গল্প - দীপ শিখা জ্বেলে, কলমে - খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
দীপ শিখা জ্বেলে
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
করিমভাই, বাদুড়িয়ার বিড়ি শ্রমিক নেতা, হত দরিদ্র করিম গাজী, মারা গেছেন কাল ভোরে বসিরহাট হাসপাতালে অপুষ্টি জনিত রোগে, অকালে, মাত্র ৫৭ বছর বয়সে। ওঁর উপরের দুই দাদা এখনো বেঁচে আছেন সুস্থ শরীর নিয়ে অভাবের সঙ্গেই লড়ে।
এখন বেলা বারটা বাজে। ওঁর জানাজার আয়োজন চলছে। জোহরের নামাজের পর মাটি হবে। গ্রামের সমস্ত স্তরের মানুষরা হিন্দু--মুসলিম নির্বিশেষে একে একে সবাই উঠোনে ভিঁড় করেছেন। বিশেষ করে ভিঁড় করেছেন বিড়ি শ্রমিকরা ও তাঁত শ্রমিকরা। কারোর পরণে ছেঁড়া জামা, গলায় তুলসীর মালা, কারোর পরণে ময়লা জীর্ণ লুঙ্গি ও মাথায় টুপি। এরই মধ্যে একজনের বাইকের পিছনে করে ইদ্রিস শেখ সেখানে হাজির। এলাকায় পরিচিত একজন বিশেষ বামপন্থী নেতা।
তাঁকে দেখেই, করিমভাই-এর ছেলে, রাজীবুল, এম. এ. পাশ করেও, চাকরি না পেয়ে, বিড়ি বেঁধে রোজগার যার পেশা, এগিয়ে এসে বলল--
--আসুন চাচাজী। আদাপ।
--তোমার আব্বা খুব ভালো মানুষ ছিলেন বাবা। তাই খবর পেয়ে ছুটে এলাম। জানাজা পড়ে তারপর যাবো।
--চাচাজী! আপনি যে আব্বার এন্তেকাল করার খবর পেয়ে আমাদের বাড়ীতে এসেছেন, এর জন্য ধন্যবাদ! আসুন, বসুন আমাদের এই ভাঙাচোরা ঘরের বারন্দায়। জানেন তো চাচাজী, আমাদের এই গ্রামের পাশের গ্রাম হোল ভাষাবিদ ডঃ শহীদুল্লাহর জন্মস্থান পেয়ারা। আব্বুর মুখে শোনা, আমরাও আগে ঐ গ্রামের বাসিন্দা ছিলাম। মামুর বাড়ীর সম্পত্তির ভাগ পেয়ে আমার পো-নানা এই গন্ধবপুর গ্রামে চলে আসেন। আমরা এখন খুবই পড়তি পরিবার। কিন্তু, আমাদের পূর্ব্ব পুরুষরা ছিলেন খুবই সম্ভ্রান্ত ও প্রতিষ্ঠিত। আমার দাদাজীও সেই আমলে প্রাইমারী শিক্ষক ছিলেন। ডঃ শহীদুল্লাহর প্রভাব গোটা গ্রামবাসীদের উপর পড়েছিল--পড়েছিল আমাদের পূর্ব্বপুরুষদের উপরও। তখনকার দিনে, এমনকি আজও, অনেকের ধারণা ছিল এবং আছেও যে সংস্কৃত হিন্দুর ভাষা। হিন্দুরাই ওটা পড়বে, মুসলিমরা ওটা পড়বে কেন? তারা পড়বে পবিত্র কোরাণের ভাষা, আরবি ভাষা। কিন্তু ডঃ শহীদুল্লাহ এই ভ্রান্ত ধারণাটি ভেঙ্গে দিয়ে সংস্কৃত নিয়ে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি করে বিশ্ববিখ্যাত ভাষাবিদ হয়েছিলেন। অভাবের তাড়নায় মেধা থাকতেও আমার আব্বার বেশীদূর লেখা পড়ার সুযোগ হয়নি--দশ ক্লাশে উঠে সব শেষ। তারপর পেটের দায়ে বিড়ি বাঁধা। কিন্তু বই পড়ার ঝোঁক ছিল তাঁর বিস্ময়কর। নিজের খিদে মেরে, বই কিনে, বন্ধুদের থেকে বই চেয়ে, সুদূর বসিরহাট সাধারণ পাঠাগারে গিয়ে বই এনে তিনি পড়তেন। সেই সুবাদে তিনি ডঃ শহীদুল্লাহর একটি কথায় বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন--ভাষা কোন জাতের বা ধর্মের নয়। এ হোল একটা জলস্রোত। সবার কাছেই এটা উন্মুক্ত। তবে ভারতবর্ষকে জানতে হলে, এ দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির আদি, উৎস বুঝতে হলে সংস্কৃত জানা জরুরী। তাই গ্রামের উলেমা--মোল্যাদের সব কথা উপেক্ষা করে তিনি আমায় সংস্কৃতে অনার্স ও এম. এ করান। আজ এই মুহূর্তে একটা শ্লোক খুব মনে পড়ছে--
উৎসবে ব্যসনে চৈব, দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্র বিপ্লবে,
রাজদ্বারে শশ্মানে চ, যস্তিষ্ঠতি, সঃ বান্ধবঃ।
অর্থাৎ প্রকৃত যে বন্ধু, সে সুখে দুঃখে, রাজদরবারে, শশ্মানে সর্বত্রই বন্ধুর পাশে থাকে। তাই আব্বার এন্তেকালের খবর পেয়ে, হিন্দু--মুসলিম, নারী পুরুষ নির্বিশেষে তাঁর সব দরদী, স্বজন, বন্ধুরা, শেষ বার তাঁকে দেখতে আমাদের এই জীর্ণ--কুঁড়ে ঘরের উঠোনে ভিঁড় করেছেন। আপনিও এসেছেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ চাচাজী। তবে কিন্তু আপনার জানাজা পড়া হবে না।
--কেন কেন?
--চাচাজী আপনি লেখা পড়া জানা মানুষ। আপনি জানেন নিশ্চয়ই Lap dog আর bull dog এর প্রভেদটা।
--তার মানে?
--তার মানে হোল "Lap dog" সবসময় আরাম প্রিয়। কোলে কোলে থাকে। কষ্ট সহ্য করতে পারে না। কোন না কোন কোল তার চাইই। আর "bull dog" হোল চোয়াল শক্তওয়ালা কুকুর। খুব সাহসী এবং একরোখা, জেদী। সে যেটা ধরে, সেটা প্রাণ থাকতে কিছুতেই ছাড়ে না। আমার মরহুম আব্বাজান ছিলেন একটা "bull dog"। সারা জীবন বুকের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্যপ্রতিষ্ঠার আদর্শের দীপশিখা জ্বেলে তিনি লড়ে গেছেন। সামান্য সুখের জন্যে, আরামের জন্য হারামের পথ তিনি কখনো নেননি। কোল বদল করেননি। গরীব মানুষের কোলে, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে খেটে খাওয়া মানুষদের কোলে তিনি থেকেছেন। আজও তিনি তাঁদের কোলে উঠেই, ওই দেখুন হরি কাকা, তুলসী জ্যাঠা, ফকির চাচা, ইউসুফ নানা, কারোর গলায় দু'কণ্ঠী মালা, কারোর মাথায় টুপি, ছেঁড়া লুঙ্গি, সবাই এসেছেন। শেষ বারের মত ওঁদের কোলে উঠে, কাঁধে চেপে, আমার আব্বাজান গোরে যাবেন। কেউ হয়তো মনে মনে বা আস্তে আস্তে উচ্চারণ করবে "বিসমিল্লা রহিম," কেউ বলবে "বিসমিল্লাহি অফি সাবিলিল্লাহে", কেউ হয়তো বলবে মনে মনে "বল হরি হরিবোল।" কেউ জানাজা পড়বে। কেউ হয়তো না পড়েও আমার আব্বার স্মৃতিতে সালাম জানাবে।
একটু থেমে রাজিবুল বোললো--
--কিন্তু চাচাজী। আপনার জানাজা পড়া হবে না। ঐ জমায়েতে আপনি অংশ নিতে পারবেন না।
--কারণ?
--কারণ, "bull dog"-এর জানাজায় চাচাজী, "lap dog" -এর স্থান নেই। তার অংশ নেওয়ার কোন সুযোগ নেই।
--পরিষ্কার করে বলো।
--চাচাজী! আব্বার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে ঠিক। কিন্তু ওঁর বুকের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠার আদর্শের দীপশিখা এখনো জ্বলছে। অপ্রিয় হলেও এটাই বাস্তব যে আপনি হলেন ঝুটা বামপন্থী। এবারের লোকসভা নির্বাচনে এই মহকুমার দরিদ্র মানুষের বন্ধু দ্বিজেন কাকু, মানে ডঃ দ্বিজেন সান্যালের নাম যখন কমিউনিস্টদের তরফে উত্থাপন হোল, আমার অসুস্থ আব্বাসহ এলাকার গরীব হিন্দু মুসলিমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো। আপনি কি করেছিলেন? আপনার তত্ত্ব ছিল এই বসিরহাট লোকসভায় যেহেতু মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেইহেতু মুসলিম প্রার্থী দেওয়ার জন্যে আপনি দলের মধ্যে উপদল তৈরী করেছিলেন কিছু সংখ্যক মুসলিম নেতাকে নিয়ে--সব মুসলিম নেতা অবশ্য আপনার কথায় সায় দেয়নি। আপনি কোটি কোটি কালো টাকার মালিক এক অর্ধ শিক্ষিত ব্যবসায়ী ময়নদ্দিন শেখকে প্রার্থী করার প্রস্তাব করেছিলেন, যার সঙ্গে মহকুমার বা জেলার কোন গণ আন্দোলনের যোগ নেই বা ছিল না। শুধু নিজের আর্থিক আখেরের হিসেব কষে, পরের তেলে মাছ ভাজার অঙ্ক মাথায় রেখে, ময়নদ্দিনকে প্রার্থী করলে দ্বিজেন কাকুর ক্ষেত্রের মত চাঁদা তুলে খেটে মরতে হবে না, বরং তার পয়সা আছে, অনেক গাড়ী আছে, আরামে ভোট প্রচার করা যাবে, নিজের আখেরও গোছানো যাবে। আপনার এই প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হোল তখন জামাতী ইসলামীর টাকায় তাদের মদতে, সাধারণ মুসলিম কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদেরকে ওস্কাতে লাগলেন এই বলে যে পার্টির জেলা নেতারা যেহেতু অধিকাংশ হিন্দু, সেই হেতু "হাল নেই, হেথেল নেই, টাকা নেই, পয়সা নেই," এমন একজন "জগবন্ধু ডাক্তারকে" অর্থাৎ সান্ন্যাল কাকুকে প্রার্থী করেছে। জামাত ইসলামী ও ময়নুদ্দিন শেখের কালো টাকা ছড়িয়ে সাধারণ মুসলিম কমরেডকে বিপথে চালিত করার চেষ্টা করেছেন। ঠিক যে কৌশলে আর. এস. এস, ইসলামিক স্টেট, মৌলবাদী ক্যাথলিকরা মানুষের অভাবের সুযোগে তাদেরকে টাকা, পয়সা, খাদ্য বস্ত্র, শিক্ষা, কর্ম সংস্থান, ইত্যাদির ফাঁদে ফেলে তাদেরকে ধর্মান্তরিত করে, ঠিক সেইভাবে আপনি ও আপনার সাঙ্গোপাঙ্গোরা আরব দুনিয়ায় রাষ্ট্রপতি নাসেরের খুনের ব্যর্থ চেষ্টার ষড়যন্ত্রকারী "Muslim Brotherhood"-এর মতো উস্কানি দিয়ে মুসলিমদেরকে ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে হিন্দু কমরেডদের বিবেককে কিনে নেবার চেষ্টা করেছেন। গরীব হিন্দু--মুসলিম কমরেডদের কে আর্থিক সাহায্য দানের নামে তাদেরকে আপনি পার্টির জেলা নেতৃত্ব ও আমাদের গরীব মানুষদের পরীক্ষিত ধর্মনিরপেক্ষ সংগ্রামী নেতা কমরেড সান্যাল কাকু ও আর একজন প্রবীণ নেতা সমাজ সেবী ডাঃ মনোরঞ্জন মণ্ডলের নামে কুৎসা করে বলেছিলেন, ওঁরা হিন্দু, তাই ওঁদের সবার লক্ষ্য হিন্দুদের দিকে। আমাদের যখন "জাতভাই" প্রার্থী হতে পারেনি, তখন ভোট ঘুরিয়ে জাত ভাইকে ভোট দাও--হোক না ধুঁতরো ফুল, খেলে মানুষ পাগল হয়, তবু জাতভাইকে জেতাতে তাতেই ভোট দাও।
একটু থেমে সে আবার বলে চলে--
--কিন্তু চাচাজী! সবাই রামছাগল নয়, সবাই জাত--ভাই বিচার করে না--বিচার করে আদর্শ। তাই তকীপুরে কমরেড মালেক কাকুকে এই কথা বলতে গেলে, কার্যতঃ সেখানে আপনি কড়া প্রতিবাদের বেতের বাড়ী খেয়েছেন। আর আমার অসুস্থ আব্বাজান, অসুখকে তুচ্ছ করে হিন্দু--মুসলিম সম্প্রীতির কথা প্রচার করে দোরে দোরে লাল ঝাণ্ডা উড়িয়ে সঙ্গীদের ভোট চেয়ে বেড়িয়েছেন। চাচাজী, আমরা হেরে গেছি তবে হারিয়ে যাইনি। তাই আপনাকে আদাপ! আপনাকে আমার আব্বার জানাজায় অংশ নিতে দেবো না--আমি এজন্য দুঃখিত। কারণ, আমরা বামপন্থী হলেও আল্লাপাকে বিশ্বাস করি। আপনি আব্বাজানের জানাজায় অংশ নিলে গোটা জমায়েতটাই "নাপাক" হয়ে যাবে। আমি তা হতে দিতে পারি না।
মাথা নীচু করে নেতা চলে গেলেন। যথা সময়ে জানাজা হোল। উঠোন ভর্তি লোক: কয়েক হাজার মানুষ। কে হিন্দু, কে মুসলিম, কার মাথায় টুপি, কার গলায় তুলসীর মালা! সবাই মাথা নীচু করে নীরবে প্রয়াতের উদ্দেশ্যে সর্ব্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা করলেন। তারপর এলো সেই সেই অন্তিম মুহূর্ত। কবরে শায়িত করিম ভাই--এর নশ্বর দেহ বাঁশের মাচান ও মাটিতে ঢেকে গেলো। রাজীবুল ও অনেকের চোখেই জল।
মাটি হবার পর, জমায়েতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে, ঘরমুখী সহযোদ্ধারা বজ্রমুঠী আকাশে তুলে আওয়াজ তুললেন
--কমরেড করিম ভাই,
তোমায় আমরা ভুলিনি, ভুলবো না,
ভুলিনি ভুলবো না।
অমর রহে, অমর রহে।
কমরেড করিম ভাই অমর রহে।
অমর রহে, অমর রহে।
আকাশটা আজ সকাল থেকে ছিল মেঘাচ্ছন্ন। যেন শোকে সে দিন ছিল মূহ্যমান। এবার ঝরলো যেন অশ্রু সজলধারা রূপে। রাস্তার ধারে কৃষ্ণচূড়া গাছটায় মৃদু মন্দ বাতাসে কলিগুলো দুলছে--যেন তারা মাথা নীচু করে শেষ সেলাম জানাচ্ছে করিম ভাইকে। আর করিম ভাই-এর ছোট্ট নাতনি সমা, পথের ও পারের বাসিন্দা, প্রাথমিক শিক্ষক, দেবাঞ্জন দাসের মেয়ে, চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্রী রিনি জানালায় বসেই করিম দাদুর উদ্দেশ্যে গাইছে--
মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম, হিন্দু মুসলমান
মুসলিম তার নয়ন মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।
লেখক পরিচিতি:
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
No comments