Header Ads

গল্প - পুনর্বিবাহ, লেখক - সৈয়দ হুমায়ুন রাণা



পুনর্বিবাহ

সৈয়দ হুমায়ুন রাণা 


শৈলেন বাবার সঙ্গে রাগারাগি করে বাড়ি ছাড়লো। ছেলেটা কোথায় গেল, কী করছে; কী খাচ্ছে ভেবে মা-বাবার ক্ষিধে, ঘুম টুটেছে। মা কুসুমরানীর কেঁদে-কেঁদে বেহাল দশা। দশটা নয়, পাঁচটা নয়- ওদের একমাত্র ছেলে শৈলেন। সুতরাং, বাবা পাষান মনের হতে পারলেও, মা কী পাষান হতে পারে। ছেলের সব বায়না সবসময় মেনে নেওয়া যায়না। সুমনবাবু তাই একটু ছেলেকে বকেছিলেন। তাতেই শৈলেন বাবার প্রতি অভিমানে বাড়ি ছেড়েছে।


সুমন অধিকারী শহরের নামকরা ব্যারিস্টার। লোকে এক ডাকে তাঁকে চেনে। অর্থকড়ি, নাম যশ-প্রতিপত্তিতে কম যাননা। তবুও ছেলের একটা আব্দার তিনি রাখতে পারেননি। সে একটা আইফোনের আব্দার করেছিল বাবার কাছে। সুমনবাবু এক কথা না করে দিয়েছিলেন। তিনি ছেলেকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, "তুই মাধ্যমিক পরীক্ষাটা ভালো করে দে। আমাকে প্রথম বিভাগে পাশ করে দেখা তারপর আইফোন কেন, বাইক চায়লেও তাই দেব। তবে এখন নয়, তাতে পড়াশোনার ক্ষতি হবে। আমি তো বাবার কাছে একটা সামান্য ফোনও পাইনি। তোর তো আমি কোনো অভাব রাখিনি বাবা তারপরেও"-ছেলে রাগ দেখিয়ে বলেছিল- "ছাড়ো তো তোমার ঘ্যানঘ্যানানি! তোমাদের সময় ছিল আলাদা তখন কী আইফোন, কম্পিউটার বাজারে এসেছিল? এখন এসব না হলে লেখাপড়ায় হবেনা।"


সুমনবাবুও রাগান্বিত স্বরে বলেছিলেন: "তোর তো কম্পিউটার আছে, তাতেই তো সব পাবি এখন অযথা লাখ টাকা খরচ করে আইফোনের কী প্রয়োজন?"


শৈলেন বাবার সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছিল। সুমনবাবু রেগে গিয়ে ছেলেকে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিয়েছিলেন। চিৎকার করে বলেছিলেন;" ইডিয়ট অভদ্রতার সীমা থাকা প্রয়োজন, তুই সেটা লঙ্ঘন করেছিস। বাবার মুখের উপর তর্ক? অভদ্র ছেলে কোথাকার।"ছেলেও বাবাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছিল, "প্রয়োজন নেই তোমার মত হাড়কিপটে বাবার কাছে আইফোন নিয়ে। আমি নিজেই কিনবো।" কথাটি বলে শৈলেন হনহন করে নিজের ঘরের দিকে দ্রুত চলে গেল। কুসুমরানী রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে সামনে স্বামীকে দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করলেন" কী ব্যাপার গো? তোমাদের বাপ-ব্যাটার ঝগড়া হয় কেন?" সুমনবাবু সে কথার প্রত্যুত্তর না দিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করলেন।


।। দুই ।।


শৈলেন বাড়ি থেকে পালিয়ে সোজা কোলকাতাগামী ট্রেনে চড়ে বসেছিল। ওর মনে প্রচন্ড দুঃখ-ক্ষোভ জমা হয়েছিল। জানালার ধারে গালে হাত রেখে বসেছিল। পলাশীতে ট্রেন এসে দাঁড়াতে, হৈ-চৈ করে কয়েকজন মেয়ে-মরদ চাপলো। ওরা ব্যবসায়ী দেখে অনুমান করা যাচ্ছিল। শৈলেনের পাশেই এসে বসলো সবাই। কিছু পরে একজন কালোকোটপরা টিকিট পরীক্ষক সেই কামরায় উঠলেন। ব্যবসায়ীদের একজন বললো, "মামা উঠেছে রে, টিকিটগুলা বাহির করে রাখ দেখাবি।" শৈলেন বুঝলো টিকিট পরীক্ষকের আগমনের কথা। সে টিকিট কাটেনি। সুতরাং, শৈলেন সটান গিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো।


বেশকিছুক্ষন হলো, শৈলেন বাথরুম থেকে বেরোয়নি। সে টিকিট পরীক্ষকের চলে যাবার অপেক্ষায় ছিলো। ইতিমধ্যে একজন যাত্রী ব্যস্তসমস্তভাবে এসে বাথরুমের দরজায় ঘা মারলো। কয়েক মিনিট ব্যবধানে দরজায় ব্যস্তভাবে ঘা মারছিলো। সে বাইরে দাঁড়িয়ে পেট ধরে ঘামছিলো। মনে হচ্ছে, বেগ সামলাতে পারছেনা।


বেশ কিছু পরে শৈলেন বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। লোকটি রীতিমতো ওর সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দিলো। সে ঝাঁঝের সঙ্গে বললো: টিকিট কাটবেনা, চেকার দেখে বাথরুমে লুকাবে যতসব! আমি আমাশয় রুগী... বলতে, বলতে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো। শৈলেন চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। কথাগুলো হজম করছিলো বাধ্য ছেলের মতো। লোকটি চলে যেতে নিজের সিটে এসে বসলো। একজন মহিলা হেসে প্রশ্ন করলোঃ"টিকিট কাটোনি তাইনাগো ছেলি?' সে মাথা নত করে বসেছিল। ব্যবসায়ী মহিলাটি পুনরায় বললো:-"ইখানে বলে অক্ষা পেলে, শেলদায় সুজা হাজতে ঢুকিন দিবে। ও ছেলি, তুমি কুথা যাবেগো?" -"কোলকাতা।' শৈলেন ম্লান কন্ঠে উত্তরে বললো। ওদের মধ্যে একজন লোক বললো "ঠিক আছে ভয় নাই। আমরা তুমাকে ঠিক পার করিন দিব। শৈলেন নিঃশ্চিন্ত হলো। ওর মন ভালো নেই। জানালার বাইরে একদৃষ্টে চেয়ে বসেছিল। ব্যবসায়ীগুলো নিজেদের মধ্যে হাসিতামাশা করছিলো। উচ্চকণ্ঠে হাসছিলো। শৈলেনের সেসব অসহ্য লাগছিল। সে ভাবছিলো মায়ের কথা। ওকে ছেড়ে কুসুমরানী একদিনও কোথাও থাকেনি। ছেলে অন্ত প্রাণ। তাই। মায়ের কথা ভেবে বড় কষ্ট হচ্ছিলো মনে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা।


।। তিন।।


বেশ রাত্রি করে ট্রেনটি শেয়ালদা ঢুকলো। শৈলেনের সঙ্গে ব্যবসায়ীগুলোর ইতিমধ্যে-পরিচয় হয়েছে। ওরা তাকে রুটি তরকারী খাইয়েছিল। শৈলেন ওদের কাছে গল্প ফেঁদে বলেছিল, সৎমায়ের জ্বালাতনে বাড়ি ছেড়েছে। মহিলাদের সমবেদনা পেয়েছে। ব্যবসায়ীগুলো সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ট্রেন থেকে নামতেই, একজন মহিলা: শৈলেনের হাত ধরে বললো "এতো রাতে তুমি কুথা যাবাগো ছেলি? এসো আমাদের সাথে আমরা স্টেশানেই ঘুমাব। সকালে যেখানে খুশি যেও।" শৈলেন রাজি হলো ওদের সঙ্গে যেতে।খুব সক্কালেই ওরা স্টেশন ছেড়ে বড়বাজারের দিকে রওনা দিলো। শৈলেনকেও বাইরে ছেড়ে দিলো। ব্যবসায়ীদের একজন কালু বললো: "তুমায় যদি কুনু অসুবিধ্যা হয়, এইখানেই অপেক্ষা কোরো। আমরা দু/তিন ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসবো। তুমাকে আমাদের বাড়ি লিয়ে যাব। চিন্তা করিওনাগো ছেলি।" কালুর কথায় অন্যেরাও সম্মতি জানালো।। ওরা চলে গেলে, শৈলেন ধীরে, ধীরে কোলকাতার রাজপথে পা বাড়ালো।


শীতের সকাল। কুয়াশাচ্ছন্ন কোলকাতা নগরী। রাজপথে তখনও কোনো গাড়ি চলাচল করছেনা। শৈলেন ধীরে, ধীরে এগিয়ে গেল স্টেশান চত্বর ছেড়ে। সে কোলকাতার কিছুই চেনেনা, জানেনা। শৈলেনের এক কাকু কোলকাতায় বড় একটি সরকারী চাকুরে। কোথায় থাকেন, তাও জানেনা। সে উদ্দেশ্যহীনভাবে এগলি, ওগলি ঘুরছিল। একটা বড় হোটেলের নীচে, একজন বেবুশ্যে দাঁড়িয়েছিল। শৈলেনকে হাতের ঈশারায় কাছে ডাকলো। সে এমন মেয়েছেলে আগে কখনও দেখেনি। পাড়াগাঁয়ের ছেলে।ও এগিয়ে যেতেই খপ করে হাত ধরলো। পকেটে হাত ঢুকিয়ে চিরুনি বের করে নিলো। বেবুশ্যে মাথা আঁচড়াতে, আঁচড়াতে বললো: "যাবে নাকি গো?" -"কোথায়?"


-"এমা কিছুই জানেনা নেকামি করছো বুঝি!!" কথাটি বলে সে শৈলেনকে জড়িয়ে ধরে, পকেট হাতড়িয়ে একশো টাকার নোটটি বের করে নিল। শৈলেন বাধা দিতে গেলে বিশ্রী গালি দিয়ে বললোঃ "সোজা রাস্তা নাপ বোকা-দা নইলে গলায় ক্ষুর মেরে মাটিতে শুইয়ে দেব। শৈলেনের মুখ শুকিয়ে গেছে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একছুটে পালিয়ে এলো সেখান থেকে। ওর মনে ভয় ঢুকে গেছে। এমন অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম। এমন নিষ্ঠুর শহরের কথা সে জানতোনা। কোলকাতায় চাকরি পাওয়া যায়, কাজ পাওয়া যায় শুনেছিল। কিন্তু, এই বেবুশ্যে মেয়েদের কথা কারোর কাছে শোনেনি। শৈলেনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে ধীরে, ধীরে স্টেশানে ফিরে এলো। একটা কাঠের বেঞ্চে বসলো।পেটে ছুঁচোর কেত্তন চলছিল। শৈলেনের কাছে টাকা ছিলোনা। শীতবস্ত্র ছিলোনা। ক্রোধে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা। তারও ছিলোনা। এখন শীত লাগছে, ক্ষিধেও লেগেছে। বুকে দুইহাত জড়ো করে, শৈলেন স্টেশানের ট্যাপকল থেকে আঁচলা ভরে জলপান করলো। তারপর পুনরায় সেই বেঞ্চে এসে বসলো। মনটা বাড়ির জন্য খারাপ। কিন্তু অভিমানটা তখনও ফুঁশছিল।


শৈলেন বসেছিল, কিছুক্ষন পরে কালুর সঙ্গীসাথীরা ফিরে এলো। কালু বিস্মিত হয়ে বললোঃ "কিগো ছেলি বসি আছো? কিছু খেয়িছ নাকি গো?" শুকনো মুখে শৈলেন উত্তর দিল: "না, কিছু, খাইনি।"


'এত বেলা হয়িন গেল তবু খাওয়া হয়নি? এসো, এসো রুটি ঘুগনি খাবে, আমার সঙ্গে এসো।"কালু ওকে কাছি একটা স্টলে কাছাকাছি নিয়ে গেল খাওয়াতে। সবাই যেন শৈলেনের জন্য বিচলিত। ওকে একা ছেড়ে দেওয়া যাবেনা। মা-মরা ছেলে হাহারে!


।।চার।।


শৈলেন বীরপুরে কালুদের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। ব্যবসায়ীগুলো সবাই তার দায়িত্ব নিয়েছে। একটা ভদ্রলোকের শিক্ষিত ছেলে অশিক্ষিত, গরীব ঘরে বসবাস করলে, গ্রামের মানুষজনের কাছে ব্যাপারটা বৈসাদৃশ্য ঠেকে। অনেকে অনেকরকম প্রশ্ন করে। কথাটা নীলকান্ত রায়ের কানেও গেল। তিনি মস্ত বড়লোক একজন ব্যবসায়ী। কোলকাতার বড়বাজারে তাঁর রমরমিয়ে ব্যবসা চলে। কালুরা নীলকান্তবাবুর আন্ডারে কাজ করে। তাঁর দোকান থেকে হরেকরকম ব্যবহার্য্য জিনিষপত্তর নিয়ে এসে গ্রামে, গ্রামে ফেরি করে। দোকানে জোগান দেয়। নীলকান্তবাবু কালুদের কাছে শৈলেনের সমস্ত খবরাখবর নিয়েছে। তাকে দেখার ইচ্ছে। শৈলেনকে একদিন সাঁঝের বেলা তাঁর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো। আলাপ-পরিচয় করে নীলকান্তবাবু খুব খুশি। খুশিটা তাঁর কোনখানে তখনি ঠিক ঠাহর করতে না পারলেও কালুরা বুঝে ছিলো, ছেলেটার ভাগ্য খুলে গেল। নীলকান্তবাবু শৈলেনকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিলেন।শৈলেনেরও খাওয়া পরার অভাব আর রইলোনা। বড়লোকের জামাইয়ের মত নীলকান্তবাবুর সঙ্গে কোলকাতা যায়। তিনি ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দেন। শৈলেনেরও মন্দ লাগেনা কাজটা। মাল ডেলিভারী দেওয়া, জাবদা খাতায় হিসেব লিখে রাখা ইত্যাদি সে খুশি মনে করে। নীলকান্তবাবু অতিশয় খুশি হোন। কিছুদিন যেতে না যেতেই তিনি আবেগের বশে একটা হঠকারিতা করে বসলেন। বড়মেয়ে রুমার সঙ্গে শৈলেনের সাতপাকের বন্ধনটা সেরে ফেললেন। শৈলেনও নিজের মতামতটা জাহির করবার ফুসরৎ পেলনা। কালুরা খুব খুশি! যাক বাবা একটা মা-মরা ছেলের হিল্লে হলো। নীলকান্তবাবু স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেই এমন সম্মন্ধটা পাকা করে ফেলেছিলেন। তাঁর বিশাল বিষয়- সম্পত্তির দেখাশোনার মত একজনকে দায়িত্ব দিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন।


কিন্তু, বিয়ের পর শৈলেন অস্বস্তিবোধ করতে লাগলো। ওর মন ভালো নেই। মা-বাবার একমাত্র সন্তান সে। তাঁদের কথা মনে পড়ে মনে মনে কাঁদতে থাকলো। মনের মধ্যে চাপা কষ্ট- দুঃখে দিনকে দিন সে শুকিয়ে যেতে লাগলো। শ্বাশুড়ি গায়ত্রীদেবী মেয়েকে বকাবকি করেন এজন্য। স্বামীর খাওয়া-দাওয়ার যত্ন নেয়না বলে। কিন্তু, রোগ তো সেখানে নয়। মনের অসুখ। একটা মুক্ত বিহঙ্গকে খাঁচায় বন্দি করলে যে অবস্থা হয়, শৈলেনের আজ সেই অবস্থা হয়েছে। মা-বাবার জন্য মনটা বিষন্ন। তাঁদের স্বপ্নকে ভেঙে ছারখার করে দিয়েছে, একমাত্র সন্তান। শৈলেনের আয়েশ-আরাম ধন-দৌলতে বিন্দুমাত্র লোভ নেই। সে এখন মুক্তি চায়।


ফাঁক পেলেই মুক্তির উল্লাসে বিহঙ্গ সুনীল আকাশে পত্পত্ করে ওড়ে, কয়েকটি ডিগবাজি খায়। পালট খায়। শৈলেনের আজ মুক্তি ঘটেছে। বড়বাজারের দোকান থেকে মা-বাবার জন্য পোষাক-আশাক কেনাকাটি করে, সোজা লালগোলা প্যাসেঞ্জারে চড়ে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। মা-বাবার সঙ্গে আজ সাক্ষাৎ হবে; ওঁদের সারপ্রাইজ দেবে ছেলে। সেই কথা ভেবে মহাখুশি। কিন্তু, রুমার ভালোবাসা সে ভুলতে পারেনা। চোরের মত চুপিসাড়ে পালিয়ে এলেও, শৈলেন ওর নামে একটা চিঠি লিখে রেখে এসেছিল। সে ঠিক পেয়ে যাবে।রুমার চোখে বন্যা বয়বে। বুকে উত্তাল ঢেউ উঠবে। ব্যাথা বেদনায় ক্লিষ্ট, বিদ্ধ হয়ে তির বেঁধা পাখির মত ছটফট করবে; সেসব শৈলেন জানে। সে রুমাকে কষ্ট দিতে চায়না। একদিন ফিরে শৈলেন আসবেই। চিঠিতে সেকথা উল্লেখ আছে। রুমার কাছে সেটাই হবে শান্ত্বনার। ওর জন্য পথ চেয়ে প্রতীক্ষা করবে।


।। পাঁচ ।।


নীলকান্তবাবু বাড়ি ফিরে, মেয়ের কাছে চিঠির কথা জেনেছে। তিনি পুলিশ কমিশনারের সাহায্যে শৈলেনকে ধরে আনতে চেয়েছিলেন। স্ত্রী গায়েত্রী দেবী বারণ করেছেন সেই পথে যেতে। রুমার কাছে নীলকান্তবাবু জেনেছেন, ওর শ্বশুর বহরমপুর শহরের খ্যাতনামা ব্যারিস্টার সুমন অধিকারী। ব্যস! এই টুকু তথ্য পেলেই যথেষ্ট কোটিপতি ব্যবসায়ী নীলকান্তবাবুর কাছে। তিনি স্ত্রীর সঙ্গে গাড়ি চড়ে, পরেরদিনই রওনা দিলেন বহরমপুর। মুর্শিদাবাদের সদর শহর।


সুমন অধিকারী নিজের চেম্বারেই বসেছিলেন। নীলকান্তবাবু সস্ত্রীক তাঁর চেম্বারে ঢুকে পড়লেন। সুমনবাবু বিস্মিত হয়ে বিনম্রভাবে প্রশ্ন করলেন," আপনারা কে! অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল আজকে?"


নীলকান্তবাবু, সটান সামনের একটা চেয়ার দখল করে বললেনঃ "বলছি, বলছি। আগে একটু শ্বাস নিতে দিন।" নীলকান্তবাবু গায়ত্রীদেবীর উদ্দেশ্যে বললেন বসো। তিনিও একটা চেয়ারে বসলেন। -"এবার বলুন"


-"আমরা নদীয়ার বীরপুর থেকে আসছি। আপনার ছেলে শৈলেন দীর্ঘদিন আমাদের বাড়িতে ছিল।---ও মনে হয় সৎমায়ের অত্যাচারে বাড়ি ছেড়েছিল তাইতো?"


-"সৎমা মানে!! এখানে সৎমা কোথায় থেকে এলো?" ধমকে উঠলেন সুমনবাবু।


- "শৈলেন অধিকারী আপনার ছেলে তো?"


-"হ্যাঁ, সে আমাদের একমাত্র ছেলে। গত ছয়মাস যাবৎ নিরুদ্দেশ ছিল। আমরা অনেক খুঁজেছিলাম। পুলিশে ডায়েরি করেও ছেলেকে পাইনি। দুদিন আগেই সেই নিজে ফিরে এসেছে।"নীলকান্তবাবু বললেন:- নিজের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে-এটা খুব সুখের খবর। কিন্তু, শৈলেন বাবাজীবন আমার মেয়ের সর্বনাশ করে এসেছে। বেচারী কেঁদেকেটে অস্থিার। মেয়ে খাওয়া ছেড়েছে শোকে দুঃখে" সুমনবাবু বাধা দিয়ে বললেন: "কথাটি আমাকে খুলে বলুন নীলকান্তবাবু।"


নীলকান্তবাবু পরনের কোটের পকেট থেকে একটা ফটো বের করে সুমনবাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেনঃ" এই ফটোটি দেখে নিঃশ্চয় বুঝতে অসুবিধে হবেনা, শৈলেন বাবাজীবন আমার মেয়েকে বিয়ে করে ঘরজামাই ছিল। আমার দুই মেয়ে। বড়বাজারে বিশাল ব্যবসা। ঘর বাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি সবই আমি তাদের দিয়ে যাব।".... তিনি নিজের মনেই বকে চলেছিলেন। সুমনবাবুর সেদিকে মন ছিলোনা। ফটোটার দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিলেন। গায়ত্রীদেবী স্বামীকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, "তুমি চুপ করো।"


বেশকিছুক্ষন মৌন থাকার পরে সুমনবাবু বললেন: সবই বুঝলাম নীলকান্তবাবু, অস্বীকার করবার লোক উপায় নেই। আমি আইনের লোক মশায়, এই বিয়ে অস্বীকার করলে কী হয়, আমি ভালোরকম জানি। সুতরাং, আমি অন্যায় হতে দেবনা। আমার ছেলে যখন বিয়ে করেছে, আমি, আমার বৌমাকে সসম্মানে ঘরে তুলবো। তার আগে আপনারা চলুন আমার বাড়িতে। ইডিয়টার কানে ধরে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া করবো।"


--না, না তার প্রয়োজন নেই বে-হায় মশায়। আপনি যখন মেনে নিয়েছেন এই বিয়ে তখন অসুবিধে কোথায়?.... শৈলেন বাবাজীবনের বয়স কম সুতরাং ওর মনে ভয়-ভীতি কাজ করছিল বলে এমনটা করে ফেলেছে। যাক, আমরা ক্ষমা করে দিয়েছি। ও এখন গিয়ে আমার রুমাকে নিয়ে এলেই সব ঝামেলার নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। "নীলকান্তবাবু বললেন। সুমনবাবু বাধা বললেন: "না, না এইভাবে বৌমাকে ঘরে তুললে হবে কেন? আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে ধুমধামে হবে। পুনরায় ওদের বিয়ে হবে নতুন করে। ওদের পুনর্বিবাহ দেব। চলুন বেহায় মশায় আমার বাড়ী চলুন আগে। দিনক্ষন সব ঠিক করতে হবে না !!

No comments

Powered by Blogger.