প্রবন্ধ - শক্তিপদ সেনের কবিতায় জীবনবোধ ও অনুষঙ্গ, লেখক - ড. মনোরঞ্জন দাস

 



শক্তিপদ সেনের কবিতায় জীবনবোধ ও অনুষঙ্গ

ড. মনোরঞ্জন দাস


      পরম্পরাগত অবস্থানে সমান্তরাল জগতিকতাবোধ যেখানে সমুদ্যত প্রবাহ পরস্পরে থাকে, থাকে একক সন্নিধানে সাজুকতাময়, সেখান থেকেই  

দার্শনিক কবি শক্তিপদ সেনের 

কবিতা, জীবনবোধ এবং অনুষঙ্গের পর্যাবরণময় পরিক্রমণ   ও  পর্যালোচনা। 

'রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার' এবং ' অচেনা অতিথি পুরস্কার' প্রাপক কবি শক্তিপদ সেন জানেন, কবিতা হলো সাহিত্যের অভিব্যক্তি প্রকাশের একটি মাধ্যম, যা জীবনের অভিজ্ঞতা, আবেগ, এবং দর্শনকে শব্দে গেঁথে তোলে এবং জীবনবোধ হলো জীবনকে উপলব্ধি করার গভীর দৃষ্টিভঙ্গি, যা কবিতার মাধ্যমে প্রকাশিত হতে পারে,

আর অনুষঙ্গ বলতে বোঝায়, কবিতার সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য উপাদান বা ধারণা, যা কবিতাটিকে আরও অর্থবহ করে তোলে। 

        তিনি অনন্য জীবন জোয়ারের প্রত্যয়াংশী হয়ে কর্মময়  আধারে আসীন হয়ে সহজ সরল আখ্যানে সকালবেলাকে পুষ্টায়ণে আনেন এবং প্রিয় সংবাহনে সংসর্গবাহী ও সম্পৃক্তবাহী করেন। তিনি লেখেন,

' সকালে উঠেই কাজের খোঁজ, কাজ খুঁজে না পাই

মনে ভাবি, কেজি খানেক ছোলাটাই ভিজাই।

যেমন ভাবা অমনি কাজ, তর সয় না আর

এটাই হল বিচ্ছু ছেলের কাজের বাহার।

বলল উঠে ছোট্ট মেয়ে, করছো একি কান্ড

তুমি তো নও সহজ সরল,' এক বিচ্ছু কুষ্মান্ড।'

আমি বল্লেম, মাথা খাটাই, অল্প অল্প ভাবি

সকাল সকাল ইডলি খেতে কোথায় আবার যাবি?

বলল মেয়ে, ' ছোট্ট ছোলা ফুলে হবে ঢোল

সকাল থেকে কাজ নেই তো, করছো গন্ডোগোল।

বল্লেম মুই দু' দিন পরে খাবো আমি অঙ্কুরিত ছোলা

কাজ না করে থাকতে নারি, নামটা আমার ভোলা।'১


        পূর্বাপর প্রত্যয়ে, কবি শক্তিপদ সেন বোঝেন, একটি কবিতার গভীরতা এবং আবেদন নির্ভর করে কবির জীবনবোধ এবং তার সাথে সম্পর্কিত অনুষঙ্গগুলির উপর। কবিরা তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, এবং অনুভূতির মাধ্যমে জীবনকে উপলব্ধি করেন এবং সেই উপলব্ধি কবিতায় প্রকাশ করেন। এই উপলব্ধি থেকেই জন্ম নেয় জীবনবোধ। সর্বতো, জীবনবোধ কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি কেবল জীবনের ঘটনা বা পরিস্থিতি বর্ণনা করে না, বরং জীবনের অর্থ, উদ্দেশ্য, এবং মানব প্রকৃতির গভীরে প্রবেশ করে। একটি শক্তিশালী জীবনবোধ কবিতাকে আরও শক্তিশালী এবং অর্থবহ করে তোলে। 

        তিনি পৌনপৌনিক এবং পার্বিক প্রবাহনামায় থেকে ভাবের গভীরে গিয়ে শব্দমন্থনসহযোগে কবিতা সৃষ্টি করে চলেন। তার অনুষঙ্গে এবং প্রিয়রঙ্গে তো তিনিই। তিনি পরম অনবদ্যতার অনুষর্গে আদলবাহী ও বৃত্তবাহী হয়ে স্পর্শময়ের বৃত্তান্তে যান যেখানে শিশুসুলভ দ্যোতনা, সংসার সংসর্গে পরিশীলনে থাকে। তিনি লেখেন,

' ভোলা হলে ও ভুল করি না, করি অনেক কাজ

অনেক সময় মাথায় আসে পরতে মেয়ের সাজ

পায়ে নুপুর নাকে নোলক, পায়ে আঙুল চুটকি

গলায় ঝোলে একতাল সোনা, কপালে তির ফুটকি।

তাই বলে আর ভুল বুঝিস না, 

করছি আমি মজা

ভেবে দেখ সেই ছোট্ট বেলায় যেতাম খেতে গজা।

খেলেই গজা কি ভালো লাগে, নয় কো যুগটা সোজা

বাবা মায়েরা ছেলের কাছে হয়েছে আজ বোঝা।

যুগটা আজ পাল্টে গেছে

সংসারেতে নয় কো চলা সোজা

শীত যা এখন পড়েছে ভাই, সকলে হাতে পরছে মোজা।

হাতে মোজা পায়ে মোজা, মোজা অনেক রকম

দেখছি চালে পায়রাগুলো করছে বকম্ বকম্।'২

      তবু চলা জীবন বৃত্তে অনন্য অধ্যায়াংশে, যেখানে যাবতীয় স্বরূপতা নিরন্তরতার তীর্থে বিন্যাসময় হয়।

        কাব্যরসিক শক্তিপদ সেন অনুভব করেন, সংযুক্ততায় কবিতার অনুষঙ্গ বলতে বোঝায়, কবিতার সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য ধারণা, চিত্রকল্প, প্রতীক, বা আনুষঙ্গিক বিষয় যা কবিতার অর্থকে আরও স্পষ্ট করে তোলে বা একটি নতুন মাত্রা যোগ করে,এবং

একটি কবিতায় ব্যবহৃত উপমা, রূপক, বা প্রতীকগুলি তার অন্তর্নিহিত অর্থকে আরও গভীর করে তোলে;

সুতরাং, কবিতা, জীবনবোধ, এবং অনুষঙ্গ একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত

; একটি সার্থক কবিতা কেবল শব্দের খেলা নয়, বরং এটি জীবন, অভিজ্ঞতা, এবং দর্শনের একটি গভীর উপলব্ধি।

            কবি শক্তিপদ সেন জীবনদোলার সংগৃহীত উপক্রমন থেকে সক্ষমতা অর্জন করে আনুপূর্বিক হন, হন জীবনযোগের অংশী। তিনি লেখেন,

' দেখে তাদের ঘোরাফেরা, চলার রকম সকম

বুঝতে নারি ভাষা তাদের হই না মোরা সক্ষম।

পশুপক্ষীর ভাষা বোঝা অত সহজ নয়

ভাষা যতই বুঝে থাকো, তবু মানুষকেই ভয়।

প্রাচীনকালে পশুপক্ষীর ডাকে গান নাকি ছিল

সেই সুরেতে নচিকেতা গান গাইতে এল।

এমন সব গান গাইল, গাইল নচিকেতা

নয় কো তার সাথে পাল্লা দিয়ে জেতা।

পাখির ডাকে ভোর হয় যে, সূয্যিমামা ওঠে

আঁধার কাটে দিকে দিকে , ফুল যে সকল ফুটে।

সেই ফুলেতে গন্ধ ছড়ায় দিকে দিকে তায়

হৃদয় কুসুম তুমিও ফোটাও, পৃথ্বীও তাই চায়।'৩

        সর্বসারে, বলা চলে কবি শক্তিপদ সেন আত্ম তরঙ্গে উদ্ভাসিত হয়ে কবিতা রচনায় নিমগ্ন থাকেন।  তিনি উপলব্ধির সারাৎসারে জীবনবোধকে একন্নিষ্ট করে কবিতার সমাপনে যান, যান কবিতার অঙ্গনে। তার কবিতায় চলমান অনুষঙ্গ, পরিসর,পরিবেশ সঙ্গীভূত অনুরণনে থাকে, থাকে অভিব্যক্তিময় আত্মকথনে।একটি কবিতা,


' সম্পৃক্ত সাজুয্যে তোমার নাম

সতত নান্দনিকতায় থাকে,

থাকে রোদ্দুর মাখা আবর্তে

                    শুদ্ধ পরিসরে।


তুমি তো চিরায়ত সৌন্দর্যে

বিস্তীর্ণ প্রান্তর আঁকো কবিতায়।

তুমি, হ্যাঁ তুমিই তো বিচিত্রতার সমাহারে আবেশ হও

ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সর্বতো।'৪

            তিনি আধারপ্রবাহের যোগাযোগনামায় সুদুর সত্যে যান, যান সংশ্লেষে ।এখানেই তার কবিতার সংকূলান, প্রত্যয়ণনামা।

তিনি হৃদয়ে আকূলায়িত থাকেন এই ভেবে যে

কবিতার সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য উপাদান বা ধারণা, যা কবিতাকে  মুহূর্তের যোগাযোগে অংশবাহী করে।তার কবিতায় সময়ের সাজুকতা নিত্যতার আধারে সহজতায় যায়, আবার ডিগবাজীও খায়। তিনি লেখেন,


' বিপন্ন সময় ধরেছে ঘিরিয়া

সমাজের  ভালোমন্দ

দিকনির্ণয় করে দেয় তারা

রাখে না মনেতে দ্বন্দ্ব।

ধর্মের নামে ডিগবাজী খায়

সাধারণ মানুষ নিত্য

আগে যে ছিল সহজ সরল 

এখন পা-চাটা ভৃত্য।

আগে যে ছিল সত্যের পথে 

পথ ভুলে গেছে আজ

তাই সে আজ চলেছে বিপথে

মাথায় পড়েছে বাজ।'৫

       সম্পন্নতার অনন্য প্রপালনে এবং শব্দ ও ভাবময় মাহাত্মে কবি শক্তিপদ সেন যথাযথ অনুশীলনসাপেক্ষে উপযোগী হন কবিতা সৃষ্টিতে। তিনি আবেগঘন ঋদ্ধিতে বা বিপন্নতায় সময়কে চিত্রায়িত করেন। তিনি লেখেন, 

' এক ঝুড়ি পচা আম মাঝে

থাকে যদি ভালো আম

সেও তো ভাই অচিরে পচিবে 

ভুলিয়া বাপের নাম।

আজিকে এমত ভোগী দুনিয়ায়

থাকে কি কেউ নিরপেক্ষ?

বাঁদিকের মাল ডাইনেতে ঘুরে

করে ত্যাগ নিজ কক্ষ।

চলে যায় সবে নিজস্থান ছেড়ে

চলে যায় পরপক্ষে

শিরদাঁড়াটা ভাঙ্গিয়া গিয়াছে

সবাকার অলক্ষ্যে।'৬                                  


          আবার সাম্বন্ধিক সচেতন সংস্কারে কবি শক্তিপদ সেন আনুপূর্বিক ও আনুপাতিক অবস্থানে মুহূর্তকে মন্থনময় করে অভিজ্ঞতার আবর্তে যান, যেখানে আবেগময় অনিবার্যতা চেতনার গভীরে প্রতিফলন ঘটায়।এখানে সম্পর্কায়ণে সমৃদ্ধি দূর্দান্ত নাচনে ভাঙড়া বা ঝগড়ায় রুপান্তরিত হয়। তিনি লেখেন,

' জোরে জোরে বাজে নিগড়া

উদ্দাম নাচে--

নাচে যত উলুখাগড়া

মানুষের মাঝে আগড়া

শরীরটা যদি তাগড়া

শুভ কাজে দেয় বাগড়া।

তাদের--

মনটা করতে শান্ত

নেচেছে যদি বা দুর্দান্ত

ঢালো মাথে হিমশীতল পানি

চলে যাক সব শিবের থানে

চলে যাক সবে ভগড়া।

পরে সব তারা সব বুঝে গেলে  আর

না করবে অযথা ঝগড়া।'৭

          সর্বপোরি, শক্তিপদ সেনের কবিতায় আনুপূর্বিক অনন্যতা শব্দ ও ভাব বিনিয়োগের সম্পর্কে  অপরিহার্যতা পায় যেখানে জীবনোধ অনুসঙ্গের আবর্তে মৌলিকতা এবং যৌগিকতার   সংস্পর্শে সুদুরপ্রসারী হয়।

..............................

 তথ্যসূত্র

১. শক্তিপদ সেন- নূতন প্রভাত; প্রকাশিকা-  কল্পনা সেন,২০২১; পৃ-৫২;

২.ঐ;

৩.ঐ;পৃ- ৫২-৫৩;

৪.লেখক- তাৎক্ষণিক কবিতা;

৫. শক্তিপদ সেন; নূতন পৃথিবীর পথে; প্রকাশিকা- কল্পনা সেন; ২০২০; পৃ- ৫১;

৬ .ঐ;

৭. ঐ; পৃ-৬০;

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url