প্রবন্ধ - কাজী নজরুল ইসলাম: এক আধারে অনেককিছু , লেখক - মজিবুর রহমান, প্রধানশিক্ষক, কাবিলপুর হাইস্কুল
কাজী নজরুল ইসলাম: এক আধারে অনেককিছু
মজিবুর রহমান, প্রধানশিক্ষক, কাবিলপুর হাইস্কুল
কাবিলপুর, মুর্শিদাবাদ
কাজী নজরুল ইসলাম (২৪.৫.১৮৯৯-২৯.৮.১৯৭৬/১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬-১২ই ভাদ্র, ১৩৮৩) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিরল ব্যক্তিত্ব। অন্যান্য সাহিত্যিকদের থেকে তাঁর জীবন কাহিনী অনেকটাই আলাদা। তাই তাঁকে কেন্দ্র করে আমাদের অর্থাৎ বাঙালিদের মধ্যে একটা ভিন্ন মাত্রার আবেগ, উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসা লক্ষ্য করা যায়। তাঁর সৃজনশীল সৃষ্টিকর্ম ও সামগ্ৰিক জীবনযাত্রা নিয়ে আলোচনা করতে আমরা আগ্রহবোধ করি। আমাদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির ধারাবাহিকতায় তাঁর ভাবনার প্রাসঙ্গিকতা প্রতিটি মুহূর্তে অনুভূত হয়। এবছর (২০২৪/১৪৩১) তাঁর জন্মের ১২৫তম বর্ষপূর্তি। এই বিশেষ বর্ষে বাঙালির সাংস্কৃতিক মনন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাঁকে স্মরণ করছে।
১৯০৮ সালে মাত্র নয় বছর বয়সে নজরুল পিতৃহীন হন।অভাবের সংসারে তখন থেকেই তিনি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন। পড়াশোনা ও অর্থোপার্জনের পথ নিজেই খোঁজার চেষ্টা করেন।দশ বছর বয়সে মক্তব তথা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করেই কার্যত শিশু শ্রমিকে পরিণত হন।দু'পয়সা রোজগার করার মসজিদের মোয়াজ্জিন ও কবরের সেবকের কাজ নেন। এরপর রাঢ় বাংলার কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক লোকনাট্য লেটো দলে গায়ক, পালাকার ও অভিনেতা হিসেবে যোগ দেন। আসলে তখন থেকেই তাঁর বোহেমিয়ান জীবনের সূত্রপাত। একদিকে তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে দু'মুঠো অন্নের জন্য এখানে ওখানে কায়িক শ্রম করছেন।
নজরুল ইসলাম ১৯১০ সালে প্রথমে রাণীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজস্কুল ও পরে মাথরুন নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউটশনে ভর্তি হন। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে পড়াশোনা ছেড়ে অন্ডাল স্টেশনের এক গার্ডের বাড়িতে পরিচারক হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর আসানসোলে এক চা-রুটির দোকানে কাজ নেন। ১৯১৪ সালে পুলিশ আধিকারিক রফিজউল্লাহ নজরুলকে ময়মনসিংহ জেলায় নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং দরিরামপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। কিন্তু পরের বছর কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি বর্ধমানে ফিরে আসেন এবং প্রথমে অ্যালবার্ট ইন্সটিটিউশন ও পরে পুনরায় রাণীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজস্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন।দশম শ্রেণীর 'ফার্স্ট বয়' হওয়া সত্ত্বেও ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা না দিয়ে ১৯১৭ সালের শেষের দিকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতা ফোর্ট উইলিয়ামে, পরে সীমান্ত প্রদেশের নৌশেরায় এবং শেষে করাচি সেনানিবাসে ১৯২০ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সৈনিক জীবন অতিবাহিত করেন। এই আড়াই বছরে তিনি ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের একজন সাধারণ সৈনিক থেকে ব্যাটেলিয়ান কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে উন্নীত হন।
করাচি সেনানিবাসে নজরুলের সাহিত্য ও সঙ্গীত চর্চা অব্যাহত ছিল। তিনি সেখান থেকে ডাকযোগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা পাঠাতেন। ছাপার অক্ষরে তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা 'বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী'। এটি একটি গল্প যা 'সওগাত' পত্রিকায় ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হয়। একই বছরে কবিতা 'মুক্তি' এবং প্রবন্ধ 'তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা' প্রকাশিত হয় যথাক্রমে 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা' ও 'সওগাত'-এ।
সৈনিক জীবন শেষে ১৯২০ সালের এপ্রিলে কলকাতায় এসে নজরুল সাহিত্যকর্মকেই ধ্যানজ্ঞান করেন। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে রচিত ও '২২ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত কবিতা 'বিদ্রোহী' বাইশ বছরের যুবক নজরুলকে খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়। তিনি বাংলা সাহিত্যে 'বিদ্রোহী কবি' হিসেবে পরিচিত হন। 'বিদ্রোহী'র মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিতা সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যেই বিরল। তাঁর প্রকাশিত প্রথম গ্ৰন্থ প্রবন্ধ সংকলন 'যুগবাণী'(১৯২২) আর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অগ্নি-বীণা'(১৯২২)। তিনি তেইশ বছরের (১৯১৯-১৯৪২) সাহিত্য জীবনে লেখেন ২১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪টি সঙ্গীতগ্ৰন্থ, ৫টি প্রবন্ধগ্ৰন্থ, ৩টি করে কাব্যানুবাদ, উপন্যাস, গল্পগ্ৰন্থ ও নাটক এবং ২টি করে কিশোরকাব্য ও কিশোর নাটিকা। তিনি অন্তত চারটি পত্রিকা সম্পাদনা বা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রথম প্রকাশের সময়কাল অনুযায়ী পত্রিকাগুলো হল: ১.নবযুগ- জুলাই ১৯২০, ২.ধূমকেতু- আগস্ট ১৯২২, ৩.লাঙল- ডিসেম্বর ১৯২৫ ও ৪.গণবাণী- আগস্ট ১৯২৬।
নজরুলের সাহিত্য সাধনার বেশিরভাগ সময় ব্যয় হয়েছে সঙ্গীত রচনায়। এর পেছনে তাঁর সঙ্গীতপ্রেম ছাড়াও একটা আর্থিক কারণ ছিল। পত্রপত্রিকায় কবিতা বা বিভিন্ন ধরনের গদ্য লিখে সে সময় সেভাবে দক্ষিণা পাওয়া যেত না। অথচ আয়ের অন্য কোনো উৎস না থাকায় লেখালেখি করেই তাঁকে সংসার প্রতিপালন করার কথা ভাবতে হয়েছে। এজন্য গীতিকার, সুরকার ও সংগীত-শিক্ষক হিসেবে অর্থোপার্জন করার জন্য তিনি গ্ৰামোফোন কোম্পানি এবং কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হন। একই কারণে মঞ্চ ও চলচিত্র জগতের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।বাংলা গানের সম্ভারকে যথেষ্ট পরিমাণে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে নজরুলগীতির অনেক অবদান রয়েছে।
নজরুল ইসলাম যেমন সৈনিক থেকে সাহিত্যিক হয়েছেন তেমনি বাংলা ভাষার একমাত্র সাহিত্যিক হিসেবে রাজদ্রোহিতার অভিযোগে কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। তাঁর অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা ধূমকেতু কার্যত সশস্ত্র বিপ্লবীদের মুখপাত্র হয়ে উঠেছিল। স্বভাবতই ব্রিটিশ প্রশাসন বিষয়টি ভালো চোখে দেখেনি। ১৯২২-এর সেপ্টেম্বর মাসের একটি সংখ্যায় তাঁর রচনা 'আনন্দময়ীর আগমনে' প্রকাশিত হয়। এটি একটি রাজনৈতিক কবিতা যা ব্রিটিশ শাসনের অনাচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে লেখা হয়।এর প্রতিক্রিয়ায় ২৩শে নভেম্বর কুমিল্লা থেকে তাঁকে গ্ৰেফতার করে কলকাতায় আনা হয়। তিনি বিচারাধীন বন্দী হিসেবে ১৯২৩-এর ৭ই জানুয়ারি আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে এক অসাধারণ বক্তব্য পেশ করেন যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ 'রাজবন্দীর জবানবন্দী' নামে পরিচিত। অনেক কথার মাঝে তিনি বলেন,"... আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত।কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়।সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে...।" ১৬ই জানুয়ারি প্রকাশিত বিচারের রায়ে নজরুলের এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। প্রেসিডেন্সি জেল, আলিপুর সেন্ট্রাল জেল, হুগলি জেল ও বহরমপুর জেলে বন্দী জীবন কাটিয়ে ১৯২৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বর মুক্তি পান। এই পর্বে নোবেলজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি সহৃদয় ও স্নেহপূর্ণ আচরণ করতে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের আবেদনে সাড়া দিয়ে ধূমকেতু পত্রিকার জন্য একটি আন্তরিক আশীর্বাণী পাঠান,"কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু- আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন।" ১৯২৩ সালের ২২শে জানুয়ারি নজরুল যখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রয়েছেন তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'বসন্ত' গীতিনাট্যটি তাঁকে উৎসর্গ করেন। সাহিত্যিক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় রবিঠাকুরের দস্তখত সম্বলিত বইটির একটি কপি নজরুলের কাছে পৌঁছে দেন। নজরুল হুগলি জেলে থাকাকালীন ইংরেজ জেল-সুপারের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। নজরুলের স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কায় রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্ৰাম করেন, "Give up hunger strike, our literature claims you." (অনশন ভঙ্গ কর, তোমাকে আমাদের সাহিত্যের প্রয়োজন রয়েছে।) টেলিগ্ৰামটি অবশ্য নজরুলের কাছে পৌঁছায়নি কারণ সেটা পাঠানো হয়েছিল প্রেসিডেন্সি জেলের ঠিকানায়। ২২শে মে মাতৃসমা বিরজাসুন্দরী দেবীর হাতে লেবুর রস পান করে নজরুল চল্লিশ দিনের অনশন ভঙ্গ করেন।
নজরুল ইসলাম যেমন বিদ্রোহী কবি তেমনি সাম্যবাদী কবি। তাঁর বিদ্রোহ বা বিরোধিতা ছিল সকল প্রকার অসাম্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তিনি সরাসরি বলেছেন, "গাহি সাম্যের গান-/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান।" নারী ও পুরুষের মধ্যে সাম্য বা সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হয়েছেন। অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, "সাম্যের গান গাই-/আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।/বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।" আসলে সাহিত্যকে তিনি সমাজ সংস্কারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। সেজন্য প্রায় শতবর্ষ আগে লেখা কথাগুলো আজও বারবার উদ্ধৃত হয়ে থাকে। সেগুলো কখনও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে না। এর দ্বারা অবশ্য তিনি নিজেকেই মিথ্যা প্রমাণ করেছেন; তিনি কেবল 'হুজুগের কবি' ছিলেন না। তিনি একজন কালোত্তীর্ণ কবি। তাঁর লেখার একটা চিরকালীন আবেদন রয়েছে।
নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তুলতে আন্তরিক প্রয়াস গ্ৰহণ করেন। তিনি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মিল, ঐক্য ও নৈকট্য বোঝাতে যে উপমা ব্যবহার করেছেন তার কোনো তুলনা হয় না, "মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মোসলমান।মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।" তিনি যেকোনো ধর্মীয় গোঁড়ামির তীব্র বিরোধী ছিলেন। এজন্য মোল্লা-পুরুতদের একদম পছন্দ করতেন না।তিনি সমান দক্ষতার সঙ্গে ইসলামী গান গজলের পাশাপাশি সনাতনী গান শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেছেন। তাঁর সঙ্গীতে ঈশ্বর-আল্লার বন্দনা মানব বন্দনায় রূপান্তরিত হয়েছে। তিনি সবসময় মনুষ্যত্বের জয়গান গেয়েছেন।বারবার বলার চেষ্টা করেছেন, "মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।" তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্ম কখনও মানবিকতার থেকে বড় হতে পারে না, "মিথ্যা শুনিনি ভাই, /এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির কাবা নাই।"
নজরুল ইসলাম শুধু সাহিত্যের মধ্যেই সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্ৰামকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং বৃহত্তর জীবনে ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও তার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। মুসলিম কাজী নজরুল ইসলামের হিন্দু আশালতা সেনগুপ্তকে তখনকার দিনে (এপ্রিল ১৯২৪) স্ব স্ব ধর্ম বজায় রেখে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত কোনো মামুলি ব্যাপার ছিল না।পরস্পরের প্রতি তীব্র ভালোবাসার পাশাপাশি ধর্মীয় গোঁড়ামিকে অস্বীকার করার দৃঢ় মানসিক জোর না থাকলে দুই বিধর্মীর মধ্যে বিয়ে সম্ভব হত না।আশালতাকে মেঘনাদ বধ কাব্যের প্রমীলা করে নজরুল সহধর্মিণীর সাহসকে কুর্নিশ জানান। নজরুল তাঁর সন্তানদের নামকরণেও ধর্মীয় মিলনের সন্ধান করেন। তাঁর চার পুত্র সন্তানের নাম ছিল: ১.কৃষ্ণ মহম্মদ (জন্ম ও মৃত্যু-১৯২৫), ২. অরিন্দম খালেদ বুলবুল (১৯২৬-১৯৩০), ৩.কাজী সব্যসাচী ইসলাম (১৯২৯-১৯৭৯) ও ৪.কাজী অনিরুদ্ধ ইসলাম (১৯৩১-১৯৭৪)। সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধ দুজনেরই হিন্দু মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়।
নজরুল ইসলাম খুব হাসিখুশি, আত্মভোলা, মজলিসি মানুষ ছিলেন। উচ্চ রবে হাসতে ভালোবাসতেন। আড্ডায় বসে মাঝে মধ্যেই বলে উঠতেন, ''দে গরুর গা ধুইয়ে।'' কিন্তু এই প্রাণখোলা মানুষটি পুত্র বুলবুলের অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি। প্রচণ্ড শোকাহত হয়ে মানসিক শান্তি লাভের জন্য তন্ত্র সাধনা শুরু করেন। তবে এজন্য লেখালেখিতে কোনো খামতি ঘটেনি। ১৯৩৯ সালে প্রমীলা দেবী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার পর নজরুলের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। তাঁর মানসিক জোর কমে যায়। লেখনীতেও ভাটা পড়ে। তাঁর কণ্ঠে বিদায়ের সুর বাজতে শুরু করে। ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজত জুবিলী উৎসবে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, "যদি আর বাঁশি না বাজে, আমি কবি বলে বলছিনে, আমি আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি, আমায় ক্ষমা করবেন, আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম, সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্যে বিদায় নিলাম।"
১৯৪২ সালের ৯ই জুলাই আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে অনুষ্ঠান করার সময় তিনি অসুস্থবোধ করেন এবং তাঁর জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে আসে। কিন্তু অর্থের অভাবে তিনি উন্নত চিকিৎসা করাতে পারেননি। সামান্য হোমিওপ্যাথি ও কবিরাজি চিকিৎসা করা হয় কিন্তু তাতে আরোগ্য লাভ সম্ভব হয়নি। বরং অসুস্থতা আরও বাড়তে থাকে। তাঁর বাকশক্তি রদ হয়ে যায়। তিনি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন এবং তাঁর মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত হাঁটা চলা করতেও অসুবিধা হয়। এর ফলে নজরুল-প্রমীলার দুঃসহ কষ্টের জীবন শুরু হয়। তাঁদের সংসারে তখন নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। বাংলার তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শনিবারের চিঠি পত্রিকার সম্পাদক সজনীকান্ত দাস, কলকাতার মেয়র সৈয়দ বদরুদ্দোজা ও শিক্ষাবিদ হুমায়ূন কবীর প্রমুখ ব্যক্তিদের নিয়ে 'নজরুল সাহায্য সমিতি' গঠন করা হয়।অসুস্থ হওয়ার এক দশক পর ১৯৫৩ সালে উন্নত চিকিৎসার জন্য কবিকে ইউরোপ পাঠানো হয়। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সেখানকার ডাক্তাররা জানিয়ে দেন, কবির আরোগ্য লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই।
নজরুল ইসলাম সাধারণ মানুষের ভালোবাসার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সরকারের কাছ থেকেও স্বীকৃতি পেয়েছেন। ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে কলকাতা এ্যালবার্ট হলে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে এক বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সভাপতিত্ব করেন বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মানপত্র পাঠ করেন ব্যারিস্টার এস ওয়াজেদ আলী, বক্তৃতা করেন বিশিষ্ট রাজনীতিক সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে 'জগত্তারিণী স্বর্ণপদক' প্রদান করে। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার দেয় পদ্মভূষণ পুরস্কার।
১৯৬২ সালের ৩০শে জুন কবিপত্নী প্রমীলা দেবী প্রয়াত হন। নিজে শয্যাশায়ী হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর ভালোবাসার মানুষটির প্রতি সবসময় নজর রাখতেন। তাঁর জীবনাবসান হবার পর কবির সেবা শুশ্রূষায় অবহেলা ও অযত্ন বাড়তে থাকে। ১৯৭২ সালের ২৪শে মে বাংলাদেশ সরকার কবিকে ঢাকা নিয়ে যায়। ধানমন্ডির একটি বাড়িতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাখা হয়। বাড়িটির নামকরণ করা হয় 'কবিভবন'। তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি ঘোষিত হন। কবির জীবনের শেষ তেরো মাস কাটে বাংলাদেশের পিজি হাসপাতালে। প্রায় ৩৪ বছর ধরে নির্বাক ও ভাষাহীন থাকার পর ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট সকাল ১০টা ১০ মিনিটে কবি চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েন। কবির মরদেহ যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। কবির কফিন বহনকারীদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি মোহাম্মদ সায়েম ও প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের ট্রাজেডির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, "তুমি বাঁচিয়াও মরিয়া রহিলে দীর্ঘকাল/তুমি মরিয়াও বাঁচিয়া রহিবে চিরকাল।"
খণ-স্বীকার: ১.নজরুল শ্রেষ্ঠ সংকলন, সম্পাদনা- কল্যাণী কাজী ও প্রফেসর রফিকুল ইসলাম, ২.শত কথায় নজরুল, সম্পাদনা- কল্যাণী কাজী।
No comments