য গোষ্ঠী হিসেবে দেখাতে চায়। তাদেরকে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিপক্ষ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে। এই অপচেষ্টা কখনও কখনও সফল হয়। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ ও সংঘাত নয়, বন্ধুত্ব ও সমন্বয়ই ভারতীয় সভ্যতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। হিন্দুয়ানী আর মুসলমানী মিলে তৈরি হয়েছে বাঙালিয়ানা বা ভারতীয়ত্ব। সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি- সর্বক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনার সন্ধান পাওয়া যায়।

        বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ রচনা করেন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা। পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডার ভরিয়ে তোলেন হিন্দু ও মুসলমান সাহিত্যিকরা। মধ্যযুগের প্রধান সাহিত্য সম্পদ মঙ্গলকাব্য রচনা করেন বিজয় গুপ্ত, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ঘনরাম চক্রবর্তী, রামদাস আদক, ভারতচন্দ্র রায়, দ্বিজ মাধব ও দ্বিজ প্রভারাম প্রমুখ হিন্দু কবি।  বৈষ্ণব পদাবলী রচনাবলীর রচয়িতা বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাস নিশ্চিতভাবেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন। চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবিরাও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। ওই সময়কালের কয়েকজন প্রভাবশালী লেখক ও তাঁদের প্রধান পুস্তকের নাম হল: শাহ্ মুহাম্মদ সাগীর (ইউসুফ জুলেখা), সৈয়দ সুলতান (নবীবংশ, জ্ঞানপ্রদীপ, জ্ঞানচৌতিশা), দৌলত কাজী (সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী), সৈয়দ আলাওল (পদ্মাবতী), দৌলত উজির বাহরাম খান (লায়লী-মজনু, ইমাম বিজয়), শাহ্ গরীবুল্লাহ (আমির হামজা, সোনাভান, সত্যপীরের পুঁথি), মুহম্মদ খান (হানিফার লড়াই, সত্যকলি বিবাদ সম্বাদ), জৈনুদ্দীন (রসুল বিজয়), শেখ ফয়জুল্লাহ (গাজীবিজয়, সত্যপীরবিজয়, গোরক্ষবিজয়), দোনাগাজী চৌধুরী (সয়ফুল মুলুক-বদিউজ্জামাল), সাবিরিদ খান (রসুল বিজয়, হানিফা-কয়রাপরী, বিদ্যাসুন্দর) ও মুহম্মদ কবীর (মধুমালতী)। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ধর্মাশ্রয়ী কাব্য রচনার ধারায় পরিবর্তন আসে এবং প্রাকৃতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রভৃতি বহুবিধ বিষয় নিয়ে কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ লেখার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের মধ্যে জন্মগ্ৰহণ করেছেন এবং প্রয়াত হয়েছেন এমন কয়েকজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যস্রষ্টা  হলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, জীবনানন্দ দাশ, আশাপূর্ণা দেবী, বুদ্ধদেব বসু, সুকান্ত ভট্টাচার্য ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সমকালে সমরূপ সাহিত্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন মীর মশাররফ হোসেন (বিষাদ সিন্ধু, জমিদার দর্পণ, বসন্ত কুমারী), মহাকবি কায়কোবাদ যাঁর প্রকৃত নাম কাজেম আল কোরায়শী (বিরহ বিলাপ, মহাশ্মশান, কুসুম কানন), সাহিত্যরত্ন মোহাম্মদ নজিবর রহমান (আনোয়ারা, চাঁদতারা, প্রেমের সমাধি), মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক (কুসুমাঞ্জলি, প্রেমাহার, তাপস কাহিনী), আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (বাঙালা প্রাচীন পুথির বিবরণ), সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (অনল-প্রবাহ, রায়নন্দিনী, তারাবাঈ), বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (মতিচূর, সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ), কাজী ইমদাদুল হক (আঁখিজল, প্রবন্ধমালা, কামারের কাণ্ড), মোহাম্মদ লুৎফর রহমান (সরলা, পথহারা, রায়হান), শেখ ওয়াজেদ আলী (জীবনের শিল্প, প্রাচ্য ও প্রতীচ্য, বাদশাহী গল্প), শাহাদাৎ হোসেন (মরুর কুসুম, সোনার কাঁকন, যুগের আলো), কাজী আবদুল ওদুদ (শাশ্বত বঙ্গ, সমাজ ও সাহিত্য, হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ), গোলাম মোস্তফা (বিশ্বনবী, হাসনাহেনা, রূপের নেশা), পল্লীকবি জসীমউদ্দীন (নকশী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, বালুচর), সৈয়দ মুজতবা আলী (অবিশ্বাস্য, দেশে বিদেশে, চাচা কাহিনী) ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। একবিংশ শতাব্দীতেও হিন্দু-মুসলমানের যৌথ নেতৃত্বে বাংলা সাহিত্যের অগ্ৰগমন অব্যাহত রয়েছে। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া হিন্দু লেখকরা হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ অথবা প্রচার করার দায় কাঁধে নিয়ে লেখেন না। একইভাবে মুসলমান সাহিত্যিকরাও লেখনীকে শরীয়তসম্মত করার দায় অনুভব করেন না। হিন্দু ধর্মের বেদ, পুরাণ, উপনিষদ, রামায়ণ ও মহাভারত সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকলে মুসলমান বিদ্বজ্জনদের সৃজনশীলতার চর্চা সুসম্পন্ন হতে পারে না। অনুরূপভাবে, ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সমাজ সম্পর্কে জানতে উদ্যোগী হয়েছেন এবং তৎসম্পর্কিত গ্ৰন্থ রচনা করেছেন রাজা রামমোহন রায় (তুহফাত-উল-মুয়াহিদ্দীন), কেশবচন্দ্র সেন (হাফেজ), গিরিশচন্দ্র সেন (কোরানের প্রথম বঙ্গানুবাদ করেন), বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের পিতা দ্বিজদাস দত্ত (ইসলাম), কৃষ্ণকুমার মিত্র (মহম্মদ-চরিত), দীনেশচন্দ্র সেন (প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান), ঐতিহাসিক রামপ্রাণ গুপ্ত (হজরত মোহাম্মদ), ক্ষিতিমোহন সেন (ভারতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা) ও মানবেন্দ্র নাথ রায় (ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান) প্রমুখ স্বনামধন্য হিন্দু ব্যক্তিগণ। বঙ্গ বিভাজনের পর পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুরা আর পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশে মুসলমানরা সাহিত্য সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অর্থাৎ, বঙ্গ সাহিত্যের সমৃদ্ধিতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রয়েছে।

         হিন্দুধর্মে কোনো ছুৎমার্গ না থাকলেও সংগীত কলা চর্চাকে ইসলাম ধর্মে অনুৎসাহিত করা হয়। কিন্তু ধর্মীয় বাধা সত্ত্বেও সংগীত জগতে মুসলমানদের অবদান বিস্ময়কর। ক্ষিতিমোহন সেন লিখেছেন, "সেতার, রবাব, সুরশৃঙ্গার প্রভৃতি অপূর্ব সব তন্ত্রীবাদ্য মুসলমানেরাই ভারতে প্রবর্তিত করেন।...নহবতের বাদ্যও মুসলমানদের দেওয়া।" হিন্দু শাসকদের মতো মুসলিম শাসকদের দরবারে নিয়মিত সংগীতের আসর বসতো। রাজতন্ত্রের অবসানে সঙ্গীত সাধারণ মানুষের উপভোগের বিষয় হয়ে উঠেছে। গীতিকার, সুরকার ও গায়ক- সংগীতের প্রধান তিন শাখাতেই হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থান সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রসঙ্গীত আর নজরুলগীতি বাংলার সঙ্গীত জগতের চিরকালীন সম্পদ। সানাই বাদক ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান এবং সেতার বাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর দুজনেই 'ভারতরত্ন'। লতা মঙ্গেশকর, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতোই কিংবদন্তি গায়ক হলেন মহঃ রফি, তালাত মাহমুদ, আব্বাস উদ্দিন। হিন্দি সিনেমার জগতে রাজ কাপুরের পাশাপাশি ইউসুফ খানের (দিলীপ কুমার) নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। একবিংশ শতকেও সিনেমা ও সঙ্গীতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনায় কোনো ঘাটতি লক্ষ্য করা যায় না। আসলে গায়ক-অভিনেতাদের কোনো জাত নেই। তাঁরা বিনোদন যোগান দেন। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই তা উপভোগ করে।

          চিত্রশিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রেও ধর্মীয় বাধা অতিক্রম করে মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গী হয়েছে। মোগল দরবারে চিত্রশিল্পীদের যথেষ্ট সমাদর ছিল। চিত্রশিল্পীরা প্রাসাদের গায়ে ও পুস্তকের পাতায় প্রাকৃতিক দৃশ্য ও ঐতিহাসিক আখ্যান আঁকতেন। পরবর্তীকালে মুসলিম চিত্রশিল্পীরা হিন্দু চিত্রশিল্পীদের মতোই পশুপাখি, মানুষ ও দেবদেবীর চিত্র অঙ্কন করেন। ব্রিটিশ আমলে জন্মগ্ৰহণ করেছেন কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার পর প্রয়াত হয়েছেন এমন কয়েকজন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী হলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, গণেশ পাইন, জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সৈয়দ মোহাম্মদ সুলতান ও মকবুল ফিদা হুসেন। আসলে শিল্পীর প্রতিভা জাত-ধর্ম নিরপেক্ষ হয়ে থাকে এবং ধর্মীয় বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে কঠোর পরিশ্রম ও অনুশীলনের মাধ্যমে সহজাত প্রতিভার প্রমাণ দিতে হয়।

          ভারতীয় সভ্যতায় মন্দির, মসজিদ, প্রাসাদ, স্মৃতিস্তম্ভ ও দুর্গের সমন্বয়ে সমৃদ্ধ স্থাপত্যশিল্প গড়ে উঠেছে এবং এক্ষেত্রেও হিন্দু-মুসলমান দুইয়েরই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। একদিকে যেমন অজন্তা ও ইলোরা গুহা এবং কোনার্কের মন্দির হিন্দু স্থাপত্যশিল্পের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে বিরাজ করছে অন্যদিকে তেমনি তাজমহল, কুতুব মিনার, লালকেল্লা ও হাজার দুয়ারী ইসলামিক স্থাপত্যশিল্পের অনুপম নিদর্শন বহন করছে। দেশি-বিদেশী পর্যটকরা প্রাণভরে পরিদর্শন করছেন এই সমস্ত পর্যটনকেন্দ্র। 

         ভারত শাসক হিসেবেও হিন্দু-মুসলমান উভয়কেই পেয়েছে।  হিন্দু ধর্মাবলম্বী হিসেবে গুপ্ত সাম্রাজ্য তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী এবং সেন বংশ একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত উপমহাদেশে শাসন ক্ষমতা ভোগ করেছে। এর পর ভারতে মুসলিম শাসনের সূচনা হয় এবং তা ঊনবিংশ শতকের পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত বলবৎ থাকে। কোনো আমলেই সেনাবাহিনীতে ও রাজকর্মচারী হিসেবে ভিন্ ধর্মের মানুষদের নিয়োগে কেউ কখনও আপত্তি করেনি। ধর্ম নয়, দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ হয়েছে। ধর্মীয় কারণে বিশ্বাসঘাতকতা করার কোনো দৃষ্টান্ত নেই। হিন্দু শাসকরা যেমন শাসনকার্যে বেদ, পুরাণ, গীতা অথবা সংহিতা অনুসরণ করেননি তেমনি মুসলিম আমলেও দেশ শাসনে কোরআন-হাদীস অনুসৃত হয়নি। রাজা-বাদশারা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নিজেদের মতো করে বিধি বিধান রচনা করেছেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই একই শাসনব্যবস্থার অধীনে থেকেছে। প্রজারা স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করেছে। হিন্দু রাজা অথবা মুসলমান বাদশার ধর্ম বাধ্যতামূলকভাবে প্রজাদের ধর্ম হয়ে ওঠেনি। ভারত কখনও হিন্দু রাষ্ট্র অথবা মুসলিম দেশে পরিণত হয়নি। ব্রিটিশ শাসনের সময় স্বাধীনতার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার পরিবর্তে  কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন মুসলমানদের যাবতীয় অধিকার খর্ব করে হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করার পরিকল্পনা করে। একইভাবে কিছু মুসলিমবাদী সংগঠন হিন্দুদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ইসলামিক রাষ্ট্র গঠনের দাবি তোলে। ব্রিটিশ শাসনের অবসানে ভারত ভাগ হয়। কিন্তু এই বিচ্ছেদমূলক পরিণতি ছাড়া ভারতের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু-মুসলমানের যৌথ অংশগ্রহণের একটা উজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। দেশপ্রেম প্রদর্শনে হিন্দু-মুসলমান উভয়েই বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। উভয় ধর্মের অগণিত মানুষ অহিংস ও সহিংস আন্দোলনে সামিল হয়েছে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে মঙ্গল পান্ডে, নানা সাহেব, তাঁতিয়া টোপি, লক্ষ্মীবাঈরা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। এই বিদ্রোহকে গণ অভ্যুত্থান অথবা জিহাদ আখ্যা দিয়ে তাতে সকল মুসলমানকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান ফজলে হক খয়রাবাদী, সরফরাজ আলী, সদরুদ্দিন খান প্রমুখ ত্রিশজন আলেম বা মুসলিম পণ্ডিত। সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক আলিমুল্লাহ খান তৈরি করেন দেশাত্মবোধক স্লোগান- 'মাদর-এ-ওয়াতন হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ' অর্থাৎ মাতৃভূমি হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ। লাজপত রায়, গঙ্গাধর তিলক, বিপিনচন্দ্র পাল, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, মোতিলাল নেহরু, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাশ, জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ ও সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। অনুরূপ ভূমিকা পালন করেন হাকিম আজমল খান, আব্দুল গাফফার খান, আবুল কালাম আজাদ, মহম্মদ আলী, শওকত আলী, রফি আহমেদ কিদওয়াই, সাইফুদ্দিন কিচলু ও অরুণা আসফ আলী। ১৯২১ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে মাওলানা হসরৎ মোহানী প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেন। তিনিই 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' স্লোগানটির জনক। আজাদ হিন্দ ফৌজের মেজর আবিদ হাসান সাফরানি 'জয় হিন্দ' স্লোগানের প্রবর্তক। সুবিখ্যাত দেশাত্মবোধক সঙ্গীত 'সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা' রচনা করেন কবি মুহম্মদ ইকবাল। দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেন ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী, বিনয়-বাদল-দীনেশ, যতীন দাস, মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, চন্দ্রশেখর আজাদ ও রামপ্রসাদ বিসমিল প্রমুখ অসংখ্য হিন্দু বিপ্লবী। একই উদ্দেশ্যে শহীদের মৃত্য বরণ করেন মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি যিনি সুভাষচন্দ্র বসুর মহানিষ্ক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, আহমাদুল্লাহ, মাওলানা রশিদ আহমদ, নাসিম খান, কুদরাতুল্লাহ খান, গোলাম মাসুম, শিশু খান, শের আলী, মহম্মদ আব্দুল্লাহ ও আসফাকউল্লা খান প্রমুখ অজস্র মুসলিম বিপ্লবী। বিপ্লবীরা অবশ্য তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়কে কখনও মুখ্য করেননি, তাঁদের মনে ও মগজে শুধু দেশের কথাই থেকেছে। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অহিংস ও সহিংস আন্দোলনের দীর্ঘ অধ্যায় অতিক্রম করে ভারত প্রায় আট দশক হল স্বাধীন হয়েছে। দেশের সংবিধান ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বাছবিচার করেনি। ভারত গড়ার কাজে সংখ্যাগুরু হিন্দু জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে, এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ধর্মীয় কারণে দেশের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে কোনো সম্প্রদায় কখনও অবহেলা করে না। 

            ভারতীয় সভ্যতা সৃষ্টিতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনার কোনো বিরাম নেই। মাঝে মধ্যে যে বিচ্যুতি ঘটে তাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। 'জাতের নামে বজ্জাতি' বরদাস্ত করা চলবে না। রাজনীতির ধর্মীয়করণ এবং ধর্মের রাজনীতিকরণের বিপদটা বুঝতে হবে। রাজনীতি ও ধর্মের মিশেল আটকাতে হবে। ধর্মকে ব্যক্তিগত পরিসরে আবদ্ধ রাখতে হবে। ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির প্রতিবাদ করতে হবে। মসজিদ-মন্দির ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে নাগরিকদের কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান সব ক্ষেত্রেই হিন্দু ও মুসলমান একই পথের পথিক। মুসলিম শাসনে মুসলিম সমাজের দারুণ উন্নতি হয়েছে অথবা হিন্দু শাসনে হিন্দু সম্প্রদায় উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেছে, ইতিহাস এমন সাক্ষ্য দেয় না। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুন্নয়নের জন্য মুসলিম সমাজকে অথবা মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার জন্য হিন্দুদের দায়ী করা যায় না। হিন্দু-মুসলমানের যৌথ প্রয়াস ও অংশগ্রহণের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের সামগ্ৰিক উন্নয়ন হয়ে থাকে। 'সকলের তরে সকলে আমরা/প্রত্যেকে আমরা পরের তরে'- এই প্রবাদটি হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কোনো একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে পেছনে ফেলে রাখার চেষ্টা হলে তার ফলও সুখকর হয় না। আমরা এমন উপলব্ধির সমর্থন পাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায়- "যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে/পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।" ভারতের মুক্তি ঘটাতে স্বামী বিবেকানন্দ চেয়েছিলেন 'বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ'। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, "মোরা এক বৃন্তে দু'টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান। মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।" হ্যাঁ, ভারতীয় সভ্যতার দীর্ঘ জীবনের জন্য হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url