প্রবন্ধ: সমবায়, স্বনির্ভরগোষ্ঠী ও নারী ক্ষমতায়ণ, লেখক - ড. মনোরঞ্জন দাস

 


 সমবায়, স্বনির্ভরগোষ্ঠী ও নারী ক্ষমতায়ণ

ড. মনোরঞ্জন দাস


            সমবায় কথার অর্থ সমান ভাবে বহন, বিশেষত লাভ-লোকসান, ভালো-মন্দ, ক্ষমতা-অক্ষমতা, উন্নতি-অবনতি, সুখ-দুঃখ, সবকিছুই একসঙ্গে থেকে সমান রূপে বহন করা। সমবায় একটি ব্যবসাভিত্তিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে কিছুসংখ্যক সদস্য পারস্পরিক ও পরম্পরিকভাবে

 গোষ্ঠীবদ্ধ স্বার্থ, মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য স্বেচ্ছায় একত্রিত হয়ে কর্ম করে , যা সাধারণত একটি নির্দ্দিষ্ট উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। সমবায়ে সবাই নিজ নিজ ইচ্ছায় যোগদান করে এবং বিচ্ছিন্ন হয়। সমবায়ে সবাই ব্যবসা, উৎপাদন, বিপণন, সঞ্চয়, ঋণদান, ঋণশোধ, অর্থনৈতিক কার্যকলাপে গনতান্ত্রিকভাবে যুক্ত থাকে। একটি কবিতা,


'সমবায়ে ঋদ্ধ হও, শুদ্ধ হও, একথাটাই শেখা।

দৌড়ে হেঁটে, একথাটাই, বললে পিসি, রেখা।।


দিন থেকে দিন, বুঝে বুঝে, কাজটা করা চাই।

কর্মই হল আসল কথা, তার তুলনা নাই।।


সমবায়ে থাকি মোরা, আনন্দেতে মাতি।

সমবায়ে মনটা রেখে, ভাবি দিবারাতি।।'


কুটির শিল্পে মোদের কাজ, স্বাধীন মোরা ভাই।

গৃহ শিল্পে মত্ত থেকে, মোরা, মোটা ভাত পাই।।


ক্ষদ্রায়ণের আয়োজনে, মোরা বেশ আছি।

সময়ধারায়, স্রোত-মাঝে ,

এম্নি ক'রে বাঁচি।।


ক্ষুদ্র-গ্রামীন শিল্প মোদের, ঘরে বসেই কাজ।

মনটা দিয়ে কর্ম করি, সকাল 

 থেকে সাঁঝ।।'১

            আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে নারী আর পুরুষের ওপর নয় বরং সে স্বয়ংসম্পূর্ণ  

হয়ে রোজগার করে পুরুষকে 

অর্থনৈতিক সহযোগিতা করে থাকে। এক্ষেত্রে সে সমবায়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে যুক্ত হয়ে পরিশ্রম করে উপার্জন করে। এতে নারীজাতির চিত্তোন্মেষ ঘটলো। তারা আরো সমৃদ্ধ হলো, ক্ষমতাবতী হলো ও বিকশিত হলো।

       বর্তমান বিশ্বে নারী ক্ষমতায়ণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ক্ষমতায়ণ হলো,অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিপার্শিক, রাজনৈতিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক,পারিবারিক ও সার্বিক ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা ও অধিকারের সন্নিবেশ। এক্ষেত্রে নারীরা তাদের নিজস্ব ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধ প্রতিবাদ জানিয়ে নিজের ক্ষমতা ও অধিকার বুঝে নিতে চাইছে। সুতরাং সমাজ নিরিখে নারী ক্ষমতায়ণ এক বহুমুখী প্রক্রিয়া। এ প্রসঙ্গে, অমর্ত্য সেন বলেছেন যে কার্যক্ষেত্রে নারী জাতির জগৎ সংসারে ভূমিকা যত সংকীর্ণ হবে, ততই তা নারী পুরুষ নির্বিশেষে শিশু ও বয়স্ক সবার ওপরই মন্দ প্রভাব বয়ে আনবে। নারী ক্ষমতায়ণের ফলে নারীদের সার্বিক দ্ক্ষতাও বৃদ্ধি পাবে।২

              নারী ক্ষমতায়ণ হলো এমন একটা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ঐ ব্যক্তিত্বটি অন্যের নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে এমন এক সামর্থ , স্বক্ষমতা ও দক্ষতা অর্জন করবে যা তার নিজস্ব পছন্দ ও ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করে। সেজন্য ক্ষমতায়ণকে দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তির আত্মনির্ভরশীলতার পথ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। 

তবে ক্ষমতায়ণ প্রক্রিয়া জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তনের পাশাপাশি আর্থসামাজিক ও সার্বিক পরিবর্তনের সাথে সামগ্রিকভাবে যুক্ত। এজন্য নারীর ক্ষমতায়ণকে এক বহুমূখী, বহুগামী ও বহুস্তরীয় পরীক্ষা হিসাবে ধরা হয়। নারীর ক্ষমতায়ণ সম্পর্কে মনে রাখতে হবে, নারীর বঞ্চনা, লিঙ্গ বৈষম্য, নানাবিধ সামাজিক শোষণ, প্রতিকুল জীবনযাত্রার মান এবং আরও কিছু আনুসঙ্গিক

 বিষয়।

            নারী আন্দোলন ১৮৫০ শুরু হয়। ১৯২০সালে ২৬ অগাস্ট মার্কিন কংগ্রেসে নারীর ভোটাধিকার '১৯-তম' সংশোধনী বিল পাশ হয়। ভারতীয় নারীরা ভোটাধিকার পায় ১৯২১ সালে। এই ভোটাধিকার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের পদচারণার দ্বার খুলে দেয়। ১৯৬০ সাল থেকে নারীরা সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষম হতে থাকে। চিরায়ত গন্ডীর বাইরে যখন নারীরা পদচারণ শুরু করে তখনই ঘটলো  উন্নয়ণে নারীর অংশগ্রহণ'।৩

         প্রকৃত নারী প্রগতি ও ক্ষমতায়ণের জন্য অমর্ত্য সেন দুটি বিষের ওপর জোর দিয়েছেন।সেগুলি হলো, ক) নারীদের মধ্যে স্বাক্ষরতা ও শিক্ষার প্রসার; খ) নির্দ্দিষ্ট মজুরির বিনিময়ে বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ এবং সেই সূত্রে আর্থিক সয়ম্ভরতা অর্জণ ।হলেই নারীর ক্ষমতায়ণের ছবিটি ধীরে ধীরে সুস্পষ্ট হবে। নারীর ক্ষমতায়ণের প্রশ্নে তিনটি মাত্রা বা অবস্থা অত্যন্ত জরুরি, যেমন, নিজের বেঁচে থাকার ক্ষমতা,  নিজে শ্রম শক্তির যথার্থ ও সার্থক প্রয়োগ এবং নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা। অপরপক্ষে বলা যায়, নারীর ক্ষমতা তিনটি শাখায় বিকশিত হয়। সেগুলি হলো, ক)অর্থনৈতিক খ) সামাজিক গ)রাজনৈতিক;


ক) অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ণ

         দারিদ্র মোচনের জন্য নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ণ এবং সমবায় ভিত্তিক স্বনির্ভরতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষভাবে বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক এবং ভারতে  স্বয়ম্ভর প্রকল্প নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ণে সহায়ক হয়েছে। ভারতে প্রায় ৮  লক্ষ স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী ও সমবায় ব্যাঙ্ক নারীদের সংযুক্তি প্রকল্পে প্রায় ৪২ কোটি দরিদ্র পরিবারকে দারিদ্র মুক্ত করেছে । এসব ক্ষেত্রে নারীদেরকে নিছক বেতনভোগী হিসাবে নয়, বরং বহু ক্ষেত্রে নারী ও তার নিজের পরিবারকে স্বনির্ভর প্রকল্পে যুক্ত হবার পথ দেখিয়েছে।৪

            খ) সামাজিক ক্ষমতায়ণ

              আর্থিক ক্ষমতায়ণ মানে সামাজিক ক্ষমতায়ণ নয়। পুরুষের স্বাপেক্ষে পারিবারিক পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ণ প্রসঙ্গে প্রথমে উল্লেখ করতে হয় পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা, ঘরে বাইরে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে যাবার ব্যাপারে তাঁর স্বাধীনতা। এছাড়াও অন্যান্য যে সব পরিমাপকগুলি বিবেচিত হয়ে থাকে, সেগুলি হলো, পুত্রকন্যার পড়াশুনার ব্যাপারে নারীর মতামত, সাধারণভাবে শিক্ষা, গনমাধ্যম, কর্মসংস্থান, সামাজিক মেলামেশা ইত্যাদির ক্ষেত্রে নারীর প্রবেশাধিকারের সীমারেখা।৫

          গ) রাজনৈতিক ক্ষমতায়ণ

             নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ণের প্রশ্নটি যুগপৎ সাধারণ আর্থিক , সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষণের ওপর নির্ভরশীল। পঞ্চায়েত, পৌরপ্রশাসন-সহ  তৃণমূল স্তরে  গত দুই দশকে নারীর অধিকতর আনুপাতিক রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব স্বীকৃত হয়েছে। এটাও বলা যায়, নারীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ, নারীর সমঅংশ গ্রহণের একটি দরকারী পূর্বশর্ত। এই কারণে ভারতীয় সংবিধানে ৭৩ এবং৭৪-তম সংশোধনী সৃত্রে স্থানীয় ও পৌর স্বায়ত্ব শাসনে নারীর প্রতিনিধিত্বমূলক প্রবেশাধিকার স্বীকৃত হয়েছে এবং নারীর ব্যক্তিসত্বার বিকাশ এবং স্বয়ংম্ভরতা সৃষ্টির প্রয়োজন নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ।৬

           পরিশেষে বলা যায়, এযুগে নারীগন শিক্ষা ও সংগ্রামের মাধ্যমে নিজ ক্ষমতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা

করে সমবায়ের তীর্থে 

স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে একীভৃত হয়ে সংসারকে অর্থনৈতিক উন্নতিতে সাহায্য করছে।

...............

 তথ্যসূত্র

১. ইমনকল্যাণ দাস; তাৎক্ষণিক কবিতা;

২. রামকৃষ্ণ জানা; পশ্চিম বঙ্গে সমবায় ও স্বনির্ভরগোষ্ঠীর ইতিহাস পর্যালোচনা: পশ্চিম মেদিনীপুরের স্বনির্ভরগোষ্ঠী 

    ৩ .ঐ;

     ৪.ঐ;

     ৫. ঐ;

     ৬.ঐ ;

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url