গল্প - অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, লেখক - এস এম মঈনুল হক
অভিন্ন হৃদয় বন্ধু
এস এম মঈনুল হক
আজ তোর স্কুলে আসতে এত দেরি। আমি সেই কখন থেকে তোর রাস্তা দেখছি ।ভাবলাম, হয়তো আজ আর স্কুল আসবি না। — মনটা খুব খারাপ লাগছেরে। কাল থেকে মায়ের অসুখটা আবার বেড়েছে । সন্ধ্যা বেলায় ডাক্তার এসে ওষুধ ইনজেকশন করাই সকাল থেকে একটু সুস্থ মনে হচ্ছে। তাই স্কুলে এলাম। ভেবেছিলাম আজ বোধহয় আর স্কুল আসা হবে না । তোকে দেখতে পাবো না বলে মনটা আরো খারাপ করবে তাই চলে এলাম। - আচ্ছা রফিকুল, চাচির অসুখটা কি?
— হার্ট প্রবলেম।
- ভালো করে ডাক্তার দেখা।
- এইতো কিছুদিন আগে ডাক্তার দেখিয়ে আনলাম। ডাক্তার বললেন, এভাবে যতদিন চলে।
দুই বন্ধুর মধ্যে সুখ দুঃখের অনেক কথা আলোচিত হতে হতে প্রেয়ারের বেল পড়ল।
—আজ প্রেয়ারে যাব না। মনটা ভালো নেই। –ঠিক আছে তুই ক্লাসে যা। প্রেয়ার সেরে আমি আসছি। টিফিনে কথা হবে।
সুমন ক্লাসের ফার্স্ট বয়। রফিকুল থার্ড । দুই বন্ধুর অভিন্ন আত্মা । তাদের সম্পর্কটা ক্লাসের অনেক ছেলেই সহ্য করতে পারে না। বিশেষ করে সেকেন্ড বয় মন্টু । উঠতে বসতে শয়তানি করে। কেন জানিনা। তবে এইটুকু আন্দাজ করতে পারি মনটু বড়লোক বাবার একমাত্র সন্তান । তার হিংসেটা বেশি সুমনের উপর। সুমণ,ফাস্ট বয়। হিংসের আরেকটা কারণ এটাও হতে পারে। আর রফিকুল মোটামুটি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে । সুমন গরীব ঘরের ছেলে হলেও প্রায়ই রফিকুলকে আইসক্রিম খাওয়ায়। তখন তো ৫০ পয়সাই ভালো একটা আইসক্রিম পাওয়া যেত। মনটু অনেক বার এটা সেটা খাওয়ার জন্য এই দুই বন্ধুকে বলে কিন্তু কোনদিনই তারা খায় না শুধুমাত্র তার শয়তানির জন্য। বালিশে মাথা রেখে এতক্ষণ এসবই চিন্তা করছিল সুমন। তখন তারা ক্লাস সেভেনে পড়তো। এখন সুমন ব্যাংকে একটা ভালো পদে চাকরি করে। চাকুরী করলে কি হবে? সেদিনের কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারছে না সুমন। ১২ বছর আগের কথা। রফিকুল প্রেয়ারে যায়নি বলে ক্লাস টিচারকে দিয়ে মার খাইয়েছিল মন্টু । স্বভাবতই রফিকুলের মনটা খারাপ ছিল ।স্যারের হাতে প্রথম মার। সুমন অনেক চেষ্টা করেও মারের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি রফিকুলকে । স্যার ক্লাসে এসে বললেন -- কেন তুই প্রিয়ারে যাসনি ? —ওর মা অসুস্থ স্যার, সেজন্য ওর মানসিক অবস্থা ভালো নেই । —ওর হয়ে সাফাই গাইছিস? —না স্যার, সত্যিই ওর মা অসুস্থ। —তাই বলে প্রেয়ারে যাবে না।
স্যারটা সেদিন কোন কথাই শোনেননি । রফিকুলের সঙ্গে সঙ্গে সুমনকেও মার খেতে হয়েছিল।
রফিকুল মারের আঘাত সহ্য করে নিলেও অপমান আর লজ্জায় একটুখানি হলেও সুমনের পিঠে দু'ঘা পড়াটা কিছুতেই সে সহ্য করতে পারছিল না। স্কুলের পূর্ব দিকে খেলার মাঠ । টিফিনে তারা আইসক্রিম খেতে খেতে দক্ষিণ দিকের পাড়ে গিয়ে বসলো । —আজকের ঘটনা কোনরকম যদি মায়ের কানে উঠে তো উনি সহ্য করতে পারবেন না। আমার খুব ভয় হচ্ছে রে সুমন । —কি করবি বল । মন্টুটা যে এমন করবে সেটা আমিও কি ভাবতে পেরেছিলাম । –আমার জন্য তোকেও মার খেতে হল। –সেজন্য আমার কোন দুঃখ নেই রে ।তোর জন্য আমি সব কিছুই সহ্য পারি। —জানিস, আমার আজ মনে হচ্ছে না-। –কি- না ।
–না থাক। চল ক্লাসে যাই ।
ক্লাস শেষ হলে স্কুলের গেট পর্যন্ত একসঙ্গে এসে যে যার বাড়ি মুখে রওনা হল । স্কুল থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে তিন মিনিটের পথ । সুমন তিন মিনিটে বাড়ি মুখী কিছুটা রাস্তা এসেছে এমন সময় ন্যাশনাল হাইওয়ের দিকে আশপাশের লোকজনকে ছুটতে যেতে দেখে সুমন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর সেও ছুট দিল ।পাকা রাস্তার কাছাকাছি আসতেই সুমনের চোখ গিয়ে পড়ল রফিকুলকে কয়েকজন লোক ধরাধরি করে তাকে বাসে উঠাচ্ছে। মাথা থেকে রক্ত পড়ছে। কয়েকজন লোক বলাবলি করছে লরি টার কোন দোষ নেই । ছেলেটার-ই দোষ। সুমনের আর বাড়ি আসা হল না । একটা ছেলেকে তার বইগুলি দিয়ে সেও বাসে উঠে পড়ল। তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখল রফিকুল অজ্ঞান হয়ে গেছে। হাসপাতালে ভর্তি করা হল। পাশে সুমন দাঁড়িয়ে । তার চোখ দিয়ে অশ্রু বন্যা বইছে । মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। অতি কষ্টে ডাক্তার বাবুকে জিজ্ঞেস করল, আমার বন্ধু বাঁচবে তো স্যার । –২৪ ঘন্টা পার না হলে কিছুই বলতে পারব না । অনেক রক্তের দরকার। ইন্টারন্যাল হেমারেজ হয়েছে। ও নেগেটিভ রক্ত আমাদের ব্লাড ব্যাংকে নেই। –স্যার, আমি কিছুদিন আগে ব্লাড টেস্ট করিয়েছি।আমারও ও নেগেটিভ। –কিন্তু বাবা, এই বয়সে তো তোমার রক্ত নেওয়া যাবে না । –আমার বন্ধুর কিছু হবে না তো স্যার। আমার রক্ত নিয়ে বন্ধুকে বাঁচান স্যার।
রক্তের আর প্রয়োজন হল না। দু ঘন্টা পরে জ্ঞান ফিরলো রফিকুলের । ইশারায় কাছে ডাকলো। সুমনকে বলল, ওখানে গিয়ে তোর সাথে আমার আবার দেখা হবে। রোজ তোর সঙ্গে আমার স্বপ্নে কথা হবে। মন্টুর কথা চিন্তা করতে করতে রোড পার হচ্ছিলাম। অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। মন্টুকে বলিস, আমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তারপর মাথাটা আস্তে করে কাত করলো রফিকুল। ছুটে গিয়ে ডাক্তার বাবুকে ডেকে আনলো সুমন। –আমার বন্ধু যে ঢোলে পড়ল স্যার।
প্রায় এক মিনিট ধরে স্টেথতা বুকে লাগিয়ে পরীক্ষা করার পর ডাক্তার বাবু বললেন, তোমার বন্ধু আর নেই বাবা । ও অনন্তজগতে চলে গেছে। আমি দুঃখিত। সুমন মন্টুকে বলেছিল তুই ওর মৃত্যুর কারণ । তুই আমাকেও মেরে ফেলবি। তোর মুখ দেখাও পাপ ।অবশ্য মৃত্যুর পূর্বে তোর মত শয়তানকেও রফিকুল ক্ষমা করে দিয়েছিল । কিছুদিন পর সুমন টি সি নিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি হয়েছিল ।আজ একটা চায়ের দোকানে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে সুমন ।এমন সময় একগাল ভর্তি দাড়ি মোচ ও উসখো খুস্কো চুল ওয়ালা একটি ছেলে সুমন কে বলল, বাবু এক কাপ চা দেন ।
ছেলেটাকে সুমনের চেনা মনে হচ্ছিল । –ওকে এক কাপ চা দিন তো ।দোকানদার ক্ষ্যাপাটাকে চা দিয়ে সুমনকে বলল, ছেলেটা খ্যাপা ছিল না। ওর ক্লাসের একটা বন্ধু এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার ছয় মাস পর থেকে ছেলেটা এরকম হয়ে গেছে । বড়লোক বাবার একমাত্র সন্তান । খুব বুদ্ধিমানও ছিল । চা পান করতে করতে খ্যাপাটা বলছিল মৃত্যুর আগেও আমাকে ক্ষমা করলি বন্ধু আর আমি সেদিন তোকে বুঝতেই পারলাম না। দোকানদারকে সুমন বলল, এই কথাটা কি ও সব সময় বলে । –হ্যাঁ দাদা, ওর মুখে সবসময় ওই একটাই কথা। অন্য কিছুই বলে না। আপনার মত প্যান্ট পরা কাউকে দেখলেই বলে, এক কাপ চা দিন তো। চিকিৎসার জন্য ভেলোর পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল ওর পরিবার। ডাক্তার বাবু বলেছেন, আর কখনো সুস্থ হতে পারবে না ও। সুমনের আর চিনতে দেরি হল না যে, এই-ই মন্টু । –আমাকে চিনতে পারছিস না মন্টু? আমি তোর বন্ধু সুমন। - হ্যাঁ হ্যাঁ সুমন। একটা বিড়ি দেন না বাবু। মন্টুর এহেন দশায় চরম কষ্ট পেল সুমন। এই ভেবে যে, মন্টু তার চেয়েও অনেক বেশি ভালোবেসে ছিল রফিকুলকে। সেটা সুমনের কোনদিনই বোধগম্য হয়নি। হে মহান স্রষ্টা মন্টুকে আবার সুস্থ করে দিন। ওকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আনুন।এই আপনার কাছে আমার আন্তরিক প্রার্থনা বলে বিছানায় পাশ ফিরলো সুমন।
( সমাপ্ত)
No comments