ভূস্বর্গ সন্দর্শনের স্বপ্ন সার্থক, লেখক - মজিবুর রহমান, প্রধানশিক্ষক, কাবিলপুর হাইস্কুল
ভূস্বর্গ সন্দর্শনের স্বপ্ন সার্থক
মজিবুর রহমান, প্রধানশিক্ষক, কাবিলপুর হাইস্কুল
কাশ্মীর সফরের ইচ্ছে আমার অনেক দিনের। ঐতিহাসিক অথবা ভৌগলিক গুরুত্ব সম্পন্ন দেশবিদেশের বেশকিছু স্থানে ভ্রমণে গেলেও কাশ্মীরটা হয়ে উঠছিল না। এবছর (২০২৫) মার্চের প্রথম সপ্তাহে পারিবারিক সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়- এবারের গন্তব্যস্থল কাশ্মীর। পরিবার বলতে 'হাম দো হামারা দো'- আমি মজিবুর রহমান (৫০), আমার সহধর্মিনী নাফিসা আলম (৪৬), ছেলে অকৈতব আবেদিন বৈভব (২১) ও মেয়ে সুহানা রেহমান (১৩)। বৈভব ল' নিয়ে পড়ে, কলকাতায় থাকে। ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে কথাবার্তা বলা সহ প্রায় পুরো বিষয়টি বৈভবই দেখে। ২১শে মার্চ এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটের টিকিট কাটা হয়। সূচি স্থির হয়- ২৪.৬.২০২৫: কলকাতা-দিল্লি-শ্রীনগর এবং ১.৭.২০২৫: শ্রীনগর-দিল্লি-কলকাতা। ২২শে এপ্রিল ঘটে যায় পাহালগামের ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড। স্বাভাবিকভাবেই ট্যুর বাতিলের কথা ওঠে। আমি তাড়াহুড়ো না করে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখি এবং মনে মনে ঠিক করি ট্যুর এজেন্সি ট্রিপ বাতিল না করলে অবশ্যই যাবো। ১২ই জুন আমেদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। আবারও সফরের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পূর্ব নির্ধারিত সফরসূচি অপরিবর্তিতই থাকে।
সাত রাত ও আট দিনের সফরে কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যথাসম্ভব উপভোগ করেছি। কাশ্মীরের মাটি ও মানুষ তথা সংস্কৃতিকে বুঝতে চেষ্টা করেছি। ইতিহাসের পাঠ ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া ধারণার সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতির মিল-অমিল সন্ধান করেছি। তবে এটা ঠিক যে, মাত্র এক সপ্তাহের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটা বৃহৎ জনপদ ও পুরনো জনগোষ্ঠী সম্পর্কে গভীর সত্য আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। সেটা অবশ্য একজন সাধারণ পর্যটকের কাজও নয়।
কাশ্মীরের বিভিন্ন দিকে প্রচুর দর্শনীয় স্থান (Sightseeing) রয়েছে। সবগুলোই ভালোভাবে দেখতে অন্তত এক মাস সময় দরকার। সময়ের স্বল্পতার কারণে ট্যুর এজেন্সির প্যাকেজে কোনো একটি স্থানের সকল দৃশ্য, মুহূর্ত বা স্পট অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। কোনো কোনো পয়েন্ট প্রশাসনিক অথবা আবহাওয়ার কারণে কখনও কখনও বন্ধ রাখাও হয়।
আমাদের ভ্রমণের বন্দোবস্ত করে রাহেজা ভ্যাকেশনস প্রাইভেট লিমিটেড। হোটেল, প্রাতরাশ ও নৈশাহার সহ গাড়িতে ঘোরানোর চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী শ্রীনগরে হোটেল সিটি গ্ৰেস-এ ২৪-২৮ জুন পাঁচ রাত, পাহালগামে হোটেল ভ্যালি রিসর্ট-এ ২৯শে জুন এক রাত এবং শ্রীনগরে হাউসবোট সুলতান-এ ৩০শে জুন এক রাত থাকি। ২৪শে জুন শ্রীনগর বিমানবন্দর থেকে শহরে প্রবেশ এবং পয়লা জুলাই প্রস্থানপূর্বক সেখানে পৌঁছনো সহ মাঝের দিনগুলোতে ঘোরাঘুরি করি একটি টয়োটা গাড়িতে। গাড়িচালক ছিলেন বছর পঁয়তাল্লিশের মোহাম্মদ ইকবাল মীর। এই ক'দিনের আলাপে ইকবালকে একজন সময়জ্ঞান ও বোধবুদ্ধি সম্পন্ন ভালো মানুষ বলে মনে হয়েছে। উনি কার্যত আমাদের গাইডের ভূমিকাও পালন করেন।
ঝিলাম নদীর তীরে অবস্থিত শ্রীনগর জম্মু ও কাশ্মীরের গ্ৰীষ্মকালীন রাজধানী ও একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র। এখানকার হ্রদ, পাহাড়, সবুজ মাঠ, বার্চ ও উইলো গাছে পূর্ণ অরণ্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এই উইলো গাছের কাঠ থেকে ক্রিকেটের ব্যাট তৈরি হয়। শ্রীনগর কার্পেট, রেশম, পশম, কাঠ ও চামড়াজাত কুটিরশিল্পের জন্য বিখ্যাত।
লালচক কলকাতার ধর্মতলার মতো শ্রীনগরের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এটি রাজনৈতিক সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের সেরা ঠিকানা। একটি ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকাও বটে। প্রচুর পায়রার সমাগম লালচকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। ১৯৮০ সালে নির্মিত এখানকার সুদৃশ্য ক্লক টাওয়ার (ঘণ্টা ঘর) শ্রীনগর শহরের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। টাওয়ারের মাথায় পৎপৎ করে উড়ছে ভারতীয় জাতীয় পতাকা।
১৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ডাল লেক শ্রীনগরের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এখানে জলাশয়ের ওপর হাউসবোটে রাত্রি কাটানো একটা দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। বিশেষ ধরনের নৌকা শিকারায় চড়ে হ্রদটা ঘুরে দেখাটাও খুব মজাদার ব্যাপার। এখানকার ভাসমান মীনা বাজারে কাশ্মীরি শাল, কাঠের কাজ, শুকনো ফল এবং আরও অনেককিছু পাওয়া যায়।
ডাল লেকের পূর্ব প্রান্তে রয়েছে ১৬৩৩ সালে সৃষ্ট নিশাত বাগ মুঘল গার্ডেন। উর্দুতে নিশাত শব্দের অর্থ আনন্দ। তাই এটার অপর নাম আনন্দ উদ্যান। এই মনোরম উদ্যানে সময় কাটালে মন ভালো হওয়ারই কথা।
ডাল লেকের সঙ্গে একটি প্রণালীর মাধ্যমে সংযুক্ত রয়েছে শালিমার বাগ। শালিমার একটি ফার্সি শব্দ যার অর্থ 'সুন্দর বাগান' বা 'স্বর্গীয় স্থান'। ১৬১৯ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর (১৫৬৯-১৬২৭) তাঁর স্ত্রী নূর জাহানের (১৫৭৭-১৬৪৫) জন্য এই উদ্যানটি নির্মাণ করেন। ৩১ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই মুঘল গার্ডেনে জলের ফোয়ারা ও চিনার গাছের আধিক্য পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ডাল লেকের উত্তর তীরে রয়েছে হযরতবাল মাজার বা দরগাহ শরীফ। সম্রাট শাহজাহানের (১৫৯২-১৬৬৬) সময় সুবেদার সাদিক খান ১৬৩৪ সালে এটি নির্মাণ করেন। এখানে সম্রাট ঔরঙ্গজেবের (১৬১৮-১৭০৭) হাতের লেখা কুরআনের একটি কপি সংরক্ষিত রয়েছে।
ডাল লেকের পশ্চিমে শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে শ্রীনগরের ভূমিপৃষ্ঠ থেকে ১১০০ ফুট উচ্চতায় শারিকা পাহাড়ের উপরে অবস্থান করছে হরি পর্বত দুর্গ। দুর্গের প্রাচীরটি মুঘল সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৫) কর্তৃক ১৫৯৭ সালে নির্মিত হয়। পরবর্তীতে আফগান দুররানি শাসনামলে কাশ্মীরের গভর্নর আতা মোহাম্মদ খান ১৭৯৫-১৮০৬ সালে দুর্গটি নির্মাণ করেন। ১৫০টি সিঁড়ি বেয়ে দুর্গের মাথায় পৌঁছানো যায়। আরোহণে কষ্ট হলেও অবতরণে আরাম। দুর্গে মন্দির, মসজিদ ও গুরুদ্বারা রয়েছে। দুর্গ থেকে ডাল লেক এবং আশপাশের অন্যান্য এলাকার মনোরম দৃশ্য দেখা যায়। এখন এই দুর্গে বিএসএফ-এর ক্যাম্প রয়েছে। দুর্গের মাথায় উড়ছে ভারতীয় জাতীয় পতাকা।
শ্রীনগরের পার্শ্ববর্তী গান্ডারবাল জেলার মানসবল হ্রদের প্রান্ত সারা বছর পদ্ম গাছে পূর্ণ থাকে। চারটি গ্ৰাম দ্বারা বেষ্টিত এই দৃষ্টিনন্দন হ্রদটির জল মিষ্টি। হ্রদের পাশে একটা পার্ক রয়েছে। হ্রদের চারপাশে হাঁটার জন্য ওয়াকওয়ে তৈরি করা হয়েছে। এখানে শিকারা রাইডের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রচুর জলজ পাখি হ্রদটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
মানসবলের অদূরেই রয়েছে ভারতের বৃহত্তম স্বাদু পানির হ্রদ উলার হ্রদ। এখানেও প্রচুর পরিমাণে পাখি বাস করে। অনেক পরিবার এই হ্রদের জলজ উদ্ভিদ থেকে মানুষের খাবার ও পশুখাদ্য সংগ্রহ করে। কাশ্মীরের মোট মাছের অর্ধেকের বেশি এই হ্রদ থেকে সংগৃহীত হয়। ১৯৯০ সালে এটিকে আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে।
শ্রীনগর থেকে ৮১ কিলোমিটার দূরে সিন্ধু নদীর তীরে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত সোনমার্গ বা স্বর্ণময় তৃণভূমি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত হলেও স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এলাকাটি অনুপযোগী। এই মনোরম শহরের পটভূমিতে রয়েছে তুষারময় পাহাড়ের পেছনে সুনীল আকাশ। সিন্ধু নদীর স্ফটিক স্বচ্ছ বারিধারা সোনমার্গের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। দুই লেন বিশিষ্ট সাড়ে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সুদৃশ্য সোনমার্গ সুড়ঙ্গ অতিক্রম করতে সময় লাগে পনের মিনিট। ১৩.১.২০২৫ তারিখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সুড়ঙ্গটি উদ্বোধন করেন। সোনমার্গ থেকে পায়ে হেঁটে অথবা ঘোড়ায় চড়ে তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পৌঁছতে হয় বিখ্যাত থাজিয়াস হিমবাহে। এখানকার মায়াবী প্রাকৃতিক পরিবেশে একাধিক হিন্দি ছায়াছবির শ্যুটিং হয়েছে। আমাদের চারজনের ক্ষেত্রেই সোনমার্গে জীবনে প্রথমবারের মতো হর্স রাইডের অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়।
সোনমার্গ থেকে দশ কিলোমিটার দূরে সিন্ধু নদীর তীরে অবস্থান করছে কাশ্মীর উপত্যকার অন্তিম জনবসতি সরবাল। সরবালবাসীদের জীবিকা মূলত কৃষিনির্ভর। গ্ৰামবাসীরা শীতকালে ভারী তুষারপাতের কারণে ফি বছর বাড়িঘর ছেড়ে আশেপাশের এলাকায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
হিমালয় পর্বতমালার অন্যতম উচ্চতম গিরিপথ জোজিলা পাস কাশ্মীর উপত্যকা ও লাদাখের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। শ্রীনগর থেকে ১০৮ কিলোমিটার দূরবর্তী জোজিলা পাস জিরো পয়েন্টের উচ্চতা ১১৬৪৯ ফুট। ১৯৪৭-৪৮ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর বীরত্ব ও আত্মত্যাগের স্মৃতিতে নির্মিত হয়েছে জোজিলা ওয়ার মেমোরিয়াল। এখানে সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা ও সিন্ধু নদীর জলধারার সংমিশ্রণে অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে।
শ্রীনগর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৬৯০ ফুট উচ্চতায় পীর পাঞ্জাল পর্বতমালায় এবং বারামুল্লা জেলায় অবস্থিত গুলমার্গের সামগ্ৰিক সৌন্দর্য অনির্বচনীয়। গুলমার্গ শব্দের অর্থ ফুলের বাগান। গুলমার্গের ফুলেল শুভেচ্ছায় পর্যটক বিমোহিত হতে বাধ্য। প্রাকৃতিক কারণে বসবাসের উপযোগী না হলেও গল্ফিং, ট্রেকিং, স্কিইং ও হর্স রাইডের দুর্দান্ত সুযোগ সহ নানাবিধ উপকরণ নিয়ে পর্যটকদের মনোরঞ্জন করতে গুলমার্গের জুড়ি নেই।
গুলমার্গ গল্ফ ক্লাব বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং ভারতের দ্বিতীয় দীর্ঘতম গল্ফ কোর্স। ৭৫০৫ গজ বিশিষ্ট এই গল্ফ কোর্সে ১৮টি গর্ত রয়েছে। গুলমার্গ গন্ডোলা কেবল রাইড এশিয়ার দীর্ঘতম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতম। এমন উচ্চতা থেকে আশেপাশের ও নিচের দৃশ্যাবলী দেখতে দারুণ লাগে। ফেজ ১ কেবল রাইড দশ মিনিটে গুলমার্গ থেকে ৩০৫০ মিটার উচ্চতায় কংডোরি পৌঁছে দেয়। ফেজ ২ কংডোরি থেকে ৪৩৯০ মিটার উচ্চতায় আফারওয়াত শিখর পর্যন্ত বিস্তৃত। আফারওয়াত শৃঙ্গের পাদদেশে রয়েছে আলপাথার হ্রদ। বছরের বেশিরভাগ সময় বরফে ঢাকা থাকে বলে এটিকে হিমায়িত হ্রদ বলে।
গুলমার্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন হল মহারাজা প্যালেস। ৮৭০০ বর্গফুটের এই চমৎকার স্মৃতিসৌধটি কাশ্মীরের রাজকীয় অতীতের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে তুলে ধরে।
গুলমার্গ সেনা জাদুঘর ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস প্রদর্শন করে। পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন সামরিক সংঘাতের তথ্য তুলে ধরে। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে অত্যাধুনিক জাদুঘরে শহীদ সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন সহ কাশ্মীরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নমুনা দর্শন পর্যটকদের জন্য একটি বাড়তি প্রাপ্তি।
শ্রীনগর থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে অনন্তবাগ জেলায় লিডার নদীর তীরে অবস্থিত পর্যটন কেন্দ্র পাহালগামে একাধিক দৃষ্টিনন্দন পার্ক, উদ্যান ও হিমবাহ রয়েছে। পায়ে হেঁটে, ঘোড়ায় চড়ে ও গাড়িতে চেপে সেসব ঘুরে দেখা যায়। জুলাই-আগস্ট মাসে অমরনাথ মন্দিরের বার্ষিক তীর্থযাত্রার সূচনা এখান থেকেই হয়ে থাকে। এখানকার বাইসারন উপত্যকা অপরূপ সৌন্দর্যের কারণে 'ভারতের মিনি সুইজারল্যান্ড' নামে পরিচিত। ২২শে এপ্রিলের ঘটনার পর থেকে বাইসারন সহ পাহালগামের একাধিক ট্যুরিস্ট স্পট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। এজন্য ঘোড়ায় চড়ে তিন-চারটি পয়েন্ট দেখেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।
কাশ্মীরের চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে আপেল, আখরোট, নাশপাতি, চেরি ও বেরি ফলের বাগান। এসব ফলের বাগান যেমন দেখেছি তেমনি দেখেছি পাহালগামের কাছাকাছি সঙ্গম বলে একটি জায়গায় ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কারখানা।
কাশ্মীরের মনোমুগ্ধকর ভূপ্রকৃতির মতো কাশ্মীরিদের মানসিক গঠনের মধ্যেও একটা মিষ্টতা রয়েছে। কাশ্মীরি নর ও নারীরা সাধারণত টিকালো নাক ও ফর্সা রংয়ের সমন্বয়ে সুদর্শন ও সুদেহী হন। তাঁদের চেহারার মতো আচরণও সুন্দর। মাথা গরম করে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন না। তরুণ-তরুণী সহ পরিণত বয়সের মানুষজন সকলেই কাশ্মীরের ট্র্যাডিশনাল পোশাক পরতে পছন্দ করেন। নিজেদের মধ্যে কাশ্মীরি ভাষায় কথা বলেন। কাশ্মীরের মানুষ যথেষ্ট অতিথিবৎসল হন। পর্যটকদের সঙ্গে কখনও দুর্ব্যবহার করেন না। মিথ্যাচার অথবা প্রতারণামূলক আচরণ পরিহার করেন। পুরুষরা সিগারেট ও হুঁকা খান কিন্তু কেউই মদ্যপান করেন না। তাই কোথাও মাতলামি করার দৃশ্য দেখা যায় না। জীবন যাপনে কোনো উচ্ছৃঙ্খলতা থাকে না। কাশ্মীরে নৈশক্লাব বলে কিছু নেই। কাশ্মীরের মানুষ বিশ্বাস করেন- দিনে কাম রাতে আরাম। তাই সন্ধ্যা রাতেই বিভিন্ন পণ্যের দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। কাশ্মীরে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বাইরে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সংঘাতে কোনো খুনোখুনির ঘটনা ঘটে না। শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ এককথায় নারী নির্যাতন নেই। চুরি ডাকাতি ছিনতাইয়ের কেস কম। বহুবিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাও বিরল।
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে নবগঠিত পাকিস্তান ও ভারতের পাশাপাশি জম্মু-কাশ্মীর একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৭-এর অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের কিছু হানাদার কাশ্মীরে ঢুকে পড়ে। রাজা হরি সিং তাদের বিতাড়িত করতে ব্যর্থ হয়ে ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। এরকম একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনি ভারতভুক্তির চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। ভারত-পাক যুদ্ধ শেষে কাশ্মীরের একটা অংশ পাকিস্তানের দখলে চলে যায়। বাকিটুকু থাকে ভারতে। কাশ্মীরিদের অখণ্ড স্বাধীন কাশ্মীরের স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে যায়। সেই স্বপ্নভঙ্গের ক্ষত বিগত আট দশকেও শুকোয়নি। ভারত নয় পাকিস্তান নয় কাশ্মীরিদের চেতনায় আজও সক্রিয় রয়েছে আজাদ কাশ্মীরের আকাঙ্ক্ষা।
কাশ্মীরের জঙ্গিবাদ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যত প্রচার করা হয় বাস্তব পরিস্থিতি ততটা ভয়ংকর নয় বলেই কাশ্মীরিদের বিশ্বাস। সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ সম্পর্কিত প্রচারের বাড়াবাড়িতে উপত্যকার বাইরে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হওয়ার জন্য কাশ্মীরের মানুষ সংবাদমাধ্যমের ওপর ভীষণ অসন্তুষ্ট। মিলিট্যান্সিকে দমন করার নামে কাশ্মীরে যে পরিমাণ মিলিটারি মোতায়েন করা হয়েছে তার প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা নিয়েও কাশ্মীরিদের মনে প্রশ্ন আছে। সাম্প্রতিক পহেলগাঁওকাণ্ডকে কেন্দ্র করে যে আখ্যান তৈরি করা হয়েছে তার সঙ্গে স্থানীয় মানুষ সহমত পোষণ করেন না।
কাশ্মীরের মানুষ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ভারতের অন্যান্য রাজ্যে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। অবশিষ্ট ভারতবাসী কাশ্মীরিদের যে দৃষ্টিতে দেখেন তাতে তাঁরা বিচলিত ও অসম্মানিতবোধ করেন। তাই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাশ্মীরিরা উপত্যকার বাইরে যেতে চান না। জম্মু-কাশ্মীরের এক অংশের মানুষ অন্য অংশ ঘুরে দেখেন। আমরা এই ক'দিন বিদেশী বা বহিরাগত পর্যটকের চেয়ে স্থানীয় পর্যটকই বেশি দেখলাম।
গোটা কাশ্মীর জুড়ে স্থানীয় পুলিশ ছাড়াও রয়েছে প্রচুর কেন্দ্রীয় বাহিনী- বি এস এফ, সি আর পি এফ। শ্রীনগর শহরে কয়েক হাত অন্তর অন্তর সেনারা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমরা যত কেন্দ্রীয় বাহিনীর গাড়ি দেখেছি তত পাবলিক বাস দেখিনি। সি আর পি এফ-এর কনভয় পাস করার জন্যেও অন্যান্য গাড়িকে আটকে রাখা হয়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও রাজনৈতিক বিতর্ক- এই দুই দিক থেকে কাশ্মীর অনন্য হয়ে উঠেছে। কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অকাশ্মীরিদের আকৃষ্ট করে কিন্তু কাশ্মীর কেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতা পর্যটকদের সেখানে যেতে নিরুৎসাহিত করে। কাশ্মীরের ভৌগলিক অবস্থান কাশ্মীরিদের দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত-পাক শত্রুতামূলক সম্পর্কের শিকার হচ্ছে কাশ্মীর।
আমরা বাঙালিরা অসহ্য গরমের হাত থেকে রেহাই পেতে একটু পাহাড়ে ঘুরতে যাই। এবার কিন্তু আমাদের সেটা হল না। কাশ্মীরে কোথাও শীতের সন্ধান পেলাম না। আমাদের সমস্ত শীতবস্ত্র ব্যাগবন্দিই রয়ে গেল। গাড়িতে-হোটেলে ফ্যান-এসি ব্যবহার করতে হল। আসলে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত এখানেও অনেক রোদ পড়ে এবং গরম লাগে। তবে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কম থাকায় ভ্যাপসা ভাবটা থাকে না। এই কটা দিন কাশ্মীরের মানুষ শীতবস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ রাখতে পারে। অন্যদিকে, অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত ছ'মাস কাশ্মীর তুষারাবৃত থাকে। কাশ্মীরের সৌন্দর্য বহিরাগত পর্যটকদের মানসিক প্রশান্তি দিলেও শারীরিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে না। এক সপ্তাহের সফরেই আমাদের শরীরে ট্যান পড়েছে।
কাশ্মীরের অনেক জায়গাতেই ফলকের ওপর লেখা থাকে: ওয়েলকাম টু প্যারাডাইস অন আর্থ। সবুজ উপত্যকা, তুষারাবৃত পর্বত, সুন্দর হ্রদ, হিমবাহ, জলপ্রপাত, বিস্তীর্ণ বাগান, তৃণভূমি, বিশাল বৃক্ষ কাশ্মীরের প্রাকৃতিক পরিবেশকে যে বিশিষ্টতা প্রদান করেছে তাতে পরকালের কল্পিত স্বর্গ যেন ইহকালেই বাস্তব হয়ে উঠেছে। ফার্সি ভাষার কবি আমির খসরু (১২৫৩-১৩২৫) লিখেছিলেন, "অগর ফিরদৌস বর রুয়ে জমিন অস্ত/হমিন অস্ত...হমিন অস্ত...হমিন অস্ত!" এর অর্থ হল: "পৃথিবীতে স্বর্গ যদি কোথাও থেকে থাকে, তা সে/এখানেই... এখানেই... এখানেই!" হ্যাঁ, এই শায়েরী কাশ্মীরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
No comments