গল্প - অপদার্থ, লেখক - আবদুস সালাম

 


অপদার্থ

আবদুস সালাম


অফিস ঘরের  দরজা জানালা সব বন্ধ। চলছে রুদ্ধদ্বার বৈঠক।

বৈঠকের  বিষয় বস্তু  পঞ্চায়েত সমিতি থেকে পাওয়া প্রায় বিশ লক্ষ টাকা যা কাজী কল্যানীয়া হাইমাদ্রাসার  হোস্টেল নির্মাণ ও সৌন্দর্যায়ন উপলক্ষে হয়েছে বরাদ্দ।

 স্বভাবতই  শিক্ষক মহাশয়গণ খুব খুশি।  নিজেদের ইচ্ছামতো করে স্কুলটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে শিক্ষার   সুন্দর পরিবেশ তৈরি করা যাবে। টাকাগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে অনেক কাজ করা যাবে।

  হ্যাঁ  সজল চৌধুরী।পেটে কালির আঁচড় না থাকলে ও তথাকথিত বুদ্ধিমান মানুষদের কান কেটে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন তিনি। ইদানিং পঞ্চায়েতের প্রধান হয়েছেন। কিভাবে হয়েছেন সেটা  না জানাই ভালো। এরই সুবাদে থানার লোকজনের সাথে  বিস্তর দহরম মহরম । তবে কাজের লোক এটা বলা যেতেই পারে।

  গ্রাম হোক কিংবা পাড়ায় কোনো গন্ডোগোল  বাধলেই  ডাক সজল দা কে। মূহুর্তের মধ্যেই আপনার  কাজ হাসিল। এহেন  সমস্যা নেই যার সমাধান করতে তিনি ব্যার্থ।   সমাজ সেবী হিসাবে সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে এদিকে ওদিকে।

 সজল চৌধুরী এখন  কাজী কল্যানীয়া হাইমাদ্রাসার সেক্রেটারি।

   রাত বিরাত , রাস্তা ঘাটে বিপদে পড়লে মুসলমান লোক ডাকে আল্লাহ কে আর হিন্দুরা ডাকে ভগবান কে ।আর কাজীপাড়ার লোক কোনো বিপদে পড়লে ডাকে সজল চৌধুরী কে।

   বিপদে পড়েছেন তো কি হয়েছে! দক্ষিণা দিন আর নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি চলে যান । আরে মশাই এপাড়ার ভগবান এখন সজল বাবুই। তবে এটা মনে রাখতে হবে শুধু হাত মুখে ওঠেনা। 

    এখানে সেখানে মিটিংএ মিছিলে দুকথা বলতে গিয়ে  বুক ফুলিয়ে বলেন কাজী কল্যানীয়া হাইমাদ্রাসার কেমন করে উন্নয়ন করতে হয় আমি দেখিয়ে দিবো।  জেলার সেরা ইস্কুলে  পরিণত করেই ছাড়বো । এটা আমার অঙ্গীকার। আমার কর্তব্য।শুধু  আপনারা আমার সঙ্গে থাকুন।

  স্কুলের  হোস্টেলের প্ল্যান প্রোগ্রাম সব তৈরি। মালপত্র কেনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের মতো বিশাল কর্মকান্ডের ভার কার উপরেই বা দেওয়া যায়।  সবাই  এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। সবাই  এক বাক্যে সজলবাবুর নাম প্রস্তাব করেন। সর্ব সম্মতিক্রমে তা গৃহীত ও হয়।

 ২)

 খোঁড়া খুঁড়ি পর্ব শুরু হয় তার পর দিন থেকেই। তোড়জোড় করে খোঁড়াখুঁড়ি পর্ব শেষ করে ফ্যালে কিবরিয়া মিস্ত্রী। হেড মাস্টার মশায়ের কাছে  প্রয়োজনীয় রড্ সিমেন্ট ,বালি পাথর ,ইঁট চাইছে । রোজ রোজ তাগদা দিচ্ছে আর বলছে মাষ্টারমশাই  তাড়াতাড়ি মাল দিন। রাস্তা খারাপ। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে মাল ফেলার সমস্যা হবে খুব। অল্প অল্প করে  মাল বইতে অনেক খরচ ও পড়বে। আমি ও বিপদে পড়বো। আপনি ও বিপদে পড়বেন।বহন খরচ অনেক পড়ে যাবে।

 মাষ্টারমশাই কোনো উত্তর দিতে পারছেন না।  মাল কিনে মিস্ত্রী কেও দিতে পারছেন না।কবে নাগাদ মাল পড়বে তাও তিনি বলতে পারছেন না।     সহকর্মীরা  রোজ রোজ মিস্ত্রীর আসা যাওয়া দেখে বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। সহকর্মীরা এবার প্রশ্ন করতে শুরু করেছে।  মিস্ত্রী তো ঠিকই বলেছে। কেনই বা আপনি মাল ফেলতে দেরি করছেন? সহকর্মীদর বলার  স্বর ক্রমে রুক্ষ হয়ে উঠছে ।মহাসিন বাবু কোন কথার উত্তর না দিয়ে সহকারী মাষ্টারমশাইগণের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকছেন শুধু ।

   স্কুল থেকে বাড়ি গেলেই  দফায় দফায় বেজে উঠছে  ফোনের রিং। মাথা  ঝিমঝিম করছে। না পারছে কাউকে বলতে , না পারছে কারুর সঙ্গে পরামর্শ করতে। ফোন তুললেই  ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসছে  ধমকানি।কখনো  হুমকি  ।  স্কুলের রাস্তায়  না গোটা হয়ে পড়ে থাকার  মধুর বয়ান।  কখনও দেনা পাওনা,চাঁদার লম্বা রশিদ লম্বা ফিরিস্তি। মহাসিন সাহেব ভাবছেন  এমনতর অন্যায়কে কিভাবে মেনে নিবো । অগত্যা  টেবিলে বসে মাথার চুল ছেঁড়া ছাড়া আর কোন উপায় ঔনেই

 অশরীরী এক আত্মা যেন  পথ আগলে তটস্থ করে রাখছে। কখন কোন দিক থেকে এসে যে  গলা টিপে ধরবে বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ছে।  মিটিং এর দিন থেকেই   বয়ে চলেছে ভিতরে  বাহিরে ঝড় । রাতে  ঘুমানোর  শত  চেষ্টা  ব্যর্থ হয়ে  যাচ্ছে ।  ঘুমের বড়ি ন্যায়  অন্যায়ের দোলাচলে বিনিদ্র রজনী চলছে। ঘুম  যেন চোখের পাতায় আসতেই চাইছে না । রাতে  বিড়ি  খাওয়ার  পরিমাণ বেড়েছে। পড়েছে  চোখের কোণে কালি।

৩)

দ্বিতীয় বার ম্যানেজিং কমিটির ডাকলেন মহাসিন সাহেব। সবারই মনে একটায় প্রশ্ন হেড মাস্টার কেন কাজ শুরু করছেন না। মিটিং এর সব সদস্যের মুখে বিড়ম্বনা মূলক উচ্চারণ।   মনে মনে সবাই ভাবছেন হেড মাস্টার কী তবে টাকা আত্মসাৎ করার ছক কষছেন তলে তলে। আবার এও বলাবলি করছেন  তিনি তো এখানে সেখানে প্রচুর পরিমাণে দান খয়রাত করেন। সামান্য কয়েকটা স্কুলের টাকা পয়সা নিয়ে   ছিনিমিনি খেলবেন!এ হতেই পারে না।  হয়তো সবই সম্ভব। অনেক টাকা দেখে লোভ সামলাতে পারছেন না। আবার এও মনে মনে ভাবছেন সবই তার মুখোশ।

 কমিটির বৈঠকে চলছে তুমুল বাকবিতণ্ডা। তিরের ফলার মতো প্রশ্ন  ছুড়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। কাজ কেন এখন ও শুরু হলো না তার জবাব দিন। অপেক্ষাকৃত কঠিন বাক্যবানে জর্জরিত করে তুলতে ও  পিছপা হচ্ছে না।

  বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে মিটিং হলে যখন ঢুকলেন তখন সবাই চুপ।  হঠাৎ নিরবতা ভেঙে   হেডমাষ্টার বলে বসলেন বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের পুরো কাজ সম্পন্ন করার দ্বায়িত্ব ম্যানেজিং কমিটির হাতে সঁপে দিতে চায়।

 অন্য সব সদস্যগণ হতবাক হয়ে  গেলেন। হঠাৎ কি এমন হলো যে মাষ্টারমশাই সব কাজের দায়িত্ব ম্যানেজিং কমিটির হাতে ছেড়ে দিতে চাইছেন।

 সভাকক্ষ বেশ কিছুক্ষণ চুপ। পিন  ড্রপ সাইলেন্স বলতে মা বোঝায় ।কারও মুখে কোন কথা নেই।  পুরো সভা যেন  কোন  মানুষের শোক সভায় উপস্থিত হয়েছে। এক মিনিট নীরবতা পালন করছে যেন । 

  সব নীরবতার অবসান ঘটিয়ে সম্পাদক মহাশয় বলে উঠলেন এমন অপদার্থ হেড মাস্টার দিয়ে কাজ করলে আমি পার্টির কাছে কি জবাব দিব আপনারায় বলুন???—-


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url