নাটক - হারানো সুর, নাট্যকার - সামসুদ্দিন বিশ্বাস
নাটক - হারানো সুর
নাট্যকার - সামসুদ্দিন বিশ্বাস
মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
( ১)
মাঠের কাজে নয়ন চলেছে কিছুদূর যেতেই সাইকেলে ওড়না জড়িত অবস্থায় একটি মেয়ে শত চেষ্টা করেও সাইকেলের চাকা থেকে জরানো ওড়না ছুটাতে পারছে না। নয়ন বেগতিক থেকে মেয়েটির কাছে গিয়ে ওড়না ছুটিয়ে দিল ।
নয়ন’- কি নাম আপনার? কোথায় বাড়ি?
মেয়েটি:- আমার নাম সীমা । বাড়ি চালাকি নগর ।
নয়ন:-কোথা হতে আসা হল ?
সীমা:-কলেজ যাচ্ছিলাম, যা আর যাওয়া হবে না, অনেক দেরি হয়ে গেল ।
নয়ন:- সাইকেলে যখন চাপবেন তখন ভালোভাবে ওড়না গুছিয়ে নিয়ে চাপবেন ,না হলে জীবনটাই ক্ষতি হয়ে যেত ।
আচ্ছা চলি
সীমা:-দাঁড়ান ! আপনি আমার উপকার করলেন, কিন্তু আমার পরিচয় নিলেন কই আপনার তো পরিচয় দিলেন না?
নয়ন:-আপনি যদি আমার পরিচয় না চান তাহলে তো নিজে থেকে পরিচয় দেওয়া যাবে না কি বলুন ?
আচ্ছা ঠিক আছে যখন পরিচয় চাইলেন তখন বলি । আমার বাড়ি হিজলতলা গ্রামে। আমার নাম নয়ন চাষ বাস করি !
সীমা:-আপনি লেখাপড়া জানেন না?
নয়ন:-ম্যাডাম, আমরা গরীব মানুষ, লেখাপড়া কেমনে শিখব তাতে জমিজমা দেখাশুনা করতে করতে দিন পার হয়ে যায় ।
সীমা:-নয়ন, এত সুন্দর তোমার রূপ যৌবন কিন্তু তুমি মাঠে কাজ কর শুনে আমারই কষ্ট হয়।, এক কাজ করো নয়ন আমি তোমাকে পড়ার ব্যবস্থা করে দিব তুমি লেখাপড়া শিখো ।
নয়ন:-তা হয় না ম্যাডাম ! জমিজমা দেখা শুনাই তো সময় ঠিকমতো দিতে পারি না ।
আচ্ছা চলি........................
প্রস্থান
(২)
[বাড়িতে কিছুতে মন বসছে না, কি যেন হারিয়ে গেছে বারবার নয়নের যেন প্রতিচ্ছবি বেশি আসছে.........
ওড়নাটা গুছিয়ে রাখবেন]
ঘুমাবার চেষ্টা করছে ঘুম আসছে না খাবার চেষ্টা করছে খাবার ইচ্ছা জাগছে না , বিয়ঙ্গীর ন্যায় মন চঞ্চল হায়রে নারীর হৃদয়, কিসের জন্য এত আকুলতা। চঞ্চল বালিকার ডানা দেইনাই বিধাতা কিন্তু উড়ন্ত হৃদয় দিয়াছে । কোথায় হিজতলা, কালকে কলেজ যাব দেখা কি পাবো যদি না পাই তাহলে....... কেন পাবনা এই রাস্তা দিয়ে তো যাবে, না তার তো প্রতিদিন কাজ না থাকতে পারে.......... বিধাতা বালিকার হৃদয় কেন এমন করিলেন তো কেন তাহা নিবারণ করিলেন না । দেখিতে দেখিতে বালিকার সকাল হইয়া আসিলো]
সীমা:-মা গো ! আজকে আমার স্কুল থেকে আসতে একটু দেরি হতে পারে, কেননা সাবিনা আমাকে তাদের বাড়ি বারবার করে ডেকেছে তুমি কোন চিন্মা করো না মা , ইস্কুল ছুটি হবার পরে পরে তাদের বাড়ি যাবো ।
জমিলা:-হ্যাঁরে সীমা ! পরশু সকাল সকাল রবিবারেই যাস ! পরশু সকাল সকাল রবিবারেই যাস! কখন তোর স্কুল ছুটি হবে আবার কখন যাবি তাতে তোরই তো দেরি হয়ে যাবে ।
সীমা:-মা, যখন বারবার করে অনুরোধ করেছে তখন গিয়ে দেখি । কোন চিন্তা করো না মা ।
প্রস্থান
পথ চলেছে আনমনে, কালকে এই পথে তো নয়নের সাথে দেখ, দশটা পার হয়ে গেল কই নয়নকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না? আজ কি নয়ন আসবেনা মাঠে । বিষন্নতায় ভাঙ্গা হৃদয়ে স্কুল আসিল। স্কুলের তালা, গেট বন্ধ, প্রাঙ্গন শিক্ষক মহাশয়ের মৃত্যুর জন্য একভাবে নোটিশ বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতে লাগলো .......
রিতা:-চল বাড়ি চল আগে যদি খবরটা জানতে পারতাম তাহলে এতদূর স্কুল আসতে হতো না রে সীমা । মাস্টার মরার ও সময় পেল না ।
সীমা:-চল! আজকে আমরা বাড়ি না গিয়ে মুক্ত বিহঙ্গে মাঠ ঘাট একটু ঘুরে বেড়াই ! কোনদিন তো সময় পাইনা । এত তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে ভালো লাগে না ।
রিতা:-বাড়িতে তো কাজ আছে ? কিন্তু তুই যখন বলছিস তখন চল । আমার কিন্তু সিনেমা দেখার শখ হচ্ছে, বহুদিন থেকে বই দেখি নি ।
[শাকিলার প্রবেশ ]
শাকিলা :-কিরে তোরা সিনেমা দেখার জন্য রসে পড়েছিস? তার চেয়ে ভালো পার্কে চল ? সেখানে জোড়া ও পেতে পারি জুটিয়ে গল্প করবো ?
সীমা:-তার চাইতে বরং মাঠের রাস্তা ধরে গ্রাম্য সবুজ ঘেরা ফসলের শোভা দেখি, প্রকৃতির প্রেমে নিবেদন হোক তিনটি হৃদয় ।
শাকিলা :-কিরে সীমা , কখন থেকে তুই আবার কবি হয়ে পড়েছিস যখন তোর প্রকৃতির ওপর এত টান তবে তাই হোক ।
[ সকলেই গ্রামের পথ ধরে মাঠের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে আনমনে চলিতেছে । কতইনা কথা মনের মধ্যে চিত্র রচনা করিয়া চলিয়াছে এমত অবস্থায় চিৎকার শুনিয়ে হঠাৎ থামিয়ে গেল এবং দূরে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। সীমা বলিতে লাগিল চল দেখি আসি ,তিন বান্ধবী সেখানে উপস্থিত হইল এবং অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে ছেলেটি, সীমার চিনিতে অসুবিধা হলো না ]
সীমা :- কি হয়েছে ,আপনার [দুই হাত দিয়ে নাড়াতে লাগলো কোন সাড়া শব্দ নাই]
রিতা তাড়াতাড়ি জল নিয়ে আয় ! অজ্ঞান হয়ে আছে ।
[রিতা জল আনিতে যায়]
হায়, আল্লাহ তুমি নয়ন কে বাঁচিয়ে দাও
[ হঠাৎ পায়ে সাপে কামড়ের চিহ্ন দেখিতে পাই] এখন কি হবে? না না আর হোয়াটসঅ্যাপ করা যাবে না জলের জন্য ।
[ক্ষতস্থান মুখে নিয়ে বিষ টানিতে লাগিল ]
শাকিলা :-নারে , আমি ছেড়ে দিয়ে যেতে পারবো না ? যদি নয়নকে ভালো করতে গিয়ে আমার মরনও হয় হোক, তাতে কিছুই যায় আসে না ।
শাকিলা:-কি বলছিস তুই, তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে ?
[ বিষ টানিতে টানিতে সীমা জ্ঞান লুপ্ত হলো নয়ন সুস্থ হয়ে উঠে বসলো ]
নয়ন:-কি হয়েছে আমার ! আমি এইভাবে কেন ! তোমরা কি করিতেছ ?
শাকিলা:-নয়ন, তোমাকে সাপে কামড়ে ছিল কোন জ্ঞান ছিল না । সিমা মুখ দিয়ে তোমার বিষ টেনে ভালো করল এখন সীমা জ্ঞান হারা ।
নয়ন:-ম্যাডাম একি করলেন ? সামান্য একজন চাষার ছেলের জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ করলেন............ নয়ন কাঁদিতে লাগিল ।
(রিতা জল আনে )
সকলেই :- দাও দাও চোখে জল ছিটাও
[ কিছুক্ষণ পরে সীমা উঠে বসলো ]
(৩)
[ আজিজ মিয়া একজন দারোগা, মেয়ে তার একমাত্র সম্বল, খুব আশা নিয়ে তার বন্ধুর ছেলে শরিফ এর সাথে বিয়ে দিবে বলে দুই বন্ধুতে পাকা কথা করিয়াছে তাদের ছেলে বেলায় কিন্তু সীমা জানিতো না কারণ তখন বিয়ে শব্দটা বুঝি তো না ।
আজিজ মিয়া:-কিরে এতো বেলা হয়ে যাচ্ছে মা এখনো ঘুম ভাঙছে না ? তাড়াতাড়ি উঠে এসো ।
[সীমা উঠিয়া চেষ্টা করিল কিন্তু ঘুমের ঘোরে আবার ঘুমিয়ে পড়িল , কিরে মা, শরীর খারাপ নাকি?
মেয়ে কে হাত ধরে উঠিয়ে বসাইলো । এবার মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে নিয়ে বসাইলো ]
মা রে, তুই ছাড়া আমার কেউ আর নেই তোকে কোনদিন বলা হয়নি মা, কারণ তুই পড়ছিস পড়াশোনা হইলে তোর বিয়ে বয়স হবে তখন তোকে সব কথা বলব । তাই এতদিন তোকে বলিনি , মা এক বন্ধুর ছেলে শরীফ তার সাথে তোর বিয়ে দিব। সে কথা আমরা তোর ছোটবেলা কথা করিয়াছি ।
সীমা:-আব্বা একি করিয়াছো ! আমি বিয়ে করিতে পারিব না । আমি নয়ন কে ভালবাসি আব্বা !
আজিজ মিয়া:-[ রেগে উত্তেজিত হয়ে ] কি?... তোমার এতদূর সাহস হয়েছে? কোন মুখে এই কথা বলতে পারলে ? আমার কথায় এক কথা । আমি সামান্য একটা চাষার ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দিতে পারব না ?
সীমা:-না, না............................... আমি এই জীবন থাকিতে কিছুতেই নয়নকে ছাড়া বিয়ে করব না ?
আজিজ মিয়া :- [ সপাটে দুটো চড়]
হ্যাঁ তোকে আমার বন্ধুর ছেলেকেই। বিয়ে করিতে হইবে আর দেরি করিব না আজকে শরীফকে ডেকে পাঠাবো ।
[ঘর বন্ধ করিয়া সীমা থাকিলো রাত্রি গেলো সকাল হইলো কিছুতেই ঘর খুলিতে পারিল না, চাকরকে ডেকে বললো নয়ন কে ধরে নিয়ে আয় ]
চাকর :- চল ব্যাটা, বামন হয়ে চাঁদে হাত সামান্য চাষার ছেলে বড় লোকের মেয়ে কে বিয়ে !
[ধরে নিয়ে এলো কাছারিতে ]
আজিজ মিয়া :-চাকর কে উদ্দেশ্য.. মেরে ফেল ব্যাটা কে, দিয়ে পুঁতে দে কেউ জানতে পারবে না
। না থাকবে বাঁশ না বাজবে বাঁশরী। অন্য চিহ্ন রাখতে হবে না ।
চাকর:- [ মাথায় সজোরে বাসের লাঠি মারলো ] মর শালা !
[নয়ন চির নিদ্রায় শায়িত হল ]
আজিজ মিয়া:-কিরে মরল কি না ভালো করে দ্যাখ পুতে ফ্যাল ।
প্রস্থান
আজিজ মিয়া :- [ দরজা খুলিতে চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হইল তখন দরজা ভাঙতে লাগিল এবং দেখিল খাটের উপর শুয়ে আছে কাছে গিয়ে দেখিল, কিছুতে নাড়াতে পারিল না ]
হায়, হায় এ কি করলি রে মা ! তোর বিয়ে নয়নের সাথে দিলাম না যদি দিতাম তাহলে তোর মরণ আমাকে দেখিতে হতো না ।
[ যবনিকা ]
No comments