আধুনিক ছন্দের শিকড় সন্ধানে - ফারুক প্রধান (বাংলাদেশ)
আধুনিক ছন্দের শিকড় সন্ধানে
ফারুক প্রধান
বাংলাদেশ
ছন্দ কি ?
প্রত্যেক ভাষারই একটা স্বাভাবিক চলিবার ভঙ্গি আছে। সেই ভঙ্গিটারই অনুসরণ করিয়া সেই ভাষার নৃত্য অর্থাৎ তাহার ছন্দ রচনা করিতে হয়।
১৩২১ বাংলা
-রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর
সুনিয়ন্ত্রিত ও সুপরিমিত বাকবিন্যাসের নাম ছন্দ।
১৯২২ ইং
-প্রবোধচন্দ্র সেন
গদ্যছন্দ পরিশিলিতভাবে গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে শব্দ শৈলী নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করার জন্য মাত্রা গননার প্রয়োজন হয়। কেবল মাত্র সেখানে ভাব রসের ভাবনাকে গতিশীল করে ধ্বনি ব্যাঞ্জনার আশ্রয় নিয়ে উপমা,অনুপ্রাস ও অলংকার সন্নিবেশিত করতে হয়।
আধুনিক বাংলা ছন্দ যেমন বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন তেমনি শ্রুতি গ্রাহ্যও প্রয়োজন। ছন্দরস, ভাবরস ও কাব্যরস একে অপরের পরিপূরক । তাল-লয় ছন্দ ছাড়া কবিতার গঠনশৈলী পরিপূর্ণ হয় নাঠিক তেমনি উচ্চারণ সঠিক ভাবে বুঝতে না পারলে বা নিয়মিত না হলে ছন্দ পরিমিত হয় না। ছন্দ রসিক পাঠকরাই বুঝতে পারে সঠিক ছন্দ প্রয়োগের বিষয়টি।
গদ্যকবিতা গদ্যে লেখা হলেও তা পড়বার সময় এক ধরণের সুর অনুভব করা যায়।
আমরা প্রায়:শী বলে থাকি ঘোড়ার চালে শব্দে যে তাল ও ছন্দ কানে বাজে।
পাখিদের নিয়ে যদি ভাবি সেখানে দেখবেন পাখিরা যে শিষ দেয় বা কিচির মিচির শব্দ করে তাতে বুঝতে পারা যায় এক ধরণের সুর লক্ষ করা যায়। যেমন :-বউ কথা কও পাখির ডাক ।
চোখ গেল পাখির ডাক, ফটিক জল পাখির ডাক, হাঁসের ডাক প্যাক প্যাক, কোকিলের ডাক কুহু কুহু, কবুতরের ডাক বাক বাকুম, মোরগের ডাক । গরুর ডাক হাম্বা—- কুকুরের কান্না, শিয়ালের হুক্কি হুয়া।এর পর পোকাদের ডাক :- ঝিঝি পোকার ডাক এক টানা শুনতে পাই।
গদ্যকবিতা আমরা বিভিন্ন ভাবে লিখে থাকি কখনো গল্পের ঢঙ্গে কখনো বা পর পর নতুন নতুন শব্দ সাজিয়ে বিরাম চিহ্নের (অর্থ প্রকাশের সুবিধার্তে) মাধ্যমে ।
কিন্তু আসলে গদ্যকবিতা মূলত শৈল্পীক ভাবনা শব্দের দ্যোৎনা ধ্বনি ব্যঞ্জনা অলংকার ,অনুপ্রাস, উৎপ্রেক্ষা ও প্রাঞ্জলতা সব মিলে গদ্য ছন্দ তৈরী হয়।
সেখানে পদ্যের আর্বিভাব হয় বটে ফলে গদ্যের ধারাবাহিকতা আবেগের হাস্র-বৃদ্ধি অনুযায়ী ভাবের প্রয়োজনে এক একটি পর্ব তৈরী হয় এবং ছেদ পড়ে। দেখা যায় গদ্যকবিতার পর্ব ছেদের দ্বারা নিয়ন্ত্রীত হয়। গদ্যকবিতায় ভাষার ধ্বনিগত ভাব রক্ষার প্রয়োজন হয়। এতে পদ্যের অদৃশ্য ঝঙ্কার পরিলক্ষিত ।
ছন্দের পরিভাষা ঃ দল(syllable)- বাকযন্ত্রের উচ্চারিত বাক্যভুক্ত ধ্বনিখন্ড। দল দুই ধরণের ১। মুক্তদল ঃ মুক্তস্বরান্ত দল। যেমন কে, উমা, এ কা কী নি রু প মা।
রুদ্ধদল ঃ খণ্ডবর্ণান্ত মুক্তদল। অর্থা মুক্তদল+খণ্ডবর্ণ= রুদ্ধদল। যেমন-দই, বউ, দিন, ফুল, বৈ.শাখ, গৌ.রব, পশ্.চিম।
আবার উচ্চারণ ভেদে দলের দুইরুপ ১। হ্রস্বদল ২। দীর্ঘদল।
অপ্রসারিত রুপে উচ্চারিত দল (মুক্তদল)
প্রসারিত রুপে উচ্চারিত দল ( দীর্ঘদল) যেমন-হাইফেন(-) চিহ্ন।
যেমন : দুর্.ল-ভ এ জ.গ.তে-র্ ব্যর্.থ.ত.ম প্রা-ণ্ এই পদ্যাংশটুকুতে আছে তিনটি দীর্ঘ রুদ্ধদল (ল-ভ্, তে-র, প্রাণ), দুটি হ্রস্ব রুদ্ধদল (দুর, ব্যর), এবং ৬টি হ্রস্ব মুক্তদল (এ, জ, গ, খ, ত, ম)। মাত্রা : যে কোন বস্তু পরিমাপের আদর্শমান । অর্থাৎ যে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বস্তুর সহায়তায় (অর্থাৎ সংখ্যা গণনা করে) কোন বৃহত্তর বস্তুর পরিমান নির্ণয় করা হয় তাকে বলা হয় মাত্রা। যেমন- দিনের মাত্রা ঘণ্টা, ঘণ্টার মাত্রা মিনিট, মিনিটের মাত্রা সেকেণ্ড।
রচনার প্রণালীভেদে বাংলা ছন্দের ধ্বনি পরিমাপের ক্ষুদ্রতম মাত্রা
দুই রকম- ১। দলমাত্রা ২। কলামাত্রা।
দলমাত্রা : নি.রুদ্-দেশ= ১+১+১ মোট ৩ মাত্রা।
কলামাত্রা : নি.রুদ-দেশ= ১+২+২ মোট ৫ মাত্রা।
মিশ্রকলা : নি.রুদ-দেশ= ১+১+২ মোট ৪ মাত্রা।
নি, মুক্তদল ১ মাত্রা
রুদ’ ও দেশ এই দুটি রুদ্ধদল কখনো এক মাত্রা আবার কখনো দুই মাত্রা। তাতেই বোঝা যায় বাংলা ছন্দের রীতি বৈচিত্র নির্ভর করে রুদ্ধদলের উচ্চারণ বৈচিত্রের উপর।
১৯২২ সালে এই রীতির নাম দিয়েছিল প্রবোধ চন্দ্র সেন।
১। স্বরবৃত্ত, ২। মাত্রাবৃত্ত ৩। অক্ষরবৃত্ত। এখনো এই তিন নাম অচল হয়ে যায়নি। এই তিন নাম ছন্দের প্রকৃতি-পরিচায়ক নয়, আর পাঠকের পক্ষেও বিভ্রান্তিকর।
পরিচিতি: সব্যসাচী লেখক ফারুক প্রধান ১৯৮০ দশক থেকে কবিতা ও ছড়া লিখে আসছেন। তাঁর লেখা কাব্যগ্রন্থ জেগে উঠি নিঃসঙ্গতায়, ভালোবাসা রেডিমেট, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর জন্য কবিতা। নাটকের বই মুক্তিযুদ্ধের পথনাটক, উপন্যাস স্বপ্নে দেখা রাজ পুত্তর, গানের অ্যালবাম মনের টেলিফোন, কবিতার অ্যালবাম, ভালবাসা বায়না হবে। স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র স্বপ্নঘোর নির্মাণ করেন।
No comments