Header Ads

মানব সেবার মূর্ত প্রতীক স্বামী বিবেকানন্দ, লেখক - মনিরুজ্জামান (বিটু)



মানব সেবার মূর্ত প্রতীক স্বামী বিবেকানন্দ  

        মনিরুজ্জামান (বিটু)

     বিশিষ্ট শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক 


প্রাতঃ স্মরণীয় ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের আজ ১৬২ তম জন্ম দিবস। তিনি ছিলেন মানব সেবার মূর্ত প্রতীক। তার মহত্ত্বে ভরা ব্যক্তিত্ব গোটা ভারতবর্ষের কাছে আজও চির স্মরণীয়।

কুসংস্কার মুক্ত, চির চঞ্চল, দুরন্তপনা সর্বোপরি মুক্তচিন্তার অধিকারী, এই ছেলেটির জন্ম হয়েছিল ১২ই জানুয়ারি, ১৮৬৩ সালে কলকাতার সিমুলিয়ার দত্ত পরিবারে। বাবার নাম ছিল বিশ্বনাথ দত্ত। মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী। তার প্রকৃত নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত । শিব ভক্ত মা তার নাম রেখেছিল বীরেশ্বর । তাই তাকে বিলে বলে ডাকা হতো।

প্রচন্ড মেধাবী এই ছাত্র বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে সাফল্যের সঙ্গে বি এ পাস করেন।ছাত্রবস্তাতেই নরেন্দ্রনাথ দর্শন শাস্ত্রে প্রগাঢ় জ্ঞান অর্জন করেন। পাশ্চাত্য দর্শন নিয়ে তিনি গভীরভাবে গবেষণা করতে গিয়ে একটা সময় নাস্তিক হয়ে যান ।। অবশেষে তিনি ব্রহ্মবন্ধু কেশবচন্দ্র সেন এর দ্বারস্থ হন ।সেখানে ব্রহ্ম ধর্মের প্রতি তার অনুরাগ জন্মায়। ১৮৮১ সালে তিনি রামকৃষ্ণদেবের সান্নিধ্যে আসেন । সেখানে তিনি তার যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর পেলেন এবং জীবনের স্বরূপ উপলব্ধি করলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন," জীব সেবায় শিব সেবা", সেটা তিনি উপলব্ধি করলেন । গুরুর কথার রেস ধরে স্বামীজি বললেন " সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই" সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হচ্ছে মানুষ। তাই মানুষের সেবার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকে পাওয়া সম্ভব। তিনি বলেন--" বহুরূপে সম্মুখে তোমা ছাড়ি, কোথা খুঁজেছে ঈশ্বর , জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর" ।


১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ই আগস্ট ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে শ্রী রামকৃষ্ণের মহাপ্রয়ান ঘটে । ঐ বছরই তিনি বরানগরে রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠিত করেন । ১৮৮৭ সালে ১০ জন গুরু ভাইকে নিয়ে তিনি সন্ন্যাস নেন ।তার নাম হয় স্বামী বিবিদিষানন্দ । ১৮৯২ সালে স্বামী বিবেকানন্দ একজন পরিব্রাজক হিসেবে গোটা ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করেন। ভারতবর্ষের আর্তপীড়িত মানুষদের জন্য ব্যথায় তার মন ভরে ওঠে। তিনি দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন ভারতবাসির অশিক্ষা ,কুসংস্কার ,দুঃখ- দুর্দশা, নিদারুণ দারিদ্রতা মোচনই হবে তার জীবনের একমাত্র ব্রত।


১৮৯৩ সালে দক্ষিণ ভারতের খেতড়ির মহা রাজার আর্থিক সাহায্যে আমেরিকার শিকাগো বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন এবং সেখানে তিনি মাত্র পাঁচ মিনিট বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পান,। তার নাম হয় স্বামী বিবেকানন্দ। Sisters and brothers of America বলে তিনি বক্তব্য শুরু করেন। করতালিতে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। তিনি বেদান্ত দর্শনের মধ্য দিয়ে মানব ধর্মের বাণী সম্মোহিত করে বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করেন । সুদীর্ঘ চার বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করে ১৮৯৭ সালে তিনি ফিরে আসেন। এবং মানব সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে ১৮৯৭ সালে তৈরি করলেন 'রামকৃষ্ণ মিশন 'এবং ১৮৯৯ সালে বেলুড়ে 'বেলুড় মঠ 'তৈরি করেন।


তার স্বপ্ন ছিল শ্রেণীবৈষম্যহীন, বর্ণবিদ্বেষহীন, কুসংস্কারমুক্ত, সাম্প্রদায়িকতা ধর্মান্ধতা ও জাত পাতের ঊর্ধ্বে উঠে এক সুন্দর ভারতবর্ষ গঠন করা । তিনি এমন এক কল্যাণকর ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে মেথর -মুচি -চন্ডাল-শূদ্র-ব্রাহ্মণের মধ্যে কোন ভেদাভেদ থাকবে না। যেখানে হিন্দু-মুসলমান- খ্রিস্টান বৌদ্ধ- জৈনের কোন ভেদাভেদ থাকবে না। যেখানে শোষণ ,নির্যাতন থাকবে না। শুধু থাকবে ভ্রাতৃত্ববোধ সাম্য আর মৈত্রীর স্বর্গ। ভারতবর্ষের মূল মন্ত্র বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। এটাকে বাস্তবায়িত করার জন্য তিনি যুব সমাজকে আহবান করেছেন ।তাই তার জন্ম দিবস টি জাতীয় "যুব দিবস" হিসেবে পালন করা হয় ।


তার ধর্ম ছিল মানব সেবা ।মানব সেবার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকে অনুসন্ধান করতেন। আচারসর্বস্ব যুক্তিহীন বুদ্ধিহীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মকে তিনি কোন দিনই স্বীকার করেননি । তাঁর ধর্ম ছিল বিজ্ঞানসম্মত এবং যুক্তিবাদী। ধর্মব্যবসায়ীদের তিনি প্রচন্ড ঘৃণা করতেন। সে পুরোহিত হোক বা রাজনৈতিক নেতা হোক। যারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করেন, ধর্মের নামে রাজনীতি করেন, ধর্মের বিষ ছড়িয়ে মানুষকে হত্যা করতে দ্বিধা করেন না তাদেরকে তিনি পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিকতা বিলুপ্ত ও মস্তিষ্ক বিকারগ্রস্ত লোক বলে আখ্যায়িত করেন । তিনি বলেন -"মানুষকে হত্যা করে ধর্মকে রক্ষা করা চাইতে ধর্মকে হত্যা করে মানুষকে রক্ষা করা বেশি পুণ্যের কাজ" । তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফ্রান্সের দার্শনিক পন্ডিত রোমা রোলাকে বলেছিলেন-- If you want to know India,read Vivekananda অর্থাৎ যদি তুমি ভারতকে জানতে চাও তবে বিবেকানন্দকে পড়ো।


প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তি কখনোই ধর্মের নামে মানুষকে হত্যা করার নিদান দিতে পারে না। অথচ বর্তমান সময়ে অনেক গৈরিক বসন পরিহিত সন্ন্যাসী ধর্মের নামে মানুষকে হত্যা করার নিদান দিচ্ছে । ধর্মীয় পোশাক পড়ে যারা জল্লাদের ভূমিকা পালন করে তারা মানুষ নয় পিশাচ ,নরকের কীট ।

সমাজ সচেতন প্রগতিশীল ধর্ম প্রচারক হিসেবে স্বামীজীর নিম্নবর্গের মানুষ, মূলত শূদ্রদের প্রতি উচ্চ বর্ণের মানুষের অত্যাচারের ঘটনা তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি,। অতীব ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেছিলেন --" যে দেশে দশ -বিশ লাখ সাধু, আর ক্রোর দশেক ব্রাহ্মণ, ওই গরিবদের রক্ত চুষে খায় ,আর তাদের উন্নতির কোনও চেষ্টা করে না, সে কি দেশ না নরক? তিনি আরো প্রশ্ন করেছেন " কখনো কি কোন যুগে দেখেছেন ,কোন অভিজাত সম্প্রদায় পুরোহিত ও ধর্মধবজিগণ দীন- দুঃখীর জন্য চিন্তা করেছে"? তিনি শূদ্রের আধিপত্য কে গুরুত্ব দিয়ে ,তাদেরকে জাগ্রত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

পরাধীন ভারত কে শৃংখল মুক্ত করতে এবং দেশ গঠনে যুবশক্তির জাগরণকে তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তিনি তরুণ দলকে খেলাধুলার মধ্য দিয়ে আত্মশক্তিতে বলিয়ান এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। গীতা পাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলা কে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।তিনি বলতেন -"গীতা পাঠের চেয়েও ফুটবল খেললে তোমরা স্বর্গের আরো কাছে পৌঁছাবে"।

তার ধর্ম দর্শন আধ্যাত্মিকতা সমস্তটাই মানুষ কেন্দ্রিক ছিল। তিনি নির্দ্বিধায় বলতেন -"খালি পেটে ধর্ম হয় না"

। জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন --" ফেলে দে তোর শাস্ত্র -ফাস্ত্র গঙ্গাজলে। দেশের লোকগুলোকে আগে অন্ন সংস্থান করবার উপায় শিখিয়ে দে, তারপর ভাগবত পড়ে শোনাস।


একবার গো-রক্ষক সমিতির কয়েকজন স্বামী বিবেকানন্দের কাছে অর্থ সাহায্যের জন্য গেলে স্বামীজী জানতে চান মধ্য ভারতের দুর্ভিক্ষ কবলিত অসহায় মানুষদের জন্য তোমরা কি করেছো? তারা জানান তাদের সমিতি কেবলমাত্র গো -মাতাদের রক্ষা করার জন্যই স্থাপিত হয়েছে। তারা আরো জানান যে , শাস্ত্রে গরুকে মাতা বলা হয়েছে। স্বামীজি উত্তর দেন--' বুঝেছি তা না হলে এমন সব কৃতি সন্তান কে প্রসব করবে?'তারা স্বামীজির এই ব্যঙ্গ বিদ্রূপাত্মক কথা বুঝতে না পেরে আবার অর্থ সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করেন । তিনি বলেন যে সমিতি মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়, মানুষের দুঃখ দুর্দশার পাশে থাকে না ।সেই সমিতিকে তিনি কোন পয়সা দিতে পারবে না।

স্বামীজি ম্যান মেকিং রিলিজিয়নে বিশ্বাসী ছিলেন, যে ধর্ম মানুষকে প্রকৃত মানুষ রূপে গড়ে তুলতে সক্ষম। যে ধর্ম মানুষকে কল্যাণকর কাজে উদ্বুদ্ধ করে ।সে ধর্মে তিনি বিশ্বাস করতেন ।যে ধর্ম মানুষকে পশু প্রবৃত্তি শিক্ষা দেয় সেই ধর্মে তিনি বিশ্বাস করতেন না।

কলকাতা একবার প্লেগ রোগ দেখা দিয়েছিল ।সেই সময় স্বামীজি ভগিনী নিবেদিতা কে সঙ্গে নিয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে প্লেগ রোগাক্রান্ত মুমূর্ষ মানুষদের সেবায় নিয়ে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তিনি মানুষের পাশে থাকতেন সে মহামারি , দুর্ভিক্ষ খরা বন্যা সর্ববস্থায় ।


তার মূল্যবান দার্শনিক চিন্তাভাবনার কথা তার গ্রন্থগুলোতে দৃষ্টিগোচর হয় ।তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন যেমন পরিব্রাজক ,প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, ভাববার কথা, বর্তমান ভারত এছাড়াও কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ইত্যাদি।

১৯০২ সালে ৪ জুলাই স্বামী বিবেকানন্দ প্রয়াত হন ।কিন্তু তার স্বপ্নকে আজও সফলভাবে বহন করে চলেছে রামকৃষ্ণ মিশন এবং রামকৃষ্ণ মঠ । স্কুল- কলেজ পাঠাগার নির্মাণ, হাসপাতাল স্থাপন ,অনাথ আশ্রম, ঔষধালয় স্থাপন, দারিদ্র পীড়িত মানুষের উন্নয়ন এবং বন্যা- খরা ও দুর্ভিক্ষ পড়িত মানুষের সেবায় নিরন্তন কাজ করে চলেছে স্বামী বিবেকানন্দের রামকৃষ্ণ মিশন। স্বামীজীর ধর্মীয় দর্শন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য ধর্ম। তার ধর্মীয় দর্শন, উদার ধর্মভাবনা, যে মানবতার আদর্শ ,জীবন দর্শন ও প্রদর্শিত পথ বিশ্ববাসীর জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে। 

No comments

Powered by Blogger.