Header Ads

অনুগল্প - কেন এই একাকীত্ব ? কলমে - এস এম মঈনুল হক

 


                          কেন এই একাকীত্ব ?

                          এস এম মঈনুল হক 


    মসজিদের পাশে ছোট একটা ঘর। গ্রামের কিছু মাতব্বর শ্রেণীর লোক সেখানে প্রত্যেকদিন বৈকালে আড্ডা মারে আর কোনও না কোনও লোকের কুৎসা রটনায় ব্যস্ত থাকে। কিছুদিন থেকে রিয়াজ চৌধুরীর সমালোচনায় ব্যস্ত তারা। তাদের ঐ একটাই প্রশ্ন- সারাদিন বারান্দায় বসে কি করে রিয়াজ চৌধুরী। ওর কি একটুও ইচ্ছা জাগে না যে এপাশ ওপাশ ঘুরে বেড়াই। এই গ্রামে তো অনেক ঘরজামাই আছে। রিয়াজ চৌধুরীর এখানে আসা প্রায় আঠারো থেকে বিশ বছর হয়ে গেল। ওর কি বাইরে বেরুতে নেই। গ্রামের লোকের সঙ্গে মেলামেশা করতে কি ওর মন চায় না। না অন্য কোনও বিষয় আছে ওর। সেলিম বলেই ফেলল- কিসের ওর অহংকার বলতো রহিম? কেন আমরা কি মানুষ নই?

   - অতশত না ভেবে চল না একবার আমরা ওর কাছেই যাই, দেখি ওর ব্যাপার স্যাপার টা কি।

   - লোকটার আচার ব্যবহার আমার খুব একটা ভালো ঠেকছেনা রহিম। ওখানে যাওয়া কি ঠিক হবে?

   - চল না, আমরা তো সবাই যাব। দেখাই যাক কি ওর ব্যাপার।

           সবাই গিয়ে পৌঁছল রিয়াজ চৌধুরী বারান্দায়। এদের দেখে তিনি একটু অবাকই হলেন।

   - বলি, আমরা কি আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি?

   - কেন নয়? আপনারা ভেতরে আসুন। বারান্দায় অনেক জায়গায় আছে। সবাই বসুন।

   - রিয়ার মা পনেরো বিশ কাপ চা কর তো। এখানে আমার কিছু মেহমান এসেছেন।

        ভেতর থেকে আওয়াজ এল- ঠিক আছে উনাদের বসতে বল।

        কিভাবে কি কথা বলবে, এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে গুনগুন আওয়াজ শুরু হল। শেষ পর্যন্ত সেলিমই কথাটা পাড়লেন।

   - বলি, আপনাকে কখনো বাইরে যেতে দেখি না। সারাদিন এই বারান্দাটায় বসে থাকেন, আপনার কি বাইরের জগতটাকে দেখার ইচ্ছা হয় না। সব সময় একাকী থাকেন। একাকীত্ব কি আপনাকে অলস করে না?

   - আমি তো বাইরে জগত নিয়েই ব্যস্ত আছি, বলেই তো এই বারান্দা ছেড়ে কোথাও যেতে পারছি না।

   - আপনার কথাটা ঠিক আমরা বুঝতে পারলাম না। যদি একটু খোলোসা করে বলেন, তাহলে খুব ভালো হয়।

   - দেবী চৌধুরানীকে চেনেন? ওর নাম ছিল কপালকুণ্ডলা। শেষ পর্যন্ত ওকে দেবী চৌধুরানী হতে হয়েছিল। কেন বলুন তো?

       সবাই চুপ করে এর ওর মুখের প্রতি চাইতে লাগল।

   - Last Ride Together -এ নায়ক Rejected হওয়া সত্ত্বেও পুরনো প্রেমীকার সঙ্গে শেষবারের মতো একবার Last Ride করার স্বপ্ন দেখেছিল। শরৎচন্দ্র বলেছিলেন বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলিয়া ফেলে। ললিতা গভীর রাত্রে প্রেমিকের গলায় দূর থেকে গাঁদা ফুলের মালা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। ওর বিশ্বাস ছিল যে, তার এতেই বিয়ে হয়ে গেছে। দেবদাস এমন এক পাষণ্ড পাপী ছিল যে মৃত্যু কালে তার কাছে একটাও স্নেহের হাতও ছিল না। এমনকি এক ফোঁটা জলও সে পায় নি। জর্জ বার্নার্ড শ কুৎসিত চেহারা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন, তা সত্ত্বেও সেখানে একটা সুন্দরী মেয়ে তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রাজী হননি। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তায়েফ বাসীরা অকথ্য অত্যাচার করে রক্ত ঝরিয়ে দিয়েছিলেন, তা সত্বেও তিনি একবারও প্রভুর কাছে নালিশ করেননি। এমনকি কোন অভিশাপ ও তাদেরকে দেননি। যীশু খ্রীষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করা হলেও তিনি বলেছিলেন যে, আমার ভক্তদের কাছে আমি আবার ফিরে আসব। হোসাইন রাঃ যদি কারবালার প্রান্তরে যুদ্ধ না করতেন এবং শহিদ না হতেন, তাহলে এই ইসলাম হয়তো থাকতো না। রামচন্দ্র বনবাসে গেলেও তার ভাই ভরত রামচন্দ্রের জুতো মাথায় নিয়ে সিংহাসনে রেখে দিয়েছিলেন। রুদ্রাক্ষ গাছের নিচে বসে বিরহিণী ভগবতী একখন্ড মেঘকে দেখে বলেছিলেন, তোমরা যদি আমার শিবের সন্ধান পাও তাহলে তাকে জানাবে। অন্য চাই প্রাণ চাই নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা ভোজ বাড়ির ঘটনায় কুকুরের সঙ্গে মানুষের উচ্ছিষ্ট খাবার নিয়েকাড়াকাড়ির দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। গফুরের মহেশকে নির্মম মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল। কিছু একটা হারালেই কেষ্টা বেটাকে চোর বলতেন গিন্নি। সেই কেষ্টাই প্রভুর বসন্ত ভালো করতে গিয়ে নিজে বসন্তে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। স্যার আইজাক নিউটন ডিম সিদ্ধ করতে গিয়ে ঘড়ি সিদ্ধ করেছিলেন। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের ড্রাইভার একটা জ্ঞানী সভায় আইনস্টাইন সেজে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আইনস্টাইন ডাইভার সেজে গাড়িতে বসেছিলেন। সভা কক্ষের কেউই আইনস্টাইনকে তখনও দেখেনি। সভা শেষ করে ড্রাইভার বেরিয়ে আসছেন এমন সময় একজন পদার্থবিদ্যার একটা প্রশ্ন করে বসেন। আইনস্টাইন বিব্রত বোধ করছিলেন। তৎক্ষণাৎ ড্রাইভার আইনস্টাইনকে দেখিয়ে বললেন, এই যে আমার ড্রাইভারকে দেখছেন উনিও এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন। মহাত্মা স্যামুয়েল হ্যানিম্যান হোমিওপ্যাথ ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন বলে তাকেও কারাবরণ করতে হয়েছিল। ছলনা করে নিরীহ ইউসুফকে জুলেখা জেলে পাঠিয়েছিলেন। কালকে আরও আলোচনা হবে। আপনার অবশ্যই আসবেন। আচ্ছা যে সব কথাগুলো আপনাদেরকে আমি শোনালাম, আপনাদের কাছে এসবের উত্তর আছে কি? যদি থেকে থাকে তাহলে আপনারা আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন। আমি খুবই খুশি হব। এই সামনের আলমারিটায় কতগুলো বই আছে তা হয়তো আমি গুনে রাখি নি, কিন্তু তাদের সঙ্গে যে আমার অবাধ ভালোভাসা ও মেলামেশা আছে তা বলতে পারব। সেগুলি আমার জীবনের সবথেকে নিকটতম বন্ধু এবং আত্মিক সঙ্গী,Companion. এরা আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রতভাবে জড়িত না থাকলে সত্যিই আমি একাকী হয়ে যেতাম। একাকীত্ব জীবন কাটাতে হতো আমাকে।

        সবাই সমস্বরে বলে উঠলো-আমরা আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম। ভেবেছিলাম আপনি হয়তো কারো সঙ্গে মেলামেশা করতে রাজি নন। কিন্তু আপনার এখানে এসে এর উল্টো চিত্রটা দেখতে পেলাম।

  - একটা সময় ছিল যখন আমি বাইরেই পড়ে থাকতাম। সিনেমা, থিয়েটার, নাটক, কোন সেলিব্রেটি আসলে তাদের দেখতে যাওয়া, অকারণে শহরের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারা, এসব অনেক কিছুই করেছি আমি। এসবের অনেক অভিজ্ঞতাও আছে আমার কাছে। কিন্তু সবচেয়ে যে বড় অভিজ্ঞতাটা আমি অর্জন করেছি সেটা হল-যেখানে একের অধিক লোক থাকে সেখানে শুধু কোনও না কোনও মানুষের সমালোচনা, কুৎসা রটনা, এসব আলোচনায় বেশি হয়। অন্যের অনুপস্থিতিতে কিছু বলাটাই গীবত বা কুৎসা রটনা। প্রত্যেক ধর্মে এটাকে একটা জঘন্য পাপ বলে ধরা হয়েছে। তাই, বেশ কয়েক বছর ধরে আমি আর বাইরে যাই না। কেননা, আমার এই প্রিয় সঙ্গী বইগুলি আমাকে বাইরে যেতে দেয় না। এরা আমাকে চরম আনন্দ দেয়, জ্ঞান শেখায়, বুদ্ধি দেয়। এদের ছেড়ে কোথাও যেতে ভালো লাগবে, আপনারাই বলুন?

  - আমরা যদি প্রতিদিন আপনার কাছে আসি, আপনি বিরক্ত বোধ করবেন না তো? সিরাজ বলল।

  - না কোন বিরক্ত বোধ করব না, বরং আপনারা আসলে আমার ভালই লাগবে।

     - সত্যি, এতদিন আমরা মানুষের সমালোচনা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। ভালো হব মনে করলে যে ভালো হওয়া যায়, সেটা আমরা ভাবতেই পারিনি। আপনার কাছে না আসলে হয়তো আমরা পাপ শব্দটি বুঝতেই পারতাম না। এখন থেকে প্রতিদিন বৈকালে আপনার এখানে চা ও খাব এবং কিছু জ্ঞানের কথা শুনবো। আজকের মত আমরা আসছি।

     - হ্যাঁ, আসুন আমি আমার সঙ্গীদের সঙ্গে একটু খেলা করি।

                              (সমাপ্ত)

                 

No comments

Powered by Blogger.