ভ্রমণ কাহিনী - দীঘা ভ্রমণ, কলমে - ড. আবু তাহির

 



 দীঘা ভ্রমণ
ড. আবু তাহির

প্রকৃতি মানুষের জীবনে যে গভীর প্রভাব ফেলে, তা শুধু চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। প্রতিটি ভ্রমণ এক নতুন জীবনদর্শন তৈরি করে, যা আমাদের অন্তর্নিহিত চিন্তা ও অনুভূতির মর্মে গিয়ে পৌঁছায়। মালদা শহর থেকে দীঘা সমুদ্রতীরে যাত্রা শুরু করার আগেই আমি বুঝেছিলাম যে, এই যাত্রা শুধু পর্যটন নয়, বরং মানসিক এবং আত্মিক বিকাশের এক মহান অধ্যায় হয়ে উঠবে। প্রতিটি মুহূর্তের মধ্যেই যেন প্রকৃতির ভাষায় নিজেকে পুনরাবিষ্কার করার এক অনন্য সুযোগ রয়েছে।

মালদা থেকে দীঘার পথে: যাত্রার শুরু 
মালদা শহরের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং স্থাপত্য আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে। কিন্তু দীঘার সমুদ্রের কথা ভাবতেই মন যেন এক অনন্য রোমাঞ্চে ভরপুর হয়ে উঠল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত উক্তি —“পৃথিবীতে যদি কিছু সত্য থাকে তবে তা প্রকৃতি।” প্রকৃতির বিশালতার মধ্যে জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করার যে সুযোগ তা যেন দীঘার বিশাল সমুদ্রতীরে পা রাখতে উপলব্ধি করব। সেই আগ্রহের সাথে যাত্রা শুরু হল ট্রেনে চেপে শিয়ালদহ পৌঁছানোর মাধ্যমে। শিয়ালদহের কোলাহলময় স্টেশন থেকে ধর্মতলা, তারপর বাসে দীঘার পথে যাত্রা।

বাসের জানালা দিয়ে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে আমার মনে পড়ছিল মহাত্মা গান্ধীর বিখ্যাত উক্তি—“Live as if you were to die tomorrow. Learn as if you were to live forever.” আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই কিছু না কিছু শেখার আছে, আর প্রকৃতির সঙ্গে মিশে সেই শিক্ষাগ্রহণ করা যেন এক অমূল্য অভিজ্ঞতা। চারদিকে সবুজ ধানের ক্ষেত, ছোট ছোট গ্রাম, নদীর ধারে দাঁড়ানো গাছপালা—সবকিছু মিলিয়ে এক অন্যরকম প্রশান্তির অনুভূতি সৃষ্টি করছিল। প্রকৃতির এই নিস্তব্ধতা এবং সৌন্দর্য যেন শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি দেয়।

আমার সঙ্গে ছিল তিন বন্ধু—মনা, মাহিয়া এবং মেলোডি। আমরা একসঙ্গে এই যাত্রার আনন্দ ভাগ করে নিচ্ছিলাম। এককথায়, “বন্ধুত্বের পথচলা কখনও একা হয় না। সেখানে থাকে বিশ্বাস, সমঝোতা এবং একে অপরের প্রতি ভালোবাসা”—এই কথাটির সত্যতা যেন আরও প্রকট হয়ে উঠল। বন্ধুত্বের মেলবন্ধন যেন আমাদের যাত্রাকে আরও আনন্দময় করে তুলছিল। 

সমুদ্রের সামনে প্রথম বার: 
যখন প্রথমবার দীঘার সমুদ্রের সামনে এসে দাঁড়ালাম, মনে হল যেন আমি এক নতুন পৃথিবীতে এসে পড়েছি। সমুদ্রের বিশালতা, তার গর্জন, আকাশের সীমানাহীন নীলাভ রঙের সঙ্গে মিলেমিশে তৈরি করল এক অপার্থিব পরিবেশ। আমার মনে পড়ে গেল শেক্সপিয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তি—“There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy.” প্রকৃতির বিশালতা এবং তার রহস্য যেন আমাদের সামান্য জ্ঞানের পরিধির বাইরে। সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে সেই অনুভবটিই আরও জোরালো হল। 


সন্ধ্যায় আমরা অর্থাৎ মনা, মাহিয়া ও মেলোডি সবাই মিলে সমুদ্রতীরে পাথরের উপরে বসে ছিলাম, আর সমুদ্রের ঢেউগুলো আমাদের সামনে এসে আছড়ে পড়ছিল। মেলোডি যদিও কিছুটা ভয় ভয় করছিলো ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার পাগলামি খেলা দেখে। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত লাইন “আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে, এই বাংলার ধানক্ষেত নদীর ধারে”—এই লাইন যেন সমুদ্রের গর্জনের মধ্যেও প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। সমুদ্রের গর্জন, ঢেউয়ের আওয়াজ, আর সেই অসীম নীলাকাশ আমাদের মনকে এক অদ্ভুত শূন্যতার মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছিল, যেখানে কোনো কোলাহল নেই, শুধু প্রকৃতির সঙ্গে এক নীরব সংলাপ।



সূর্যাস্তের সৌন্দর্য:
দীঘার সৈকতে সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতা একেবারেই অনন্য। সূর্য যখন ধীরে ধীরে সমুদ্রের গর্ভে মিলিয়ে যাচ্ছে, তখন তার রক্তিম আভা সাগরের জলে প্রতিফলিত হয়ে এক মোহনীয় দৃশ্য তৈরি করছিল। তখন রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত লাইন মনে পড়ছিল—“আকাশ ভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ।” প্রকৃতির এই রূপ আমাদের জীবনের অনন্ততাকে বুঝতে শেখায়। সূর্যাস্তের এই দৃশ্য আমার হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।

সৈকতের বালিতে পা রেখে, যখন সমুদ্রের দিকে তাকালাম, তখন এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করলাম। জীবনকে যেমন আমরা ছোট ছোট জিনিসে ভাগ করে দেখি, তেমনই প্রকৃতির প্রতিটি মুহূর্তই আলাদা কিন্তু তা একসাথে মিলে তৈরি করে এক অনন্ত মহাকাব্য। বালির ওপর হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে পড়ছিল এক চীনা প্রবাদ—“A journey of a thousand miles begins with a single step.” প্রকৃতির বিশালতা এবং তার শান্তি আমাকে আরও আত্মসম্মুখীন করে তুলছিল। এই উপলব্ধি এক অন্য রকমের আধ্যাত্মিক শান্তি এনে দিল।

নিউ দীঘায় শান্তির ছোঁয়া:

পরদিন আমরা নবীন দীঘায় গমন করলাম, যেখানে সমুদ্রতট ছিল আরও প্রশান্ত ও সৌম্য। এখানে প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের মিলন আরও গভীর ও অন্তর্মুখী হয়ে উঠল। “নীরবতা কখনও কখনও সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ভাষা”—এই প্রবাদের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুভব করলাম নবীন দীঘার সেই নিস্তব্ধতায়। প্রভাতের কোমল সমীরণ, সমুদ্রের তীব্র অথচ স্নিগ্ধ ঢেউ, আর বালুকার মসৃণ স্পর্শ যেন এক অকথ্য শান্তির বার্তা ধারণ করেছিল। মাহিয়া প্রস্তাব দিলেন উদয়পুর সমুদ্রসৈকতে যাওয়ার। সাঁতার কাটার সম্ভাবনায় যেন মন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল। আমরা সকলে সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে দীর্ঘ দুই ঘণ্টাব্যাপী খেলায় মেতে উঠলাম। অতঃপর টোটোযানে হোটেলে প্রত্যাবর্তন করে সকলেই পোশাক পরিবর্তন করলাম। অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের মন সিক্ত হলো সমুদ্রের ভাজা মাছ ও সাদা ভাতের স্বাদে, যা আনন্দকে আরও গভীরতর করল।

সন্ধ্যার অবকাশে সামান্য বিরতি গ্রহণ করে, মেলোডি বিজ্ঞান কেন্দ্র পরিদর্শনের পরামর্শ প্রদান করল, কারণ সে বিনোদনমূলক প্রদর্শনী প্রত্যক্ষ করার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড আগ্রহী ছিল। আমরা সবাই বিজ্ঞান কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। টিকিট কাউন্টারে পৌঁছামাত্র, মাহিয়া এবং মেলোডির মধ্যে মতবিরোধ শুরু হলো, মূলত মেলোডির কাক্ষিত ফান শো বন্ধ থাকায়। মাহিয়া তার যুক্তিসম্মত বক্তব্য পেশ করায় অবশেষে ৩ডি শো এবং মহাকাশ প্রদর্শনী দেখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। বিজ্ঞান কেন্দ্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আমরা এই দুইটি প্রদর্শনী উপভোগ করলাম এবং পরিপূর্ণ আনন্দ লাভ করলাম।

নিউ দীঘার সমুদ্র সৈকত আরও শান্ত এবং কম জনাকীর্ণ। এখানকার প্রকৃতির নীরবতা আমাকে মুগ্ধ করে দিল। সকালের নরম আলো, সমুদ্রের হালকা ঢেউ আর বাতাসের মৃদু স্রোত—সব মিলিয়ে নিউ দীঘা এক প্রশান্তির প্রতীক হয়ে উঠল। বালির ওপর বসে সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আছি, তখন মনে হচ্ছিল জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই যেন প্রকৃতির মতোই শান্ত হতে পারে, যদি আমরা তা উপলব্ধি করতে শিখি।

এখানকার নির্জনতা এবং প্রকৃতির মাধুর্য আমাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল টলস্টয়ের বিখ্যাত উক্তি—“The two most powerful warriors are patience and time.” প্রকৃতির কাছে ধৈর্যশীলতা এবং সময়ের মহত্ত্ব শিখেছি। এখানকার সমুদ্রের ঢেউ যেন আমাকে এই সত্যটা প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিচ্ছিল।

মন্দারমণি ও তাজপুর: প্রকৃতির নিবিড়তা 
তৃতীয় দিনে আমরা মন্দারমণি এবং তাজপুরের পথে যাত্রা করলাম। মন্দারমণির সমুদ্র সৈকত আরও নির্জন, আর এখানকার প্রকৃতির মাঝে যেন আরও নিবিড় প্রশান্তি রয়েছে। তাজপুরে পৌঁছে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে প্রকৃতির অন্তরঙ্গতা অনুভব করলাম। সমুদ্রের ঢেউয়ের মৃদু গর্জন আর বাতাসের স্নিগ্ধ স্পর্শ আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল এক জাপানি প্রবাদ—“Sitting quietly, doing nothing, spring comes, and the grass grows by itself.”

এখানে প্রকৃতির এই শান্তি যেন জীবনের গভীর অর্থ বোঝার এক অন্তর্দৃষ্টি দিল। প্রকৃতি কখনও তাড়াহুড়ো করে না, তবুও সবকিছু সম্পন্ন হয়। এই নিস্তব্ধতা যেন আমার ভেতরের সব অশান্তিকে মুছে দিয়ে এক নতুন প্রশান্তির সন্ধান এনে দিল।

দীঘার বিদায়বেলা:
শেষ দিনে দীঘার সৈকত ছেড়ে আসার সময় আমার মনে হচ্ছিল যেন এই যাত্রা আমাকে প্রকৃতির সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত করেছে। সমুদ্রের বিশালতা এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য আমাকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনকে দেখতে শিখিয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর সেই বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ছিল—“You must be the change you wish to see in the world.” এই যাত্রা আমার ভেতরে সেই পরিবর্তনের বীজ বপন করেছে।

দীঘার সমুদ্রের প্রতিটি ঢেউ, বাতাসের প্রতিটি ঝাপটা, সূর্যাস্তের প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে শেখালো জীবনের মূল্যবান শিক্ষা।









Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url