গল্প - অস্ফুট প্রেম, কলমে - নাসরীন খান
অস্ফুট প্রেম
নাসরীন খান
মেলা বসেছে ২/৩ দিন হয়ে গেছে। আমি যাইনি এখনো। কাল স্কুল বন্ধ সবার। ভাবছি বিকেলে পরশকে নিয়ে মেলা দেখতে যাব।রাতে মায়ার কাছ থেকে ১টাকা নিয়েছি।সকালে মোরগ ডাকছে। চারদিকে ফর্সা হয়ে আসছে। মুয়াজ্জিন কাঁপা কা্ঁপা গলায় আজান দিচ্ছে। বাজান এখন মসজিদে যাবে। তার অজুর পানি এগিয়ে দিলাম। হাতে কয়লা নিয়ে মাজন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে পুকুর ঘাটে গেলাম। গেরস্ত বাড়ি থেকে হাঁস ছেড়ে দিয়েছে সবাই। প্যাক প্যাক করে হেলেদুলে হাঁটছে হাঁসগুলো। ভারি সুন্দর লাগছে। এর আগে কোনদিন আমি ওভারে ওদের যাওয়ার দৃশ্য চোখে পরেনি যেন।অদ্ভুত লাগলো নিজের কাছে। কেন আগে দেখিনি কোনোদিন? একা একাই হাসছি।
গলা খাকারি দিতে দিতে বাজান বাড়িতে ঢুকছে। বৌ ঝিয়ে রা যাতে মাথায় কাপড় দিতে পারে বা রাস্তা থেকে সড়ে দাঁড়াতে পারে সেই সতর্ক বার্তা এটি। খানদানি পরিবারে কোন পুরুষের বিনা আওয়াজে ভিতর বাড়িতে ঢুকা একেবারে নিষিদ্ধ। আসছে বছর আমার মেট্রিক পরীক্ষা। মা একটু মুড়ি আর গুড় একটা বাটিতে দিয়ে বলল .
-তোর বাজানরে খাইত দে এইডি।তুই টিন থাইকা কয়ডা লইয়া খা।তারপর পড়াত ব গিয়া।
-আইচ্ছা মায়া।
আমার পড়ার টেবিল এর সোজাসুজি মাচানে অনেক লাউয়ের গাছ।তরতর করে এর ডগা গুলি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। রোদ একটু একটু করে তাপ বাড়াতে শুরু করেছে। মায়া একটা ডালা নিয়ে লাউ পাতা তুলছে। আজ ঘরে মনে হয় তেমন কিছু নেই। এগুলোকে ভেজে হয়ত সকালের ভাত খেতে হবে।
আমাদের বাড়িটা কাঠের তৈরি। আমার দাদা এটা বানিয়ে ছিলেন। কাঠের ভিতর সুন্দর নকশা করা আছে। আগেকার দিনের আভিজাত্যের ছাপ আছে কিন্তু আর্থিক সমস্যা চলছে। বাহিরের মানুষ জন এখনো খুব একটা বুঝতে পারে না। আমাদের বাড়িতে এখনো সকলে এসে চেয়ারে বসতে পারে না। বাবা চেয়ারে বসা থাকলে অনেকে এখনো কাঠের তৈরি টুল এ বসে।এমনকি বাজান হেঁটে কোথাও বেড়োলে অনেক লোকজন আছে আশেপাশের তারা তাকে ডিঙিয়ে এগোয় না, পিছনে পিছনে আসেন।এইসব সমীহ দিয়ে তো আর পেট ভরে না।
যাক উত্তর বাড়ির মানুষজন বিশেষ করে খাঁ বাড়ির ওরা আমাদের অবস্থা জানে।আমার ফুফুর বিয়ে হয়েছে ও বাড়িতে। আমাদের গ্রামের আগে নিয়ম ছিল বংশওয়ালা কোন গ্রাম থেকে বিয়ের সম্বন্ধ এলে দূরে বিয়ে দেয়া হতো।কোন ছোট গ্রাম বা বংশ পরিচয় ভালো না হলে নিজেদের আত্মীয়দের মধ্যেই বিয়ে হতো।আরও কত কি নিয়ম নীতি চলমান।
উত্তর বাড়ির ফুপু আমাকে খুব আদর করতো। যদি কখনো মাংস রান্না হতো ও বাড়িতে আমার জন্য তুলে রাখা হতো বাটিতে। তারপর কাউকে দিয়ে ডাকিয়ে খেতে দিত।ফুপা এ বাড়িতে ঘর জামাই ছিল। কিন্তু ভীষণ কিপটে ছিল। তবে আমাকে কিছু বলতো না কখনো
ফুপুর ছেলে ছিল অনেক গুলো কিন্তু মেয়ে মোটে একজন। পারুল আমার থেকে বয়সে ৭/৮ বছরের ছোট ছিল। মাঝে মধ্যে স্কুলে যাওয়ার সময় ফুপু বলতো
- এই ছ্যাড়া, পারুলরে ডাইক্যা স্কুলে লইয়া যাইছ।
-আমার লজ্জা লাগতো। তবুও ফুপুর কথা রাখতে হতো।
স্কুল ছিল আমাদের গ্রাম থেকে আধামাইল দূরে।
এতসব ভাবতে গিয়ে মেলায় যাওয়ার কথাই ভুলে গেলাম। তখনও মাথার উপর সূর্য উঠেনি।পারুল আমার ঘরে আসল।
_ভাইসাব তুমি নাকি মেলাত যাইবা?
- হ্যা
- আমার জন্য একটা ঘোড়া আনবা কিন্তুক।
- ঠিক আছে।
পারুল আমাকে পছন্দ করে আমি বুঝতে পারি।কিন্তু একেবারে গায়ে মাখি না।আমাদের পরিবার আর ওদের পরিবার অনেক পার্থক্য বুঝি।বংশ গৌরব দিয়ে শুধু হয় না। বিত্তও জরুরি বিষয়।যাই হোক আমি ওর জন্য একটা মাটির ঘোড়া কিনে এনে দিলাম। তার খুশি কে দেখে! আমি লজ্জা পেয়ে বাড়ি চলে আসলাম।
এভাবে আমি বেশ কিছু দিন ওকে এড়িয়ে চলছি।সেটা ও খুব বুঝতে পারছে। একদিন হাঁটতে হাঁটতে বাগানে গেলাম। সব ফলেরই গাছ ছিল সেই বাগানে। আমি ঢিল দিয়ে বড়ই পারতে যাব এমন সময়
-ভাইসাব,ও ভাইসাব তোমার সাথে আমার কথা আছে
- আমি চলে আসতে গেলাম ওমনি আমার হাতটা ধরে
- তুমি ক্যারে আমার সাথে কথা কওনা আগের মতন?
-এমনি,কোন কারণ নাই
- আমি কি দেখতে খারাপ? কোন দিকে আমার কমতি আছে? আমার চেয়ে সুন্দর এই গেরামে কয়টা ছ্যাড়ি আছে যে তুমি আমারে পছন্দ করো না?
আমি কোন উত্তর দেয় নি সেদিন। সত্যিই তো পারুলের মতন আর কয়টা মেয়ে ছিল আমার দেখা। এখন নাতি নাতনিদের কাছে পারুল এর গল্প বলি।শেষ কবে দেখা হয়েছিল মনে পরে না।হাতির পিঠে চড়ে এক ধনী ব্যাবসায়ীর কাছে ওর বিয়ে হয়েছিল। আমি সেদিন জেনেও গ্রামে যাই নি।তখন আমি বি এ পাশ করে পাশের একটা গ্রামে হাইস্কুলে মাস্টারী করতাম। ঠিক তার ৪/৫ বছর পর একদিন লাশ হয়ে গ্রামে আসে পারুল। সেদিনও আমি যাই নি ওকে দেখতে।