একগুচ্ছ অণুগল্প, লেখক - আব্দুল মালেক
লেবু ফুলের গন্ধ
আব্দুল মালেক
মুর্শিদাবাদ
কয়েকদিন ঠান্ডা লড়াইয়ের পর আজ দুপুর বেলা একটা সন্ধির সম্ভাবনা দেখা গেল। যত্ন করে সপ বিছিয়েছে আনিশা। ভাতের থালা পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়েছে খুব আগ্রহ ভরে।
আমি তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছি। এমন পরিপাটি করে খেতে দিয়েছে কিছু বলার সুযোগই নেই। অথচ কিছু একটা বলা দরকার। কয়েক দিনের ব্যবধানে আমরা নিজেদের মধ্যে এতটাই পর হয়ে গেছি যে চোখ তুলে তাকাতেও শরম লাগছে। আমার ভেতরটা উসখুস করছে। এক সময় নিজে আর চুপচাপ থাকতে না পেরে বললাম: তরকারিটা আজকে একটু লবণ কম হয়েছে। যদিও কথাটা একদমই সত্য নয়। আজকাল আমি তরকারিতে প্রায় লবণ খাইনা। বিনা তরকারিতে রান্না করে দিলেও টুঁ শব্দটা করি না।
সে কোন কিছু বলল না। একবার মাত্র চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো। তার চোখ দুটা ভেজা ভেজা মনে হল। আমি আর কথা বাড়াতে সাহস পেলাম না। এটা ভালোভাবে টের পেলাম প্রিয় মানুষের আশ্চর্য নিরবতা বেশ ভয়ংকর ।একসময় বাধ্য ছেলের মতন চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে গেলাম।
প্রায় এরকম হয়। শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তিতে শরীরটা বেসুরে বাজছে। রাতে কখন ঘুমিয়ে গেছি জানিনা। পাশে ছোট্ট মেয়েটা। ছোট্ট একটা ব্যবধান। ইচ্ছে করলেই টপকাতে পারি । কিন্তু পারছি না মনে হচ্ছে হাজার বছরের ব্যবধান। গভীর রাতে তপ্ত কিছুর একটা স্পর্শ অনুভব করছি। আমার জামা গেঞ্জিভিজে যাচ্ছে গরম চোখের জলে।
চোখ খুলে দেখি, আনিশা মেয়েটাকে এক পাশে সরিয়ে আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে। ঘরের পাশে লেবু গাছটা ফুলে ফুলে ফুলবতী হয়েছে। তারই একটা তীব্র গন্ধে আমার ঘরটা ফুলের সৌরভে ছেয়ে আছে। যা আমার শরীরটাকে চনমনে করে তুলছে।
**************************
কুকুরের ডাক
আব্দুল মালেক
প্রায় প্রতিদিনের মতো আজকেও ঘুমটা আচমকা ভেঙে গেল। স্বপ্নচালিতের মত বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে এলাম। কি জানি কেন আমাকে রাতের বেলায় একবার না একবার বাইরে আসতেই হয়। না হলে মনে হয় যেন আমার দম বন্ধ হয়ে যায়
গভীর সুপ্তিতে ঘুমিয়ে থাকা গ্রাম। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখি। কোথাও কোন মলিনতা নেই প্রকৃতির বুকে যেন প্রকৃতির সন্তান ঘুমাচ্ছে পরম নির্ভরতায়
রাত পাহারায় জেগে থাকা কুকুরগুলো এখানে ওখানে ঘুমিয়ে কিংবা শুয়ে আছে এক আধবার মাথা উঠিয়ে আমাকে ওরা দেখে নেই। তারপর আবার পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ে। একটুও শব্দ করে না । ওরা বেশ ভালোভাবেই জানে আমি ওদেরই একজন। কোন ক্ষতি হবে না।
দিনের বেলা কুকুরগুলো দুষ্টু ছেলেদের ভয়ে প্রায় লুকিয়ে থাকে। রাত হলে বেরিয়ে আসে এবং এক জায়গায় জড়ো হয়। রাস্তায় যানবাহন লোকজনের চলাচল কমে গেলে প্রায় ওদেরই দখলে চলে যায় রাস্তাটা। রাজার মতো শুয়ে থাকে পুরো রাস্তা জুড়ে।
একেক দিন ওরা রাতটাকে চিলচিতৎকারে মাতি য়ে রাখে ।পাড়া দখলে মেতে ওঠে নিজেদের মধ্যে। একবার এপার কুকুরগুলো ও পাড়ার কুকুরগুলোকে তাড়তেতাড়তে একদম শেষ সীমানায় রেখে আসে।। আবার সুযোগ বুঝো ওপাড়ার কুকুরগুলো হুংকার ছেড়ে এগিয়ে আসে এপাড়ার কুকুরগুলোর উদ্দেশ্যে।
এক একদিন কুকুরগুলো কি হয় জানিনা বিকট চিৎকারে পারা তোলপাড় করে দেয়। অথচ কোথাও কোন একটা মানুষের সাড়া শব্দ নেই। খারাপ কিছু দেখলেই চিল্লাচিল্লি করে। ওরা নাকি অদৃশ্য লোকের অনেক কিছুই দেখতে পায়। যা আমাদের চোখে পড়ে না।
বৃষ্টি ভেজা রাত। একটা কেমন সির সিরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে । ভাঙা ভাঙা মেঘের আড়ালে চাঁদের লুকোচুরি খেলা চলছে। চারদিকের পরিবেশটা কেমন একটা রহস্যময়। গা ছমছমে ভাব।
এখন গভীর রাত। কি জানি কুকুরগুলো একসঙ্গে ডাকছে। কুকুর গুলোর আওয়াজেও যেন কেমন একটা ভয়ের ভাব ফুটে উঠছে
। আমি রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় যেতেই আমার হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আলো অন্ধকারে রাস্তায় একটা তাল গাছের সমান ছায়া মূর্তি হেঁটে চলেছে। খানিকটা গিয়েই বাম পাশে কবরের রাস্তাটাই মিলিয়ে গেল ।আর পিছনে কুকুরগুলো ডাকতেই থাকলো।
**********************
এক জোড়া কালো তিলের গল্প
আবদুল মালেক
একটা নার্সারি স্কুলের অফিস রুমে হঠাৎ সেদিন দেখা মেয়েটার সাথে। প্রথম দেখাতেই মনে হল সে আমার কত চেনা। সহজ ভাষায় কথা বলছে।
আমি এক পাশে লজ্জাবতী লতার মতন গুটি সুটি হয়ে বসে আছি।
মোটা গোলগাল ধরনের চেহারা মেয়েটার। গায়ের রং শ্যামলা। মুখটা পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোল। ডাগর ডাগর দুটি চোখে আলো ঠিকরে পড়ছে। ডান পাশের গালে এবং থুতনির নিচে একটা বিন্দুর মতো কালো তিল। যা সৌন্দ র্য টাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মেয়েটা অন্যদের সাথে গল্পে ব্যস্ত। আমি এক নিমেষে তাকিয়ে আছি তার মুখের দিকে। অদ্ভুত একটা আকর্ষনে আমার দৃষ্টি তিলটাই আটকে গেছে।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্কুলে সবার সঙ্গে একটা বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠলো। কি জানি কি করে ওরা আমার অন্য একটা পরিচয় জেনেছে আমি নাকি কবি। কবিতা লিখি। মেয়েটা আমার আরো কাছে এলো। ওকে একান্ত আপন করে পাওয়ার একটা দুর্মর বাসনা মনের মধ্যে জেগে উঠলো। কিন্তু পাওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু অযাচিত ভাবেআমার আনন্দ সঙ্গী হল। কান্না হাসি আনন্দ- বেদনায় মেশানো দিনগুলি স্বপ্নের মত কেটে গেল।
পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোল মুখটাই দুটি তিল। ওকে মনে হয়েছে তিলেশ্বরী। আমার অনেকদিন রাতের আনন্দের উৎস ভূমি গালের ঐ তিল।
যে তিলটা ছিল আমার আনন্দের উৎস ভূমি, সেই তিলটায় আজ আর আমার ভালো লাগছে না। শঙ্কায় বুক কাঁপছে। তিল দুটো আকারে দ্রুত বাড়ছে। আমি জানি তিল আঁচিল আর যাই হোক
অ ত বেশি বাড়া ভালো নয়।
No comments