গল্প - স্মৃতির সরণী বেয়ে, কলমে - সুলতানা পারভিন

 



স্মৃতির সরণী বেয়ে
সুলতানা পারভিন


আমি একজন স্কুল শিক্ষিকা। বোনের বিয়ে, অনার্স পরীক্ষা। এখন চলছে পাস কোর্সের পরীক্ষা। তাই স্কুলে ছুটি নিয়ে খুব সকালেই বাস ধরে পৌঁছে গিয়েছিলাম বোনের মেসে। বোনকে খাইয়ে নির্দিষ্ট সময় পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে আমি বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। তারপর টিফিনের সময় কাছের দোকান থেকে ডাব, কিছু খাবার নিয়ে আবার তাড়াতাড়ি পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে গেলাম। টিফিনের পরে আছে আর একটা পরীক্ষা। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, কখন বোন হাসিমুখে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আসবে। আমার পাশে আরো অনেক গার্জেনস। সবার হাতেই ডাব, খাবার। সবাইকে দেখে হঠাৎ আমার ছাত্রী জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। এরকমই একটা দিনে আমিও বহরমপুর এসেছিলাম বিয়ে অনার্সের পাস কোর্সের পরীক্ষা দিতে। আমি কান্দি রাজ কলেজের ছাত্রী ছিলাম। তাই আমাদের পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল বহরমপুর কমার্স কলেজ। অর্থাৎ বাড়ি থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূর। কি করে পরীক্ষা দেবো ,ওখানে তো আমাদের কোন আত্মীয়ও নেই। আব্বা নেই, মাও বাইরের জগতটা সেরকম দেখেননি, বড় ভাই বা বুবুও নেই। তাই কি করে পরীক্ষা দেব সে ভাবনাটাও আমার উপরেই ন্যস্ত ছিল। অনেকদিন আগের কথা। বহরমপুরে তখন মেয়েদের গুটিকয় মেস। তাছাড়া কোন মেসে থেকে পরীক্ষা দেওয়ার মত সামর্থ্যও ছিল না। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর ঠিক হলো, আমার বান্ধবীর দাদুর বাড়ি বহরমপুর। ওখান থেকেই পরীক্ষাটা দেব। ওরা হিন্দু। কিন্তু একজন অনাত্মীয় অসহায় মুসলিম মেয়েকে বাড়িতে থাকতে দেওয়ার জন্য ও তার পরীক্ষাটা না দিতে পারাটা, পারায়  পর্যবসিত করার জন্য আমি ওদের কাছে চিরঋণী। ওদের দোতালার নতুন অসমাপ্ত ঘরটিই আমাকে যুগিয়েছিল লড়াইয়ের রসদ, ওই ঘরে বসেই আমি ভবিষ্যতে পায়ের নিচে মাটি পাবার জন্য খাটতাম, দাঁতে দাঁত চেপে। তখন পাস কোর্সের পরীক্ষার একটি বিষয়ের ফাস্ট ও সেকেন্ড পেপার একদিনে হতো। থার্ড পেপারটা হতো পরে যে কোন একদিন। বোনের পরীক্ষা কেন্দ্রে এসে আমারই পাস কোর্সের পরীক্ষার একদিনের কথা মনে পড়ে গেল। সেদিনও দুহাফ পরীক্ষা ছিল। প্রথম পরীক্ষাটা বেশ ভালোই হয়েছিল। এক ঘন্টা টিফিন ব্রেক। হল থেকে বেরিয়ে দেখি বাইরে প্রচুর গার্জেনস। সবার হাতেই ডাব, খাবার দাবার। আমারও প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। পাবে না বাই কেন? পরীক্ষার টেনশনে নামমাত্র ভাত খেয়ে এসেছি। সবার গার্জেন, তাদের ধরে ধরে আদর করে খাওয়াচ্ছে। কিন্তু আমার যে কেউ নেই? কে আনবে আমার জন্য ডাব ,খাবার? দু চোখ দিয়ে বইতে লাগলো অশ্রুর অবিশ্রান্ত ধারা। চোখ মুছে, হাতে ধরে রাখা জলের বোতল থেকে ঢক ঢক করে জল খেয়ে আমি দ্বিতীয় পরীক্ষাটা দিতে গেলাম। আমাকে যে হারলে চলবে না। লড়াইয়ের যে এখনো অনেক বাকি। সেই দিনটার কথা ভেবে, আবারো চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো। স্বস্তি পেলাম এই ভেবে, যে বোনকে ওই একই কষ্ট পেতে হলো না।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url