গল্প - মনুষ্যত্ববাদের জয়, লেখক - খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
মনুষ্যত্ববাদের জয়
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
প্রতিদিনকার মতো অমরেশবাবু, মানে অমরেশ ভট্টাচার্য্য খালি গায়ে Morning walk -এ বেরিয়েছেন। আগে সময় হোত না। ৫০ মাইল দূরে ছিল ওঁর স্কুল। কাক ভোরে চানদান পূজো আচ্চা সেরে দুপুরের খাবার ব্যাগেপুরে ছুটতে হোত সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকায় কালিতলা হাইস্কুলে। কাজেই প্রাতঃভ্রমণের কোন সুযোগ থাকতো না। ইচ্ছা থাকলেও উপায় ছিল না। কিন্তু দশ বছর হোল উনি অবসর নিয়েছেন। শীত বর্ষা গরম মানামানি নেই। প্রতিদিন খুব সকালে উনি হাঁটতে বের হন। সঙ্গে বাজারের থলি থাকে। ফেরার সময় বাজার করে ফেরেন। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
এখন সকাল সাড়ে আটটা বাজে। বাজার সেরে টোটোয় চেপে উনি ফিরছেন। নপাড়া রামকৃষ্ণ মিশনের মোড়ে আসতেই দেখলেন খুব জটলা। পাঁচ-সাতটা জোয়ান ছেলে গেরুয়া পতাকা হাতে স্লোগান দিচ্ছে "জয় গোমাতা কি জয়," "জয় ভারত মাতা কি জয়," আর দু'জন লাঠি দিয়ে মাঝবয়সী দাড়িওয়ালা একটি লোককে নির্মমভাবে পেটাচ্ছে। লোকটি তাদেরকে হাতে পায়ে ধরে অনুনয় বিনয় করছে--গোনা মাপ করুন বাবু! আর হবে না।
কিন্তু কার কথা কে শোনে?
অমরেশবাবু টোটোওয়ালাকে থামিয়ে গাড়ী থেকে নামলেন।
--এই, এই ছেলেরা, ওবেচারাকে মারছো কেন?
--মারবো না? আজ জন্মাষ্টমী। ভগবান শ্রী কৃষ্ণের জন্মদিন। আর এই শালা লেড়ের বাচ্চা গোমাতাকে খুন করে তার মাংস নিয়ে যাচ্ছে। ওকে আজ মেরেই ফেলবো।
--এই মুখ সামলে কথা বল।
--কেন? কি হয়েছেটা কি?
--ও সব কি ভাষা "লেড়ের বাচ্চা"?
--ও! তোমার খুব গায়ে লেগেছে বুঝি? গলায় তো পৈতে। কপালে আবার চন্দনের ফোঁটা। তুমি ব্রাহ্মণ না ব্রহ্মদত্যি?
--আমি ব্রহ্মদত্যি। দেখবি আমার স্বরূপ? পাশ থেকে একজন বললো--ওরে ভল্টা; ও বুড়ো ভামটা বামুনও না, ব্রহ্মদত্যিও না। ও হচ্ছে একটা বুড়ো বোকাচোদা।
অমনি হাতের লাঠিটা নিয়ে দু-জনকে দুটো এমন বাড়ি দিলেন উনি যে "বাব্বারে মারে" করে তারা রাস্তায় গড়াগড়ি দিতে লাগলো। তাই দেখে ঝাণ্ডাধারী গোরক্ষকরা ভট্টাচার্য স্যারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো নেকড়ের মতো। ওনার বয়স এখন সত্তর ছুঁই ছুঁই। নিরামীষ ভোজী। কিন্তু উনি ক্যারাটে জানেন। সেই অস্ত্রে মুহুর্তের মধ্যে উনি গোমাতার সন্তানদেরকে ঘায়েল করে পথের উপরে ধরাশায়ী করে রাখলেন।
জানলা দিয়ে মিশনের কয়েকজন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী অনেকক্ষণ ধরে গোটা ঘটনা দেখছিলেন চুপ করে। ভট্টাচার্যবাবু এতক্ষণ তা লক্ষ্য করেননি। নজর সেদিকে যেতেই তিনি বললেন--ওঃ আপনারা! তা বেশ। যে কাজটি এগিয়ে এসে আপনাদের করার ছিল, আপনারা তা না করায় এই বৃদ্ধ বয়সে একাই আমাকে তা করতে হোল। আপনারা নিশ্চিত জানেন যে রামকৃষ্ণ মিশন কিন্তু কোন হিন্দু প্রতিষ্ঠান নয়। এটা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতিষ্ঠান।
--হ্যাঁ। আমরা জানি। আমাদের এখানে অনেক মুসলিম ছাত্রও আছে।
--সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তবুও এই বর্বরগুলোর তাণ্ডব দেখে আপনারা এই মুসলিম ভাইটিকে বাঁচাতে আসেননি কেন? আমি না থাকলে তো জানোয়ারগুলো গোমাংস নিয়ে যাবার অপরাধে এই মানুষটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলতো।
দেখুন। ঠিক কি হচ্ছে তা আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। তাই আমরা . . .।
--বেশ। তাহলে শুনুন। একদিন স্বামী বিবেকানন্দের কাছে গোরক্ষিনী সভার সম্পাদক এসে বললেন--গোরু আমাদের মা। তাই আমরা গোমাতাকে রক্ষার জন্য একটি গোরক্ষিনী সভা করেছি যার লক্ষ্য হোল গো মাতাদেরকে রক্ষা করা, গোমাতা হত্যা প্রতিরোধ করা। মুখে কোন বিরক্তি প্রকাশ না করে স্বামীজী তাদেরকে শান্তভাবে বলেন--ঠিকই তো। গোরু মাতা না হলে তার পেটের সন্তানগুলো এমন হয়!
গোরক্ষিনী সভার সম্পাদক আর কোন উত্তর না দিয়ে স্বমীজির ভাষার চাবুকের ঘায়ে ছুটে পালান। আজ স্বামীজির নামাঙ্কিত, তাঁর প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের সামনে গোরক্ষিনী সভার সম্পাদক ও তার সাকরেদ প্রেতাত্মারা এই নিরীহ মুসলিম ভাইটিকে গোমাংস বয়ে নিয়ে যাবার অপরাধে খুন করার চেষ্টা করছিলো। আমি তার প্রতিবাদ করায় অশ্লীল ভাষায় আমায় কটূক্তি করেছে। উপায়হীন হয়ে আমায় লাঠ্যৌষধি প্রয়োগ করতে হয়েছে।
--ঠিক করেছেন। ঠিক করেছেন আপনি।
এমন সময় একটি পুলিশ ভ্যান এসে দাঁড়ালো। গাড়ী থেকে নেমে এক মাঝবয়সী অফিসার ভট্টাচার্য্য বাবুকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললো--স্যার আপনি?
--কে বাবা তুমি? তোমায় তো ঠিক খেয়াল করতে পারছি না।
--স্যার আমি ফারুক। ফারুক ইসলাম। ২০০০ সালের Pass out আপনার স্কুল থেকে।
--ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। মনে পড়েছে। মনিরুল, দীপ্তেন্দুর ব্যাচ্মেট তুমি।
--হ্যাঁ স্যার। হ্যাঁ স্যার।
--খুব ভালো ফুটবল খেলতে তোমরা।
--সে সবই আপনার ও অন্যান্য স্যারদের আশীর্বাদ স্যার।
--না না বাবা। আমরা তো সামান্য মানুষ। সবই ঈশ্বর--আল্লার আশীর্বাদ! তা এই থানায় তুমি কতদিন এসেছো বাবা! এখানে তোমার Rank কি?
--আমি স্যার প্রায় বছর খানেক হোল এখানে এসেছি। মাপ করবেন স্যার। আপনার বাড়ী এই থানায়, সেটা ছাত্রাবস্থায় শুনেছিলাম। কিন্তু ঠিক কোনখানে আপনার বাড়ী, তা অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারিনি। আজ এক ভদ্রলোক ফোন করে বললেন--একজন প্রবীণ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অমরেশ ভট্টাচার্য্যের উপর কিছু লোক চড়াও হয়েছে মিশন স্কুলের সামনে রাস্তার উপর। খবরটাতে যেমন বিচলিত হলাম, তেমনি একটি অমূল্য সম্পদ খুঁজে পাবার আনন্দে উৎফুল্ল হলাম। ওঃ ভালো কথা। আমি থানার মেজবাবু। আর আমার বড় বাবু কে জানেন স্যার?
--কে বাবা?
--আমার সতীর্থ, আমার খেলার জুটি, আপনার হাতে তৈরী গোলকিপার দীপ্তেন্দু, দীপ্তেন্দু সান্যাল। ও এই মাস তিনেক হোল এখানে এসেছে।
--বলো কি বাবা! এযে মণিকাঞ্চন যোগ!
--বড় বাবুকে মানে দীপ্তেন্দুকে বলা মাত্র ও বললো--SDPO সাহেবের ওখানে আমার Urgent call আছে। তুই এখনই গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে যা। স্যারকে আগে উদ্ধার কর। আর বদমায়েসদের চাপকাতে চাপকাতে নিয়ে আয়। সতীর্থ হলেও পদমর্যাদায় আমার Superior। অমনি চলে এলাম।
--বেশ বেশ। ভগবান তোমাদের মঙ্গলই করবেন। কিন্তু সেই ২৫ বছর আগের দেখা। আমায় দেখে তুমি চিনলে কি করে বাবা?
--স্যার, আলগা গা টা যা আপনার কখনো দেখিনি। কিন্তু সেই ফর্সা দীর্ঘ চেহারা, ২৫ বছর আগের মতই কাঁচাপাকা চুল, অতি সাধারণ বেশ। চোখের সেই উজ্জ্বল চমশা। এসব দেখেই আপনাকে চিনেছি স্যার।
এরপর স্যারের মুখে সব বৃত্তান্ত শুনলেন অফিসার। মিশনের সন্ন্যালীরাও সায় দিলেন তাতে।
--আপনি স্যার একটি মহান কাজ করেছেন। আপনি না থাকলে এই ভাইজানটি হয়তো আখলাখ বা মিছরি খান হয়ে যেতো, খুন হয়ে যেতো।
--হ্যাঁ স্যার। ঠিক বলেছেন। উনি মানুষ নন। উনি ফেরেস্তা। উনি না থাকলে এই হতভাগা করিমুল্ল্যার এতক্ষণে জানাজার আয়োজন হতো।
--না না বাবা করিম। আমি ফেরেস্তা বা দেবদূত কিছুই নই। আমি একজন মানুষ। মানুষ হিসাবে আমার যা করনীয়, তাই করেছি মাত্র। এবার আমার সন্তান থানার মেজোবাবু তাঁর কাজটি করুন।
--হ্যাঁ স্যার করছি। আমি এক মিনিট OC-র সঙ্গে কথা বলে নিই স্যার। এখন দিনকাল খারাপ।
--তার মানে ফারুক?
--স্যার। ঘটনাচক্রে আমি মুসলিম। করিমভাইও মুসলিম।
--তাতে কি?
--এক্ষুনি বলে দেওয়া হবে জাত ভাই-এর টান টেনেছি আমি। রাজনৈতিক ধান্ধাবাজরা নোংরা ফয়দা তোলার চেষ্টা করবে।
--ফারুক, ভারতের মুসলিমরা আর বাংলাদেশের হিন্দুরা নিজেদেরকে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক ভাবে। তাই একটা জঘন্য অপরাধীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে।
--স্যার। অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য। এটাই বাস্তব। গা বাঁচানো নয় স্যার। কায়েমী স্বার্থের কেন্নোগুলোর মুখে নুন দিতে আমাদেরকে সাত পাঁচ ভাবতে হয়। দীপ্তেন্দু ফাঁকা থাকলে ওকেই কেসটা নিজহাতে নিতে বলতাম। ও যেহেতু বড় সাহেবের ডাকে গেছে, সেইজন্য ওকে বলে থানার সেজো বাবু অমল বসুকে Call করিয়ে নিয়ে কেসটা তাকেই দিচ্ছি। সেও খুবভালো ছেলে। সবকাজ আমিই কোরবো স্যার। Formally এই কেসের IO হবে সে।
--বেশ! তবে তাই করো।
কিছুক্ষণের মধ্যে সেজো বাবু চলে এলেন। গোমাতার সন্তানদের Arrest করে গাড়ীতে তোলা হোল। অন্য একটি ভ্যানে করিমুল্ল্যাকে পাঠানো হোল হাসপাতালে। বৃদ্ধ অমরেশ বাবু আওয়াজ তুললেন--জয়! স্বামীজীকি জয়! জয় মনুষ্যত্ববাদের জয়। মিশনের সন্ন্যাসীরাও তাতে গলা মেলালেন। দূরে একটা ক্লাবে রক্তদান শিবির চলছে। সেখান থেকে ভেসে আসছে শিল্পী সাব্বির আহমেদ চৌধুরীর গান--
আকাশ আমার ঘরের ছাউনি পৃথিবী আমার ঘর,
সারা দুনিয়ার সকল মানুষ
কেউ নয় মোর পর
কেউ নয় মোর পর।
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
No comments