প্রবন্ধ - মহাশ্বেতা দেবীর গল্পে সমাজচেতনা, লেখক - ড. মনোরঞ্জন দাস

 



প্রবন্ধ

মহাশ্বেতা দেবীর গল্পে সমাজচেতনা

ড. মনোরঞ্জন দাস

         

       জীবন, জগৎ ও সমসাময়িকতা, তার  সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা ও আনুসঙ্গিকতা এক ধারাপাতে নিরন্তর প্রবাহগামী। এই পর্যাবরণের অঙ্গনে মহাশ্বেতা দেবীর গল্পের অনুক্রমিক পর্যালোচনা।


          মহাশ্বেতা দেবীর গল্পগুলোতে সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, বৈষম্য এবং প্রান্তিক মানুষের কষ্টের প্রতি গভীর মনোযোগ লক্ষ্য করা যায়। তিনি তাঁর লেখায় সমাজের নানা স্তরকে তুলে ধরেছেন, যেখানে সমাজের দুর্বল ও বঞ্চিত মানুষের জীবন ও তাদের কষ্টের প্রতি সহানুভূতি ও সংবেদনশীলতা বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর গল্পে সমাজচেতনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি লেখেন,

         " জগমোহনের মৃত্যু', 'রুদালি',' শিশু', ' নুন',' বিছন', এবং আরো গল্প... একটি বিশেষ অঞ্চলকে নিয়েই লেখা। ওই অঞ্চলটিকে আমি ভারতবর্ষ বলে মনে করি আর একই অঞ্চল বারবার ফিরে আসে। চরিত্রগুলির কাছেও তো দায়বদ্ধ। তাই 'বিছন'  গল্পের দুলন গঞ্জুকে নিয়ে পরে দুটি গল্প ' আজকাল' শারদীয়াতে লিখি। ওই অঞ্চল ও মানুষ স্বচক্ষে যত না দেখা ও জানা , মানসচক্ষে অনেক বেশি দেখা। প্রাত্যহিক নৈকট্য থাকলে লেখা যায় না। যে জন্য খেড়িয়া-শবররা আমার সত্তার সঙ্গে এতই জড়িত কাজে ও মনে, যে ওদের নিয়ে লিখতে পারি না।"১

        তার লেখায় বিমুগ্ধতা আছে, বিনম্রতা আছে, আছে  ইতিহাসের থেকে তুলে আনা উপজীব্য বিষয়, সেখানে সম্প্রদায়গত সাধারণত্ব আছে, আছে অসাধারণত্বও। তিনি লেখেন,২

       "আমি মনে করি  একেকটি মানুষ অজানা মহাদেশেরই মতো।যত আবিষ্কার করব, তত মুগ্ধ ও বিনম্র  হব। আর, যেহেতু ইতিহাসের চলমানতা ও অগ্রগতিকে বিশ্বাস করি , চরিত্ররা ঘুরে ঘুরে আসে। ' দ্রৌপদী' ও দুলন  তো 'অপারেশন? -- বসাই টুডু'তেও ছিল। এ সব গল্পের শিকড় তুলে টানতে টানতে বীজের সন্ধানও পেয়ে যাই। কৃষ্ণকে বধ করেছিলেন জরা ব্যাধ, কাওয়ামারা নামক যাযাবর সম্প্রদায়ের কথা জেনেই ' সাঁঝসকালের মা' লেখা। আমার নকশাল-আন্দোলন-অসম্পর্কিত গল্প উপন্যাস বিষয়ে আলোচনায় আগ্রহহীনতা, এগুলো জানি ও দেখে যাই। দীর্ঘকাল কিছুই   

যেন স্পর্শ করে না। তাই অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় কোথাও ' সাঁঝসকালের মা' গল্পের খুব প্রশংসা করেছিলেন, সে কথা মনে আছে।"২



            মহাশ্বেতা দেবী তাঁর লেখায় আদিবাসী, দলিত, এবং অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের জীবন ও তাদের কষ্টের কথা তুলে ধরেছেন। যেমন, 'দ্রৌপদী' গল্পে দলিত মেয়ে দ্রৌপদীর জীবন সংগ্রাম এবং তার উপর সমাজের অত্যাচার, বৈষম্য এবং বঞ্চনার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।


          তাঁর গল্পে নারী চরিত্রগুলো সমাজের নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের অধিকারের জন্য সোচ্চার হয়েছে। 'রুদালি' উপন্যাসে দলিত নারী ও সমাজের উপর তার প্রভাব বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে।


             মহাশ্বেতা দেবী তাঁর গল্পে সমাজের ধনী ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে বৈষম্য এবং শোষণের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন, 'মা ফ্রম ডাস্ক টু ডন' গল্পে গ্রামের মানুষের কষ্টের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি

কবিতা,

' তোমার চিত্রায়ণে সামগ্রিকতা

সমাজ সংসর্গে থাকে

          অনাবিল,

                অনন্য,

যেন তুমি বিশুদ্ধ বিস্তারে এঁকে চলো সব, সুনিপুন

          চিত্রকরেরই মতো।


তুমি বিভেদের অঙ্গন থেকে

বৈষম্যের ধারা তুলে আনো

                 তোমার কলমে,

                     প্রিয় সৃষ্টিতে,

যেখানে ব্যথা-দুঃখ-যন্ত্রণারা

      হয় সামিল,

              করে কিলবিল।'৩


            তাঁর গল্পগুলোতে রাজনৈতিক অসঙ্গতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং জনগণের প্রতি সরকারের অবহেলা ও বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তিনি লেখেন,

    " কী 'সাঁঝসকালের মা', কী ' বাঁয়েন' বা অনুরূপ গল্পগুলি বিষয়ে লোকবৃত্তের সম্পর্ক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ কমই করেছে। ইতিহাস, শ্রুতিকথা, পুরা কথা, মিথ, কিংবদন্তী, পুরাণ, ইত্যাদি ঘুরে ঘুরে আসে আমার লেখায়। আর আসে অন্ধ বিশ্বাসের  নিগড় ভেঙে দেবার চেষ্টা। যা এই আংটি-কবচ- মহাপুরুষ-মহামানবী- জ্যোতিষ শাস্ত্রী-- ' গেরোন কালে হাঁড়ি কেলো'র যুগে এক লড়াই বটে। সংস্কার ও বিজ্ঞানবিরোধিতা শিক্ষাপ্রাপ্ত সমাজকেও গ্রাস করছে। তবে সমান্তরাল গড়ে উঠছে বিজ্ঞান-চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষ। সময়টা রাহুগ্রাস ও পূর্ণগ্রাসের। ' বাঁয়েন' কবে লেখা! সেদিন এক মহিলা ডোমের খবর পড়লাম, তাকে চন্ডীদাসীর আপন মনে হল। ' দ্রৌপদী' লিখি ১৯৭৬ সালে। তারপর দ্রৌপদী থিমের কাছে সংস্কৃতি জগতের বারবার ফিরে যাওয়া দেখে ভালো লাগছে। স্তনকে কেন্দ্র করে আমি 'স্তন্যদায়িনী' লিখে সেদিনের বাঘ- সিংহদের প্রশংসা অনেক পাই, কিন্তু  ওই থিম তো ফিরে আসতে বাধ্য, নইলে ' চোলি কা পিছে'  

লিখতাম না।"৪


             মহাশ্বেতা দেবী তাঁর লেখায় সমাজের বিভিন্ন স্তরকে বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন, যেখানে প্রান্তিক মানুষের জীবন, নারী অধিকার, শ্রেণীবৈষম্য, রাজনৈতিক অসঙ্গতি, এবং শোষণের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাঁর এই সমাজচেতনা তাঁর লেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। তিনি লেখেন'

            " ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধতা থেকে বোঝা যায় । তাই নকশাল আন্দোলনকালেই 'খাইখালসি' প্রথার বিরদ্ধে এক অধূনাবিস্মৃত আদিবাসী লড়াই-এর কথা ' তীর- ১৯৯৩  লিখতেই হত। জমির কারণে আদিবাসীর দীর্ঘ ক্ষোভ থেকে নকশাল  আন্দোলনেরও   সূচনা। আমি ওদের জন্য ওদের লড়াইয়েই অধিকতর বিশ্বাসী। দেখা যাবে, আমি গল্পে সমাজ-শব-ব্যবচ্ছেদে বিশ্বাসী, সে সফল হই বা না ঽই। যত ব্যবচ্ছেদ করি, ততই দেখি, ক্যানসারের প্রাচীন ও কায়েমি সংক্রমন। আদিবাসী সহ অন্য ব্রাত্য সমাজ নিয়ে গল্প তো আমাকে লিখে যেতেই হয়। ভিখারি দুসাদরা সাংবিধানিক মৌল মানবাধিকারে বঞ্চিত থাকবে। অথচ তার রেকর্ড থাকবে না, এ কি করে হয়। ' জগমোহনের মৃত্যু' সম্ভবত এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তম  বয়ান। হাতি আমার কাছে আদিবাসীর মতোই। তার চেনা জগৎ সংকুচিত হচ্ছে, গজিয়ে উঠছে তার কাঁটার বেড়া।..."৫       


         মহাশ্বেতা দেবীর ছোটোগল্পে অন্ত্যজ ও আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতির পরিসর যা নির্বাচিত গল্পকেন্দ্রিক বিশ্লেষণ রাজেশ খান ও সুজয়কুমার মণ্ডল. মহাশ্বেতা দেবী অন্ত্যজ ও আদিবাসীদের জীবন উপজীব্যতা মাঝে প্রাচুর্যতা লাভ করেছে।

        সর্বতো, মহাশ্বেতা দেবীর গল্পে জীবনবোধের প্রাধান্য, সমাজ সংস্কৃতির মূল্যায়ণের অংশে একীভূত হয়ে আঞ্চলিকতাকে ছাড়িয়ে সার্বজনীন হয়ে রবে সর্বকালে।


তথ্যসূত্র

১. মহাশ্বেতা দেবীর পঞ্চাশটি গল্প; প্রতিক্ষণ  পাব. প্রা. লি.; ১৯৯৬; পৃ-১০ ;

২. ঐ;

৩. লেখক- তাৎক্ষণিক কবিতা;

৪. ১ নং-এর মতো;

৫. ঐ; পৃ- ১০-১১;

No comments

Powered by Blogger.