গল্প - বৃষ্টি ভেজা রাতে তোমার পরশ, লেখক - এস এম মঈনুল হক
বৃষ্টি ভেজা রাতে তোমার পরশ
এস এম মঈনুল হক
রাতের শহর এক অদ্ভুত নীরবতায় ঢেকে আছে। রাস্তার স্ট্রিটলাইটগুলো একে একে জ্বলছে, আর তার নিচে ভিজে যাচ্ছে ফুটপাথ। বাতাসে একটা স্নিগ্ধ গন্ধ—বৃষ্টির গন্ধ। অনিমেশ গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, এক অদ্ভুত ফিলিংসে হারিয়ে যাচ্ছে তার মন।
আজ আট বছর পর দেশে ফিরল সে। এতদিন দূরে ছিল, তবুও সবকিছু যেন ঠিক আগের মতোই লাগছে। হয়তো বদলেছে অনেক কিছু, হয়তো বদলায়নি কিছুই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তার প্রিয় ক্যাফেটার সামনে গাড়ি থামল। এই ক্যাফেটা একসময় তার প্রিয় ছিল, কারণ এখানে সে আর অপরাজিতা কত বিকেল, সন্ধ্যা, রাত একসঙ্গে কাটিয়েছে। আজ এত বছর পর এখানে পা রাখা… মনে এক ধরনের ভয় আর উত্তেজনা কাজ করছে।
সে ধীরে ধীরে ক্যাফের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ভেতরে পরিচিত উষ্ণ আলো, হালকা মিউজিক, কফির গন্ধ—সবকিছু যেন তাকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। একটা কোণার টেবিলে গিয়ে বসল সে, ঠিক যেখানে তারা সবসময় বসত।
ক্যাফের কর্মচারী এসে জিজ্ঞেস করল, "স্যার, আপনার অর্ডার?"
অনিমেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, "একটা বার্গার।"
সে জানে, আজ অপরাজিতাকে দেখবে না এখানে। এত বছর পর হুট করে কেউ আসে না, তবুও মন কেন যেন একটা অলীক আশায় বুক বাঁধছে।
বাইরে বৃষ্টি আরও জোরে নেমেছে। হঠাৎ ক্যাফের দরজা খুলে গেল। অনিমেশ স্বাভাবিকভাবেই তাকাল, কিন্তু পরের মুহূর্তেই তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসল।
অপরা!
ভেজা চুল এলোমেলো হয়ে কাঁধে পড়েছে, চোখ দুটোতে এক ধরনের ক্লান্তি, কিন্তু সেই চাহনিতে আজও আগের মতোই গভীরতা। শরীরে একটা নীল শাড়ি, পায়ে চপ্পল, কাঁধে একটা ছোট ব্যাগ।
অনিমেশ হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। এত বছর পর তাকে এভাবে দেখবে, এটা সে ভাবেনি।
অপরাজিতার চোখও টিকল অনিমেশের ওপর। মুহূর্তের জন্য যেন সময় থমকে গেল। দুজনেই চুপচাপ তাকিয়ে রইল একে অপরের দিকে।
তারপর অপরাজিতা ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, এবং একদম সামনে এসে দাঁড়াল।
"অনি?"
অনিমেশ হাসল, একটু বিস্ময়ের সুরে বলল, "অপরা!"
কিছুক্ষণ নীরবতা। এরপর অপরাজিতা আস্তে আস্তে বলল, "তুমি… এখানে?"
"হ্যাঁ। আমি দেশে ফিরেছি।"
অপরাজিতা চোখ নামিয়ে নিল। তারপর একটা টেবিলে বসতে যাবে, এমন সময় অনিমেশ বলল, "আমার সঙ্গে বসবে?"
অপরাজিতা কয়েক মুহূর্ত ভাবল, তারপর ধীরে ধীরে বসল।
ক্যাফেতে একটা নরম গান বাজছে, চারপাশে কয়েকজন মানুষ কফিতে চুমুক দিচ্ছে, কিন্তু তাদের দুজনের মাঝে যেন পুরো পৃথিবী থেমে গেছে।
অনিমেশ বলল, "কেমন আছো?"
অপরাজিতা একটু হাসল, কিন্তু সেই হাসিতে বিষাদের ছায়া। "ভালো থাকার অভিনয়ে ভালো আছি। তুমি?"
অনিমেশ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, "ঠিকঠাক। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, হয়তো কোথাও কিছু বাকি থেকে গেছে।"
অপরাজিতা তাকাল তার দিকে। "তুমি চলে যাওয়ার পর অনেক কিছুই বদলে গেছে, অনি।"
অনিমেশ জানত, এই কথাটা আসবে। সে একসময় অপরাজিতাকে ছেড়ে বিদেশ চলে গিয়েছিল, স্বপ্নের পেছনে ছুটতে গিয়ে প্রেমটা হারিয়ে ফেলেছিল।
সে আস্তে করে বলল, "তুমি কি… সুখী?"
অপরাজিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। "সুখ একটা আপেক্ষিক জিনিস, অনি। তুমিও কি সুখী?"
অনিমেশ কোনো উত্তর দিল না।
বাইরে বৃষ্টি আরও জোরে পড়ছে। জানালার কাচে টুপটাপ শব্দ হচ্ছে।
অপরাজিতা আলতো করে হাত বাড়িয়ে অনিমেশের হাতের ওপর রাখল। সেই স্পর্শে কত বছরের শূন্যতা যেন মুহূর্তেই পূর্ণ হয়ে গেল।
"তুমি জানো, আমি আজও বৃষ্টিতে হাঁটতে ভালোবাসি?" অপরাজিতা হেসে বলল।
অনিমেশ মাথা নেড়ে বলল, "জানি। তুমি বৃষ্টি ভালোবাসতে, আর আমি তোমার সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজা ভালোবাসতাম।"
অপরাজিতা চোখ নামিয়ে ফেলল।
অনিমেশ বলল, "আমরা কি আবার একসঙ্গে হাঁটতে পারি? শুধু আজকের জন্য?"
অপরাজিতা কিছু বলল না। তারপর আস্তে করে বলল, "চলো।"
ক্যাফে থেকে বেরিয়ে দুজন একসঙ্গে রাস্তায় হাঁটতে লাগল। চারপাশ ভিজে, বাতাস ঠান্ডা, কিন্তু মনে একটা অদ্ভুত উষ্ণতা।
অনিমেশ হেসে বলল, "তুমি কি জানো, আজকের এই রাতটা আমি কোনোদিন ভুলবো না?"
অপরাজিতা চুপচাপ তাকিয়ে থাকল, তারপর আস্তে করে বলল, "আমি-ও।"
বৃষ্টি পড়তে থাকল। শহরের বাতাসে মিশে গেল পুরনো দিনের কষ্ট, না বলা অনুভূতি আর এক হারানো প্রেমের গল্প।
এক বৃষ্টি ভেজা রাতে, হয়তো আবার… তারা একে অপরের পরশ অনুভব করবে।