Header Ads

আত্ম-অন্বেষণ এর পরিক্রমা, লেখক - তৈমুর খান

 



আত্ম-অন্বেষণ এর পরিক্রমা

তৈমুর খান 


অবেলার অস্তরাগে দাঁড়িয়ে কোনো দার্শনিক যখন তাঁর দীর্ঘ ছায়া মাপেন, তখন পেছনে ফেলে আসা তাঁর জীবনকেই দেখতে থাকেন। যে জীবন সমস্ত দিনের শেষে শুধু শূন্যতাই পেয়েছে, নিঃস্ব দুহাতে শুধু স্মৃতির ধুলোই মেখেছে। তখন অনুভব করেন:

“But there is another part of you. Your shadow self. And it has power.”

(Lexi Ryan, These Twisted Bonds)

অর্থাৎ  আপনার আরেকটি অংশ আছে। তা নিজের ছায়া নিজেই এবং এর শক্তিও আছে।

রোমান্স ও ফ্যান্টাসি জগতের সমসাময়িক বিখ্যাত লেখিকা লেক্সি রায়ানের এই উপলব্ধিতে সেই দ্বিতীয় সত্তাটিরই সন্ধান পেলাম অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘অবেলার অস্তরাগে’(কলকাতা বইমেলা ২০২৪) কাব্যগ্রন্থে।  

        মোট ৫৭ টি কবিতা নিয়ে কবিজীবনের অস্তরাগে প্রতিফলিত হয়েছে এই ছায়াময় দ্বিতীয় সত্তার সংলাপ।এখানে অন্তঃস্থল জুড়ে দহনজ্বালা নিয়ে দাঁড়ানো কোনো দার্শনিক পুরুষকে গোধূলি রঙে রঙিন হতে দেখি। জীবন নিয়ে ভাবতে ভাবতে জীবনের প্রান্তে নিষ্কলক দৃষ্টিতে সেই শূন্যতাকেই তিনি নিরীক্ষণ করেছেন। থাকা না-থাকার ভাবনা থেকেই ঢেউ-এর ক্রম উত্থানকে জীবনবাদের সঙ্গে তুলনা করে জন্মান্তরের দিকে অগ্রসর হতে চেয়েছেন। সমগ্র কবিচেতনাতেই সেই সীমাহীন অন্বেষণ লক্ষ করা যায়:

“একটা সীমানাবিহীন ভূমিখণ্ড

ও প্রসারিত আকাশের জন্য

নিরন্তর অন্বেষণে পথ হেঁটে চলেছি”

জীবন যে পথহাঁটা The travelling of life তা বলাই বাহুল্য। এই পথহাঁটা জন্মান্তরের ভেতর দিয়ে বহুরূপে আবির্ভূত হওয়া এ-কথা প্রায় সব কবির বোধেই ধরা পড়েছে। জীবনানন্দ দাশ এই কারণেই লিখেছিলেন “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে”।এই পথহাঁটার মধ্যেই জীবনের বিস্তার ও প্রবাহ অনন্ত হয়ে ওঠে। মানবজন্মে না হলেও তা ভিন্নরূপে ভিন্ন প্রকৃতিতে বিস্তৃতি পেয়েছে। কবির এই সর্বব্যাপী বোধের ছায়া পড়েছে কবিতাগুলিতে। বেহুলানদীর মতো একলা জীবনের খণ্ডচেতনা থেকে নিষ্পত্র বৃক্ষ হয়ে ওঠার মধ্যেও এর চলন অনুভব করেছেন। প্রকৃতির দৃশ্যময় চিত্রকল্পেও এর নৈঃশব্দ্যযাপন নির্ণয় করেছেন:

“বিষণ্ণ পাতার মতো গড়িয়ে যাওয়া জীবন

গ্রীষ্ম হাওয়ায় উড়ে যাওয়া মেঘ

সম্পর্কহীন দূরে কোথাও….

বা আঁকাবাঁকা পথের মতো হারিয়ে যাওয়া

গহীন অন্ধকারের কোনো অরণ্যভূমির ভেতর

চারিদিক জুড়ে শুধুই নৈঃশব্দ্য….”

এই নৈঃশব্দ্যই সত্তার অভিরূপ যা প্রজ্ঞানের গভীরে অবস্থিত। এইখান থেকেই অন্তরের আবহমান সৃজন প্রবাহ। ঘুম ও জাগরণ, উত্থান ও সুষুপ্তির ক্রিয়াগুলি সন্নিবিষ্ট হয়েছে। তাই জীবন জুড়ে এখনো সজীব স্মৃতিদাগ বহন করে চলেছেন। নিসর্গ ভাষার সম্মোহনে ডুবে যাওয়া অচিনপুরের শূন্যভুমিতে পৌঁছে যাওয়া সবই আত্মপথের পরিক্রমা। ক্লান্তিহীন এই পরিক্রমাকেই চিহ্নিত করে কবি লিখেছেন:

“এইভাবে দশকের পর দশকের

পথ ভেঙে ভেঙে যেন শূন্যভূমি হয়ে যাওয়া”

তখন দার্শনিক বোধের তীব্রতাও মর্মকে আলোড়িত করেছে। বেঁচে থাকাও তখন ক্লিশে মনে হয়েছে। অন্তর্গত বিষাদ পার্থিব জীবনের অন্তরায় এনে দিয়েছে। তখন কবি লিখেছেন:

“অবেলার অস্তরাগ

চমকিত হয়ে ওঠে অন্তকাল”

কবি যেন জীবনসন্ধির প্রাজ্ঞমুহূর্তে উপস্থিত হয়েছেন। তাই মনের মধ্যে যেমন দ্বান্দ্বিক পর্যায়ের উত্থান ঘটেছে, তেমনি অবচেতনের সংশয় ক্লিষ্ট পীড়নও শুরু হয়েছে।সেই কারণেই কবিতাগুলি বহুমুখী জীবন প্রবাহের স্ফুরণ হয়ে উঠেছে।

কবির এই পরিক্রমায় পৌরাণিক ভূমিও সামিল হয়েছে। গান্ধারীর সত্যভেদ, অহল্যা সময়ের জাগরণ সবকিছুই সত্তার নবরূপায়ণ। তেমনি বরাক উপত্যকায় ভাষা আন্দোলনের শহিদ বিপ্লবী কমলা ভট্টাচার্যের আত্মদানও ইতিহাসের কণ্ঠস্বর হয়ে অনন্তগামিতায় সম্মোহনের দরজা খুলে দিয়েছে। তাই কাব্যটি ব্যক্তিচেতনা  থেকে পুরাণচেতনা, সময়চেতনা থেকে ইতিহাস চেতনার সামগ্রিক পর্যায়কে

ধারণ করেছে। কবি সবকিছুর মাঝেই এক দার্শনিক পর্যটক হয়ে চেতনালোকের সীমানায় আত্ম-অন্বেষণ এর পরিক্রমা করেছেন।


#

অবেলার অস্তরাগে :অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়, প্রচ্ছদ: তৃণা চৌধুরী, প্লাসেন্টা পাবলিকেশন, বগুলা কলেজ পাড়া,নদীয়া-৭৪১৫০২,মূল্য ১৬০ টাকা।

No comments

Powered by Blogger.