ভ্রমণ কাহিনী - নিউইয়র্কের সেই দিনগুলো, লেখক - ডক্টর মোঃ বদরুল আলম সোহাগ (বাংলাদেশ)
ভ্রমণ কাহিনী - নিউইয়র্কের সেই দিনগুলো
ডক্টর মোঃ বদরুল আলম সোহাগ (বাংলাদেশ)
*************************
নভেম্বর মাসের নিউইয়র্ক, বর্ণিল গাছপালা, ঠান্ডা আবহাওয়া, এবং ছুটির প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে এক অসাধারণ রূপ ধারণ করে। এই সময়টায় নিউইয়র্কের প্রতিটি কোণায় এক ধরনের শীতল অথচ উষ্ণ অনুভূতি থাকে, যা ভ্রমণকারীদের অভিজ্ঞতাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। আমি এই নভেম্বরে নিউইয়র্কে ভ্রমণ করার এক অবিস্মরণীয় সুযোগ পেয়েছিলাম এবং সেই অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই।
যাত্রার সূচনা:
আমার যাত্রা শুরু হলো JFK বিমানবন্দরে পা রেখেই। এই শহরে আসার প্রথম মুহূর্তেই প্রচণ্ড ঠান্ডা অনুভব করেছিলাম, যা আমাদের দেশে থাকে না। বিশাল বিমানবন্দর, কড়া নিরাপত্তা, ভিন্ন জাতির মানুষের আনাগোনা—সব মিলিয়ে এক নতুন অভিজ্ঞতা। শহরে পৌঁছানোর পর প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে, সেটা হলো নিউইয়র্কের আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলো। তাদের অসামান্য সৌন্দর্য এবং বিশালত্ব মনকে মুগ্ধ করে।
সেন্ট্রাল পার্কে এক সকাল:
নিউইয়র্কে নভেম্বরে গেলে সেন্ট্রাল পার্কে যাওয়া একদমই আবশ্যক। হোটেল থেকে পার্কের দিকে রওনা হলাম। তখনো সূর্য ঠিকমতো ওঠেনি, হালকা কুয়াশা চারপাশে ছড়িয়ে ছিল। গাছগুলোকে দেখলাম নানা রঙে সজ্জিত—কিছু গাছের পাতা লাল, কিছু কমলা আর কিছু হলুদ। মাটিতে পড়া পাতাগুলোকে দেখে মনে হলো যেন পুরো পার্কটি একটি প্রাকৃতিক কার্পেট দিয়ে সাজানো। এক পাশে কিছু মানুষ জগিং করছিলেন, আর অন্য পাশে কেউ কেউ কফির কাপ হাতে নিয়ে পাতা ভেজানো পথে হাঁটছিলেন। সেন্ট্রাল পার্কে কাটানো এই শান্ত সকালটা আমার নিউইয়র্ক ভ্রমণের অন্যতম প্রিয় স্মৃতি।
টাইমস স্কয়ারের উজ্জ্বলতা:
দিনের শেষে গন্তব্য ছিল টাইমস স্কয়ার। সন্ধ্যা নামতেই এই জায়গাটি এক অন্যরকম রূপ ধারণ করে। সেখানে গিয়ে দেখি, প্রতিটি বিলবোর্ডে আলোর ঝলকানি, বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের স্লোগান আর মানুষের ভিড়। পুরো জায়গাটিকে মনে হয় যেন আলোর এক বিশাল সমুদ্র। একদিকে বড় বড় বিজ্ঞাপন, আরেকদিকে নানা ধরনের খাবারের দোকান। আমি একটা হট ডগ নিয়ে একটা বেঞ্চে বসে পুরো পরিবেশটা উপভোগ করতে থাকলাম। টাইমস স্কয়ারে বসে মানুষের কোলাহল, আলো-ঝলমল পরিবেশ আর উদ্দীপনা দেখে মনে হলো যেন আমি কোনো উৎসবের মধ্যে এসে পড়েছি।
মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট (MoMA) পরিদর্শন:
পরের দিন সকালে আমি চলে গেলাম মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টে, যেখানে বিশ্বের বিখ্যাত শিল্পকর্ম সংরক্ষিত আছে। ভিতরে ঢুকতেই অনেকগুলো কক্ষে সাজানো বিভিন্ন শিল্পকর্ম দেখে আমি অভিভূত হয়ে পড়ি। ভিনসেন্ট ভ্যান গগের "স্টারি নাইট," পিকাসোর "দ্য উইপিং ওম্যান," এবং আরও অসংখ্য শিল্পকর্ম এই জাদুঘরে রয়েছে। প্রতিটি শিল্পকর্মের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তাদের গভীরতা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছিলাম। আর্টের প্রতি ভালোবাসা থাকলে MoMA একটি অসাধারণ জায়গা।
ব্রুকলিন ব্রিজে সূর্যাস্ত:
বিকেলে চলে গেলাম ব্রুকলিন ব্রিজে। নিউইয়র্কের এক ঐতিহাসিক স্থাপনা। সেখান থেকে সূর্যাস্ত দেখার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু একটু করে সূর্য যখন ডুবছিল, তখন আকাশের রং পরিবর্তন হতে লাগল—কখনো কমলা, কখনো গোলাপি, কখনো নীল। ব্রুকলিন ব্রিজ থেকে সিটি স্কাইলাইন এবং হাডসন নদীর উপর পড়া সূর্যের আলো পুরো দৃশ্যটাকে মুগ্ধ করে তুলেছিল। এই মুহূর্তে প্রকৃতির এমন সৌন্দর্য দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম।
কিছু খাবারের স্বাদ:
নিউইয়র্কে এসে স্থানীয় খাবার না খেলে ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সেখানকার বিখ্যাত কিছু খাবারের মধ্যে প্রথমেই বলবো নিউইয়র্ক স্টাইল পিৎজার কথা। চিকন ক্রাস্ট আর প্রচুর টপিংসসহ সেই পিৎজা একেবারেই অসাধারণ। এছাড়া, নিউইয়র্ক চিজকেকও দারুণ। আরেকটি বিশেষ অভিজ্ঞতা হলো চায়না টাউনে চাইনিজ খাবারের স্বাদ নেয়া। নানা ধরনের নুডুলস আর ডাম্পলিংয়ের স্বাদ আমার জিভে লেগে আছে।
যাত্রার সমাপ্তি:
নভেম্বরে নিউইয়র্কে ভ্রমণ করার এই স্মৃতিগুলো আমার মনে গভীরভাবে গেঁথে থাকবে। এই শহরের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি স্থান, প্রতিটি মুখ—সবকিছুই যেন এক মায়াবী সুরে বাঁধা। নিউইয়র্কের এই ভ্রমণ শুধুমাত্র একটি সফর ছিল না, বরং এটি ছিল নতুন কিছু শেখার, নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করার এবং আমার মনকে আরও প্রসারিত করার একটি সুযোগ।
No comments