গল্প - পূর্ব জন্মের ভালবাসা, লেখক - ডাক্তার অনির্বাণ কুন্ডু , এম আর সি পি ( ইউ কে), বাংলা অনুবাদ - সামসুজ জামান
পূর্ব জন্মের ভালবাসা
ইংরেজি ভাষায় মূল রচনা - ডাক্তার অনির্বাণ কুন্ডু , এম আর সি পি ( ইউ কে)
বাংলা অনুবাদ - সামসুজ জামান
কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া দৃশ্যমানতার সূচক ছিল খুব খারাপ। অত্যন্ত ঠান্ডা একটা সকালের কথা। মুসৌরি রাজকীয় ভিউ হোটেলে বারান্দা থেকে হিমালয়ের দূরবর্তী শিখরগুলি খুব সামান্যভাবেই দেখা যাচ্ছিল।
ডক্টর গগনদীপ এবং ডক্টর দিশা তাঁদের নিত্যনৈমিত্তিক দায়িত্বপূর্ণ সময়সূচী এড়িয়ে সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে এসেছিলেন হোটেলের এই নিভৃতে। আচ্ছা , কৌতুহল হচ্ছে তো ডক্টর গগনদীপই বা কে আর দিশা কুমারীই বা কে? বলছি বলছি। ডক্টর গগনদীপ সিং হলেন এইমস ঋষিকেশের সাধারণ চিকিৎসা বিভাগের জুনিয়র রেসিডেন্ট এবং ডঃ দিশা কুমারি একই প্রতিষ্ঠানের গাইনোকোলজি ও অবসটেটিক্স বিভাগের জুনিয়র রেসিডেন্ট। তারা এইমস ,ঋষিকেশে যোগদানের প্রথম দিন থেকেই বন্ধু এবং তাদের বন্ধুত্বের তরঙ্গ দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্কের সীমা অতিক্রম করে সম্ভবত প্রেমের শিখরে পৌঁছেছে।
গগন দীপ এবং দিশা একে অপরের জন্য নিখুঁতভাবে তৈরি হয়েছিলেন এবং দিন দিন প্রেমের মহাসাগরে ডুবে যাচ্ছিলেন। ইনস্টিটিউটে সবাই এই প্রেমিক দম্পতির কথা জানত ঠিক যেমন অন্যান্য জুটির কথা কথা নিয়ে জানত ঠিক সেভাবে নয় বরং আরো অনেক গভীরভাবে।
কিন্তু ভাগ্য তাঁদের জন্য কিছু অন্যরকম পরিকল্পনা করেছিল এবং কপাল বোধহয় তাঁদের খারাপ ছিল তাই ভাগ্য তাঁদের প্রতি নিষ্ঠুর ছিল। ডক্টর আকাঙ্ক্ষা ঝাঁ নামের অন্য এক মহিলা এই প্রতিষ্ঠানে ডক্টর গগনদীপ এর ইউনিটের সাধারণ চিকিৎসা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করলেন। তো, শুরুর দিকে সবকিছু বেশ ঠিকঠাকই ছিল বেশ সরলভাবেই চলছিল জীবনযাপন। ডক্টর আকাঙ্খা প্রতিটা রেসিডেন্ট এর সাথে একটা ভালো শিক্ষক ছাত্র সম্পর্ক বজায় রাখছিলেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠান এর বার্ষিক উৎসবের দিন সন্ধ্যায় বিষয়গুলি হঠাৎ পরিবর্তিত হয়ে গেল অদৃশ্য কোন শক্তির অঙ্গুলি হেলনে।
ডক্টর আকাঙ্ক্ষা অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশে পুরোপুরি মদ্যপ ছিলেন। এটি ছিল ডিজে রিমিক্স রাত এবং সংগীত সর্বোচ্চ ডেসিবেলে বাজছিল। সকলেই জনপ্রিয় বলিউড নাচের গানগুলোর সঙ্গে সঙ্গে পা মিলাচ্ছিল। হঠাৎ ডক্টর আকাঙ্ক্ষা এগিয়ে এলেন অদ্ভুত ভাবে তাকালেন ডক্টর গগনদীপের দিকে। এগিয়ে গেলেন আরো আরো। একসময় ডক্টর গগনদীপের হাত ধরলেন। এবং তাঁর সাথে নাচতে শুরু করলেন। ডক্টর গগনদীপ কেমন যেন একটু অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। ব্যাপারটা আঁচ করে তিনি ইশারায় ডক্টর আকাঙ্ক্ষাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ভবি ভুলবার নয় তাই ডঃ আকাঙ্খা নেশার ঘোরে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ধরে ডক্টর গগনদীপকে উষ্ণ চুম্বন দিলেন।
ঘটনাটা নজর এড়ালো না ডক্টর দিশার। হঠাৎ ঘটনার এই পরিবর্তন দেখে তিনি প্রথমে হতবাক এবং নির্বাক হয়ে পড়লেন। তারপর হঠাৎই কাঁদতে শুরু করলেন বাচ্চা ছেলে মেয়ের মত এবং যেন কিছু প্রলাপ বকতে লাগলেন যেগুলো সেই মুহূর্তের নাচাগান আর উচ্চ আওয়াজ ভেদ করে জনসমক্ষে পৌঁছাতেই পারলো না।
একটু বাদে ডক্টর গগনদীপ, জোরপূর্বক ভাবে ডক্টর আকাঙ্খাকে নাচ থেকে বিরত করলেন। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। ডক্টর আকাঙ্ক্ষা মৌতাতের প্রভাবে একেবারে বাদশাহী মেজাজে ছিলেন, তাই তার কাছে ডক্টর গগনদীপের এই থামানোটা অর্থহীন ছিল। তিনি আবার এগিয়ে গেলেন গগনদীকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণভাবে চুম্বন করতে শুরু করলেন এবং তার লাফিয়ে তার কোলে ওঠার চেষ্টা করলেন।
এ পর্যন্ত অনেক কষ্টে দিশা সহ্য করছিলেন কিন্তু এখন সহ্যের বাইরে চলে গেল। তাই তিনি আচমকা নাচের মঞ্চ থেকে সরে এলেন এবং মনের দুঃখে ছুটতে ছুটতে হোস্টেলে নিজেদের ঘরে পৌঁছলেন। গগনদীপ তাঁকে থামানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু দিশা তাঁর সাথে কথা বলতেও অস্বীকার করলেন। তারপর পার্টি মধ্যরাত্রে ভেঙে গেল। এবং হয়তো আজকের ক্ষতগুলির কারণে তাদের সম্পর্কের টানা পোড়েনের জন্য কোন মলম দেওয়ার পক্ষে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।
দিশা ইতিমধ্যে মোবাইলে গগনদীপকে ব্লক করে দিয়েছিলেন। এবং যদিও গগনদীপ সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলেন নিজের নির্দোষতা প্রমাণ করার জন্য কিন্তু দিশা তাঁকে এড়াতে শুরু করেছিলেন। তাদের দুজনের হৃদয়গ্রাহী আত্মিক সম্পর্কের ক্রিম, আকাঙ্ক্ষার ছিটিয়ে দেওয়া কদর্য এক ফোঁটা সাইট্রাসের প্রভাবে একেবারে তিক্ত হয়ে গিয়েছিল।
আকাঙ্ক্ষা, গগনদীপ কে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল এবং দিশার অস্থায়ী ভাবে কিছুদিন চোখের আড়ালে থাকার সুযোগের সদ্ব্যবহার করে গগন দীপ- দিশা সম্পর্কের শূন্যতার সদ্ব্যবহার করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। শুধু তাই নয়, তাঁদের সহকর্মী সাথীদের কিছু কিছু প্রিয়জনকে নিয়োগ করেছিল কোন সাজানো পাথর না উল্টে ফেলেও গগনদীপকে তাঁর সাথে মিলিয়ে দেবার চেষ্টায়।
দিশা ইতিমধ্যেই তাদের সম্পর্কের আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়ে গেছেন এবং নির্বাক হয়ে নিজের জগতে আবদ্ধ থেকে নিজের কাজকর্ম করে যাচ্ছেন নির্লিপ্তভাবে। ইতিমধ্যে ঋষিকেশের ত্রিবেণী ঘাটের পবিত্র গঙ্গার জলধারা অনেক দূর হয়ে গেছে। এর আগে গগনদীপের সঙ্গে দিশার দৈনিক গোধূলিতে সাক্ষাৎকারের একটা স্থান নির্দিষ্ট ছিল। সময় দ্রুত পেরিয়ে গেছে তিন মাস কোথা দিয়ে কেটে গেছে তাদের ছন্নছাড়া জীবনের।
কিউপিডের ইচ্ছা অনুযায়ী সে তাদেরকে আঘাত করেছিল প্রেমের একটি শক্তিশালী তীর দিয়ে। হঠাৎ ডিপার্টমেন্টে একটা গরম খবর ছড়িয়ে পড়ল- ডক্টর আকাঙ্খার পরিবারের সদস্যরা ইতিমধ্যে তাঁর বিয়ের ব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক ডাক্তারের সঙ্গে পাকা করেছেন, যিনি বিয়ের জন্য পরের সপ্তাহে এই ভারতে আসছেন। শীতকালে যে পারদ ছিল নিম্নমুখী তা হঠাৎ যেন চূড়ান্তভাবে উঠে দাঁড়ালো। এমন কি ডক্টর দিশাও ইনস্টিটিউটের এই মুহূর্তের গরম খবরটি শুনেছেন এবং সত্যি বলতে এটি শুনে, তাঁর মনের খুশির প্লাবন অনেক উচ্ছসিতভাবে মাথা তুলেছে।
তারপর একদিন সেই সুখক্ষণ এলো যখন ডক্টর আকাঙ্খা নিজের চাকরি থেকে রেজিগনেশন সাবমিট করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হতে চলেছেন। সেদিন ডক্টর দিশা ঘরের মধ্যে একা চোখের জল ফেলছিলেন আর দুহাতে মুখ ঢেকে মনে মনে ভাবছিলেন কিউপিড এবং সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তাঁদের প্রতি সম্পূর্ণ কৃতজ্ঞ না হলে বিষয়টাই অন্যদিকে চালিত হয়ে যেত। তাঁর অজান্তে কখন যেন চোখে নিবিড় ভাবে নেমে এলো শান্তির ঘুম- অনেক...দিন, উঃ, অ নে ক দিন বাদে তিনি আজ শান্তির ঘুম ঘুমালেন ডক্টর গগনদীপের সঙ্গে তার পুরনো স্মৃতির স্বপ্ন দেখতে দেখতে।
সকাল তেমনভাবে হয়নি তখনও, ঘুমের মাঝেই দিশা তাঁর নাম ধরে ডাকতে থাকা কণ্ঠস্বর শুনেই চমকে উঠলেন। বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠেই পর্দার ফাঁক দিয়ে এক পলক সেই মানুষটাকে দেখতে পেয়ে উত্তেজনায় তার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। তারপর যেন কোন মানুষ নয়, একটা দুরন্ত হরিণী ঠান্ডা আবহাওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে সিঁড়ি দিয়ে দুরন্ত গতিতে দৌড়ে নিচে নামতে লাগলো। ঘটনাটা দেখতে দেখতে গগনদীপের সারা শরীর শিহরিত হয়ে উঠল। তার বলার ইচ্ছে ছিল - 'আরে পাগলী, আমি তো অপেক্ষা করছি তোমার জন্য! আরে সাবধান! তুমি যেভাবে দৌড়াচ্ছ ভেবেছো, পড়ে গেলে কী সাংঘাতিক অবস্থা হবে!' কিন্তু ঘটনার উত্তেজনায় তাঁর মুখ দিয়ে কথা বেরোলো না। গগনদীপ আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিলেন- ডক্টর দিশার বাস্তব বোধ যেন হারিয়ে গেছে। সেভাবেই দিশা তাঁকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত চুমু খাচ্ছিল আর গগন দীপের বুকের মধ্যে কিল মারতে মারতে কান্নায় ভেসে যাচ্ছিল। আচমকা চারিদিক থেকে আনন্দের কলধ্বনি আর হাততালি শুনে তারা চমকে উঠল। দেখল হোস্টেল এবং প্রতিষ্ঠানের সবাই জেগে উঠে ভালোবাসার এই মুহূর্ত দেখতে দেখতে উত্তেজনা আনন্দে ভেসে যাচ্ছে।
সেদিনই রাত্রে, প্রতিষ্ঠানে অকাল দীপাবলীর উদযাপন হল। প্রিয়জন এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের উপস্থিতিতে ডক্টর গগনদীপ এবং ডক্টর দিশা একে অপরের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হছিলেন। পরের দিন নববিবাহিত দম্পতি তাদের হানিমুনের জন্য মুসুরি তে চলে গেলেন। বিভাগ থেকে সপ্তাহন্তের একটি ছুটি দেয়া হয়েছিল তাদের ব্যস্ত ডিউটি সিডিউল কে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করেও।
পুনশ্চ- এটি সঠিক ভাবেই বলা হয়েছে যে- " কর্মের কোন মেনু নেই। আপনার যা প্রাপ্য তা আপনাকে পরিবেশন করা হয়!"