Header Ads

মানবাধিকার দিবসের গুরুত্ব, লেখক - মনিরুজ্জামান (বিটু)

 



মানবাধিকার দিবসের গুরুত্ব
                        
      মনিরুজ্জামান (বিটু)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মানবিক বিপর্যয় চরম আকার ধারণ করে।  প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদীকে হিটলারের নাৎসি জার্মান বাহিনী  নৃশংসভাবে হত্যা করে । এই যুদ্ধেই আমেরিকা  প্রথম, জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে দু দুটো পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে । পাঁচ থেকে ছয় কোটি মানুষ এই যুদ্ধে প্রাণ হারায়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ও এই ধারা অব্যাহত থাকে। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার ক্রমেই প্রসারিত হতে থাকে । গোটা বিশ্বব্যাপী যাতে মানবাধিকার কোনভাবে  লঙ্ঘিত না হয় সেই সংকল্প নিয়ে ফ্রান্সের প্যারিসের প্যালেস দ্য শ্যালোটে, এলিয়ানর রুজভেল্টের সভাপতিত্বে, জাতিসংঘের একটি কমিটি, একটি খসড়া সনদ তৈরি করে, যেটি আন্তর্জাতিক দলিল হিসেবে বিবেচিত হয় এবং প্রত্যেক মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে, এই সনদ ঘোষিত হয়। সার্বজনীন মানুষের অধিকারকে অক্ষুন্ন রাখতে, ১৯৪৮ সাল থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদ থেকে, ১০ই ডিসেম্বর দিনটি মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালন করার কথা বলা হয়।
১৯৫০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, প্রতিবছর এই দিনটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপন করা হবে এবং জাতিসংঘের  সদস্য ভুক্ত দেশ সহ আগ্রহী সংস্থাগুলোকে এই দিনটি তাদের মত করে, উদযাপন করার আহ্বান জানান। সেই থেকে অদ্যবধি প্রতি বছর ১০ই ডিসেম্বর ' বিশ্ব মানবাধিকার দিবস'  বিভিন্ন সভা সমাবেশ ,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন ধরনের তথ্যচিত্র কিংবা চলচ্চিত্র প্রদর্শনের  মধ্য দিয়ে, সারা পৃথিবীতে এই দিনটি সাড়ম্বরে উদযাপন করা হয়। ঐতিহ্য গত ভাবে ১০ ডিসেম্বর কে কেন্দ্র করে প্রতি ৫ বছর অন্তর " জাতিসংঘের মানবাধিকার ক্ষেত্র পুরস্কার"  প্রদান করা হয় । এছাড়াও নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান কার্যক্রমও ওই দিনেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

মানব পরিবারের সকল সদস্যের জন্য সার্বজনীন সহজাত  অহস্তান্তর যোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকার ই হল মানবাধিকার ।মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এক ধরনের অধিকার ,যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার ।
মানবাধিকার জাতি ,ধর্ম ,বর্ণ ,লিঙ্গ, বিশ্বাস ,শিক্ষাগত যোগ্যতা- নির্বিশেষে সবার জন্য সমান । মানবাধিকার সনদে মোট ৩০ টি মানব অধিকার বিষয়ক প্রবন্ধ রয়েছে। এবং বিশ্বের প্রায় ৫৩০টি ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে ।প্রতিটি প্রবন্ধে মানুষের মৌলিক অধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতা বিষয়ে, বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে।প্রতিটি মানুষ জন্মগতভাবেই এসব অধিকার লাভ করে ।একজন মানুষের বেঁচে থাকা এবং সমাজের নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মানবাধিকার অপরিহার্য।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিষয়টি উপলব্ধি করেই গোটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মানবাধিকার নিয়ে কমিশন তৈরি করেছে। কমিশনের কাজ কোথাও কোনোভাবে মানুষের অধিকার ক্ষুন্ন হল কিনা সেটা দেখা এবং তার প্রতিকারের জন্য সচেষ্ট থাকা।
মানবাধিকার হলো মানুষের মৌলিক অধিকার । অন্ন, বস্ত্র , বাসস্থান  ছাড়াও কয়েকটি  গুরুত্বপূর্ণ মানুষের অধিকার হলো  -- জীবন জীবিকা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক , সাংস্কৃতিক , ধর্মীয় , শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে , ন্যায্য বিচার, স্বাধীনভাবে চিন্তা ভাবনা, বাক স্বাধীনতার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে প্রতিবাদ করার অধিকার,  রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে, ব্যক্তিদের রক্ষা করার জন্য এই অধিকার গুলি অপরিহার্য ।
মূলত দুটি কারণে এগুলোকে মৌলিক অধিকার বলা হয়ে থাকে প্রথমত এই অধিকার গুলি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে,  যা  কোনভাবে লঙ্ঘন করা যায় না । দ্বিতীয়ত এই অধিকার লঙ্ঘন করলে একজন ব্যক্তি আইনের আদালতে যেতে পারেন। মানবাধিকারের ধারণা মানুষকে ক্ষমতায়ন করে এবং তাদের বলে যে তারা সমাজ থেকে মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য।

১৯৯৩ সালে  ভারতীয় সংসদ কর্তৃক মানবাধিকার সুরক্ষা আইন পাশ হয়। ১২ ই অক্টোবর ১৯৯৩ এ রাষ্ট্রপতির বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠিত হয়।২৯শে সেপ্টেম্বরে এটি কার্যকর করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রঙ্গ নাথ মিশ্র এর প্রথম চেয়ারপার্সন ছিলেন।  সারা দেশব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্রমবর্ধমান ঘটনাগুলোকে মোকাবেলা করার জন্য এবং ন্যায় বিচার ও প্রতিকার করার জন্যই ,এই প্লাটফর্মটি প্রতিষ্ঠিত হয় ।  সাধারণত সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি  এই কমিশনের সভাপতি হিসেবে থাকে এবং অন্যান্য আরো চারজন বিচারপতি নিয়ে কমিশন গঠিত হয় । এই কমিশনের মুখ্য কাজ হল ,ভারতের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাকে অনুসন্ধান করা, বিশ্লেষণ করা এবং তার প্রতিকার কল্পে সরকারের কাছে সুপারিশ করা। নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই কমিশনের সদস্যদের সরকারি যেকোনো সংস্থা, দপ্তর  ও প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শন করার অবাধ অধিকার রয়েছে। এছাড়াও এই কমিশন যেকোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন মোকাবেলা করা ও ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে ।যেমন পুলিশের বর্বরতার মোকাবেলা করা ।প্রান্তিক গোষ্ঠী যেমন দলিত ,উপজাতি সম্প্রদায়, নারী ও  শিশুদের অধিকারের জন্য সক্রিয়ভাবে ওকালতি করা ।এছাড়াও মানব পাচারের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। আন্তর্জাতিক বিচারালয় ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এই কমিশনের নিজস্ব আদালত রয়েছে। এছাড়াও যে কোন রাজ্য প্রয়োজনে যেকোনো জেলার দায়রা আদালতকে মানবাধিকার আদালত বলে ঘোষণা করতে পারে । এই আদালতে একজন সরকারি উকিল নিযুক্ত করা হয় এবং যেকোনো বিচার কাজ দ্রুত নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা করা হয়।

গোটা বিশ্ব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্কর রূপ পরিগ্রহ করেছিল । কয়েক কোটি মানুষ সেই ভয়ংকর যুদ্ধে মারা গিয়েছিল । বিশ্বের মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা তৈরি করা হয়েছিল । যার সদর দপ্তর নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত। জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। ১৯৪৬ সালের ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ইউনিসেফ নামক একটি আন্তর্জাতিক শাখা সংগঠন তৈরি করেন ,যার মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল শিশু, মায়েদের উন্নতি ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কর্মকান্ড পরিচালনা করা।  UNICEF তাদের কল্যানমুখী কাজের জন্য ১৯৬৫ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়। মানুষের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে ১০ ডিসেম্বর ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অফ হিউম্যান রাইটস (UDHR)বা মানব অধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে ।
জাতিসংঘ সহ এসব আন্তর্জাতিক সংস্থা গুলো মানুষের কল্যাণার্থে গঠন করা হয়েছিল এবং সেই ভাবে তারা তাদের কার্যধারা অব্যাহত রেখেছে ।প্রশ্ন উঠছে ,বিশ্বের মানুষ কি শান্তি ও নিরাপত্তা পেয়েছে ?শিশু এবং মায়েদের  আর্তনাদ কি বন্ধ হয়েছে  ?মানুষ কি তার মৌলিক অধিকার সবটাই পেয়েছে ? আজও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। ইজরায়েল ফিলিস্তিন যুদ্ধ চলছে। মেঘের আড়ালে গুরুদেব আমেরিকা প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। কিছুদিন আগেই মায়ানমারের বার্মীজ সেনারা  সেখানকার মুসলিমদের গণহত্যা করেছে । প্রাণ বাঁচাতে অনেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। ইজরাইল তার আধুনিক সমরাস্ত্র দিয়ে ফিলিস্তিনিদের ,আবাল বৃদ্ধা বণিতা কে নির্মমভাবে হত্যা করছে । রাশিয়া ও একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইউক্রেনীয় বাসীদের উপর নির্মমভাবে  হত্যা করছে । শক্তিশালী দেশের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে এইসব আন্তর্জাতিক সংস্থা গুলো কতটা অসহায়, কতটা দুর্বল ,সেটা বারবার প্রমাণিত। তা  না হলে জাতিসংঘের মহাসচিব কে ইজরাইলের প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলতে পারেন ? "যুদ্ধ বন্ধের কোন প্রশ্নই উঠে না।" তা সত্ত্বেও জাতিসংঘ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে কোন কঠোর পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয় নাই, বরং নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করে দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন।

বর্তমান সময়ে ভারত সহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এবং এশিয়া উপমহাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর অন্যতম কারণগুলো হলো -ধর্মীয় সংকীর্ণতা, জাতপাতের বিভেদ শিক্ষার অনগ্রসরতা, এছাড়া দারিদ্রতা, ক্রমবর্ধমান বেকারি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। তা সত্ত্বেও আমরা আশাবাদী মানুষ একদিন বুঝবে, "সবার উপরে মানুষ সত্য / ‌তাহার উপরে নাই " । মানুষ যেদিন মানুষের অধিকার বোধে জাগ্রত হবে, মানবাধিকারের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারবে, সেদিন মানবাধিকার দিবস উদযাপন সার্থক হবে ।

No comments

Powered by Blogger.