ন্যায়ের পক্ষে, সাম্যের পক্ষে, লেখক - খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

 


ন্যায়ের পক্ষে, সাম্যের পক্ষে 

খগেন্দ্রনাথ অধিকারী 

_______________________

বিশ্বের সকল মানবতাবাদী 

দর্শনে, সকল মহান চিন্তাবিদদের ভাবনায়,কি বুদ্ধ, চৈতন্য, নানক, কবীর, মহানবী হজরত মহম্মদ, যীশু,

সবার বাণীর মধ্যে সাম্য, মৈত্রী ও শান্তির বার্তা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থেও অর্থাৎ উপনিষদে, কোরাণে, বাইবেলে, এই ভাবাদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে।

     আমরা এখন ঋতুচক্রের আবহে গ্রীষ্মকালে আছি। এই  ঋতুতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম (২৫শে বৈশাখ), আর বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের জন্ম (১১ই জৈষ্ঠ্য)। বিশ্বমাতার এই দুই মহান সন্তান উদাত্ত কণ্ঠে সাম্য, স্বাধীনতা ও ন্যায় বিচারের আহ্বান দিয়েছেন।

নজরুলের কথায় -----

তোমার দেওয়া এ বিপুল পৃথিবী সকলে করিব ভোগ।

 রবীন্দ্রনাথের কথায় ----

এ জগতে হায় সেই বেশি চায় 

যার আছে ভুরি ভুরি।

শুধু তাই নয়, "রাশিয়ার চিঠি"তে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা দর্শনকে

তীর্থ দর্শন বলে অভিহিত করেছেন।

বিশ্ব বন্দিত কবি তথা তুরস্কের 

সম্মোহনী জননেতা নাজিম হিকমত সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য 

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তথা তার দালালদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন।এক ই লড়াইয়ের পথে হেঁটেছেন পাকিস্তানের বিশিষ্ট উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ,চিলির বিশিষ্ট কবি পাবলো নেরুদা প্রমুখ। এই সব চিন্তাবিদরা 

জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য সমতা চেয়েছেন।

  যে প্যালেস্টাইন নিয়ে আজ‌ সারা বিশ্বের প্রগতিশীল মানুষরা উদ্বেল, সেই প্যালেস্টাইন মুক্তি আন্দোলনের নেতা ইয়াসের আরাফাত স্বাধীন প্যালেস্টাইনে ইহুদী মুসলিম খৃষ্টান নীর্বিশেষে সব মানুষের সমতা ও ন্যায় বিচারের কথা বলেছিলেন।

শেতাঙ্গ শাসনের অবসানের পর দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা শ্বেতকায় কৃষ্ণকায় নির্বিশেষে 

সকল মানুষের সমতার উপর জোর দেন।

এককথায় বলা যায় যে সমতার আদর্শের উপর জোর দিয়েছেন সব শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। মহাত্মা গান্ধী জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবার মঙ্গল অর্থাৎ সর্বোদয়ের কথা বলেন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ,ভি ভি ‌গিরি, ডঃ রাধাকৃষ্ণান প্রমুখ ভারত‌ মাতার মহান সন্তানেরা 

তাঁর অবস্থানকে সমর্থন করেন।

পি সি যোশী, সোমনাথ লাহিড়ী, প্রমুখ কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল মেহনতি মানুষের সমানাধিকার নিশ্চিত  ‌করতে‌‌  আমরণ লড়ে গেছেন।

‌‌ ‌ কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এই যে কিছু মানুষ ধর্ম,বর্ণ , আভিজাত্য, জাতপাতের 

ভিত্তিতে বিশেষ সুযোগ সুবিধার কথা বলেছেন।

   যেমন ফ্রান্সে অষ্টাদশ শতাব্দীতে বুরবোঁ রাজবংশের আমলে, ব্রিটেনে সপ্তদশ শতাব্দীতে স্টুয়ার্ট রাজাদের আমলে আভিজাত্যের ভিত্তিতে নীল রক্তের লোকরা বিশেষ সুযোগ সুবিধার অধিকারী ছিলেন।রোডেশিয়াতে(বর্তমান দক্ষিণ আফ্রিকা),ইয়ান স্মিথ প্রশাসন 

শ্বেতাঙ্গদের জন্য বর্ণভিত্তিক বিশেষ সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা 

করেন। আমাদের দেশে পরাধীনতার আমল থেকেই আম্বেদকর ও মহম্মদ আলি

জিন্না ধর্ম ও ‌জাতপাত‌ভিত্তিক‌ 

বিশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার কথা বলেছেন এবং ১৯৩২ সালে লন্ডন‌ বৈঠকে গান্ধীজিকে তাঁরা শর্ত দেন যে 

যদি গান্ধীজি মুসলিমদের জন্য ও তথাকথিত অনুন্নত সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য ধর্ম ও বর্ণভিত্তিক সংরক্ষণের ব্যবস্থা মেনে না নেন, তাহলে তাঁরা তাঁর পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিকে সমর্থন করবেন না। গান্ধীজি তথা তাঁর অনুগামী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, সীমান্ত গান্ধী খান আব্দুল গফুর খান, জাকির হোসেন,ভি ভি গিরি, ডঃ রাধাকৃষ্ণান, প্রমুখ, কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা যথা পি সি যোশী,সোমনাথ লাহিড়ী, মোজাফফর আহমেদ, আব্দুস রেজ্জাক খাঁ,"সাম্যের গান"এর কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সবাই আম্বেদকর ও জিন্নার প্রস্তাবকে ধিক্কার দেন। আম্বেদকরের জন্মস্থান খোদ মহারাষ্ট্রে জ্যোতিরাও ফুলে-সাবিত্রীবাঈ ফুলেদের তথা ফতেমা শেখের অনুগামীরা একই সঙ্গে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে বর্ণগত শোষণের বিরুদ্ধে (যেমন ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র কিম্বা শেখ ,সৈয়দ,কাজী, এই সব বিভাজন ভিত্তিক শোষণের অবসান চেয়ে) সংগ্রাম করেন

এবং জিন্না আম্বেদকরের ধর্ম ও বর্ণভিত্তিক সংরক্ষণের ব্যবস্থাকে সর্বনাশা বলে নিন্দা করেন। তাঁরা সবার সমান অধিকারের কথা বলেন।

  ইদানিং কালে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে কিছু মানুষ মুখে সাম্যবাদের কথা বলে এক অদ্ভুত যুক্তি খাড়া করছেন। তাঁরা বলছেন "caste and class are same "অর্থাৎ বর্ণ ও শ্রেনী এক। এই অজুহাতে তাঁরা বলছেন যে বর্ণভিত্তিক বিশেষ সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করলে সমস্ত শোষিত মানুষের মঙ্গল হবে। এটা ডাহা মিথ্যা কথা।কারণ, বর্ণভিত্তিক সংরক্ষণের ব্যবস্থা মেনে নিলে 

তথা কথিত উচ্চ বর্ণেজাত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাসিম শেখ, শরৎচন্দ্রের গফুর শেখ, আমিনা, জসিম উদ্দিনের সাজু,তারা শঙ্করের পূণ্য চক্রবর্তী (অগ্রদানী) প্রমুখদের দশা কি হবে? এই মানুষ গুলি তো চরম নিষ্পেষিত। অথচ তথাকথিত উচ্চ বর্ণের।আবার স্রেফ তথাকথিত "নীচু "জাতের ছূতোয় বিত্তবানরা কোটার সুযোগ সুবিধা পাবে,এটা অমানবিক। এই জন্যই তো বর্ণ বা ধর্ম ভিত্তিক সকল বিশেষ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিলেন কমীউনিস্টরা(পি সি যোশী সোমনাথ লাহিড়ীরা)ও গান্ধীজি -গান্ধীবাদী আজাদ রাধাকৃষ্ণান গিরি প্রমুখরা। মানবতাবাদ ও আমাদের দেশের ঐক্য -সংহতি বজায় রাখার স্বার্থে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ শিখ খৃষ্টান নির্বিশেষে, কিম্বা ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র বাদ -বিচার না করে, সমস্ত শোষিত মানুষের মঙ্গলের জন্য অর্থ নৈতিক মানদণ্ডে তাদেরকে সুরক্ষা মূলক বৈষম্য (protective discrimination)এর ব্যবস্থা করতে হবে এবং তার পাশাপাশি আদ্বিজ-চণ্ডাল‌-শেখ-গাজী-মোমিন

সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ধনীক শ্রেণীর বিরুদ্ধে কঠিনভাবে বৈষম্য  মূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে এটি জরুরী।



লেখক পরিচিতি:

অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।

ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান

পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯

পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

No comments

Powered by Blogger.