গল্প - অবৈধ প্রেম, লেখিকা - সুলতানা বেগম (আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র)

 


অবৈধ প্রেম
সুলতানা বেগম (আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র)

পরিণীতার হালকা গোলাপি রঙের পুরানো স্কুটিটা আজ কদিন থেকেই একটু ট্রাবল দিচ্ছিল, কিন্তু আজ তো তাকে একেবারে নাজেহাল করে ছাড়লো। পরিণীতা অফিস থেকে বেরিয়ে কোনো রকমে স্কুটিটা লাথ মেরে চালু করে পরনের শাড়িটা টাইট করে কোমরে জড়িয়ে, পায়ের পুরনো স্যান্ডেলটার দিকে একনজর বুলিয়ে নিয়ে ঘাড়ের ভ্যানিটি ব্যাগটা একটু সামনের দিকে টেনে কোমরে গুঁজে রাখা শাড়ির আঁচলটা দিয়ে একটু সিকিওর করে নিল। চোখে মুখে বিরতির ছাপ আর হবেই না বা কেন গ্রীষ্মের দাবাদহে  মাইল তিনেক স্কুটি চালিয়ে। রোজ অফিস যাওয়া আসা। দুধে আলতা গায়ের রংটাও আজ  যেন তামাটে হয়ে গেছে। বয়সের তুলনায় তাকে যে আজ বুড়ি দেখাচ্ছে স্কুটিটার সাইড মিররটার দিকে তাকিয়ে সেটা আজ আর তার বুঝতে বাকি রইল না। তবু মনের তিক্ততা সরিয়ে কোন রকমে স্কুটিটাতে স্টার্ট দিয়ে মাইল খানেক যেতে না যেতেই  টেল পাইপটা ফাটা বাঁশের মত আওয়াজ করতে করতে  ফঁস করে থেমে গেল।

     ব্রীজটা পার হওয়া হলো না। কোনরকমে একটা গাড়ি পাস হয় ব্রিজ দিয়ে। এক দিক থেকে গাড়ি আসলে অন্যদিকের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ না এক সাইডের গাড়ি পাস হয়, তাই কারো কাছ থেকে সাহায্য পাবার মতো অবস্থা তার ছিল না। গরমে রাগে মুখখানা তার লাল হয়ে উঠলো, কি আর করা স্কুটি থেকে নেমে কোন রকমে ঠেলে ঠুলে স্কুটি টাকে ব্রিজ পার করে নিয়ে এলো। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো,  ভ্যানিটি ব্যাগটাতে যে ছোট জলের বোতলটাতে সামান্য একটু জল ছিল তা খানিক আগেই ফুরিয়ে গেছে। অফিস থেকে বের হওয়ার আগে দেখে নিতে ভুলে গেছে যে বোতলটাতে জল আছে কিনা। তাই রাগে ক্ষোভে স্কুটিটাতে আরো দুই লাথ মেরে কষ্ট করে ঠেলে ঠেলে নিয়ে এলো বাস স্টপেজের  কাছে  একটা সাইকেল ভালো করার দোকানে সেটা জমা রেখে  ঠেলাঠেলি করে বাসে উঠলো। বাসের মধ্যে ভ্যাপসা গরম, ঘামের দুর্গন্ধ বসার জায়গা নেই। একে অপরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েই গোটা পথ আসতে হলো তাকে।  তার উপর আবার মিনিট কুড়ির হাঁটা পথ। ওই করেই বাড়ি পৌছালো পরিণীতা। বাড়ির গেট খুলে বাড়ি ঢুকতেই কানে এলো উচ্চস্বরে হাসির আওয়াজ। বাসার ঘরের দরজাটা খুলতেই দেখতে পেল দীপককে। মাও দীপকের সাথে সাথ মিলিয়ে হাসছে তা দেখে পরিণীতার গানটা যেন ছ্যাঁত করে উঠলো I

রাগান্বিত সরে বলে উঠলো কিরে তুই এখানে ? আমাদের এই বাড়ির ঠিকানা পেলি কার কাছ থেকে?

“মা শিলা, খুশিতে গদগদ হয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলে উঠলো এই ঘণ্টাখানেক আগে এসেছে, আমি দুপুরের খাবার খেয়ে সবেমাত্র বিছানায় গা গড়া দিয়েছি তার মধ্যেই কলিং বেলের আওয়াজ I লীলাটাও আজ আবার রান্নাঘরের কাজ সেরে অনেক আগেই বাড়ি চলে গেছে ছোট মেয়েটাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে বলে I তাই আমাকে উঠেই দরজাটা খুলতে হলো আর দরজা খুলেই দেখি দীপঙ্কর I”

অবশ্য এতক্ষন তোর কথাই হচ্ছিল I মায়ের মুখ থেকে সেই কথা শুনে তার সর্বাঙ্গের শিরা যেন দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো I দীপক সোফার থেকে উঠে কেমন আছো দিদি বলে পরিণীতার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই পরিণীতা বলে উঠলো  অত সৌজন্যবোধ দেখাতে হবে না। দিদি কত বছর পর তোমার সাথে দেখা,একটা প্রণাম করবো না, তোমার বিয়ের পর তোমার সাথে তো আর দেখা হয়নি I তা তুই এখানে কি মনে করে, তোর কাজকর্ম নেই ? না এমন বাউন্ডেলে হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াস I দীপক হেসে উত্তর দিল না দিদি কাজের জন্যই আমি তো এখানে এসেছি, একটা রিসার্চ করছি তাই তোমাদের এখানে মানে তোমাদের এই গ্রামে এলাম I কি নিয়ে রিসার্চ করছিস যে আমাদের এই গ্রামে আসতে হলো I “আগে বসো এত গরম থেকে এসেছ একটু ঠান্ডা হয়ে নাও , চা খাও তারপর ফ্রেশ হয়ে একসঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে আরাম করে আমি আর তুমি জমিয়ে গল্প করবো I”  পরিণীতা মনে মনে বলতে থাকলো আমার অতীত কি কখনো আমার পিছনে ছাড়বে না ? তার ওপর আবার এই গরমে  বাসের উপর  গুতাগুতি খেয়ে সমস্ত দিনের ক্লান্তি শেষে বাড়ি এসে স্নান সেরে, একটু চা খেয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ বিছানায় আরাম করে শুয়ে একটা ঘুম দেবো তার আর উপায় রইল না I দিদি চা খাবে ? শিলা মাসি বলছিল তোমাদের  কাজের মেয়েটার আজ আসতে একটু দেরি হবে। আমি চা বানাতে পারি। অবশ্য চাওমিনও ভালো বানায়, যদি বাড়িতে থাকে তবে বানিয়ে দিতে পারি।


      পরিণীতা আবার মনে মনে ভাবল ছোঁড়াটা আসতে না আসতেই মাকে হাত করে নিয়েছে। আমাকেও এত তেল মারছে কেন ? রাগ করে হলেও দীপকের দিকে একবার তাকালো,  ছোঁড়াটা দেখতে কিন্তু খাঁসা হয়েছে , বলিষ্ঠ বাহু, শক্ত চোয়াল,  লম্বাটে  গড়ণ চোখ দুটোও বেশ I বছর সাথেক আগেও কেমন লেড় বেড়ে ছিল দেখতে I পলির সাথে আসতো আর এখন পুষ্ট জোয়ান I পরক্ষনে রেগে গিয়ে বলে উঠলো,  না থাক তোমাকে আর কষ্ট করে চা, চাওমিন কিছুই বানাতে হবে না বলে নিজের ঘরে গেল I রাত তখন দুটো আজ পরিণীতার কিছুতেই ঘুম আসে না বারবার পুরানো স্মৃতিগুলো মনের মধ্যে নাড়া দিচ্ছে, ঘরে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে তাই ঘরের দরজাটা খুলে বাইরে বারান্দায় যাওয়ার আগে দীপকের ঘরের দিকে একবার উঁকি মেরে দেখতে যাবে ঘর থেকে আওয়াজ এল, “ দিদি ঘরে আসতে পারো আমি ঘুমাইনি “ পরিণীতা কোন উত্তর না দিয়েই বাইরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো I মিনিট দশেক সেখানে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের পানি চাইল I আকাশে তখন পূর্ণ চাঁদ জ্বলজ্বল করছে, তা দেখেও মনটাকে শান্ত করতে পারল না I আবার ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পাশের বালিশটা নিয়ে এপাশ ওপাশ করছে হঠাৎ করে নিজের বিছানাটাও যেন হূল ফুটাচ্ছে শরীরে Iপাশের ঘরেই দীপক শুয়ে আছে তাই তার বুঝতে দেরি হলো না যে পরিণীতা দিদি এখনো ঘুমায়নি। আর ঘুমাবি বা কি করে I সম্ভ্রান্ত  পরিবারের মেয়ে ভালবেসে বিয়ে করেছিল সতীশ দাকে Iতারও বিরাট ব্যবসা টাকা পয়সা গাড়ি-বাড়ি কিন্তু তার চরিত্রের পরিচয় পাই বিয়ের পরে পরেই I শারীরিক মানসিক নির্যাতনবউয়ের সামনে অন্য মেয়েকে নিয়ে তারই বিছানায় লটাপটি I সে সব কোন মেয়ে সইতে পারে ? দিদির কথা এখন থাক আমি বা কি বলব দিদিকে, একটা মিথ্যে কথা বলে আশ্রয় নিয়েছি I কতদিন মিথ্যা কথা বলে থাকতে পারবো এখানে জানিনা ? আমি দলের সবাইকে ফোন করতে বারণ করেছি কিন্তু বিমলদা যদি ফোন করে তবে তার ডাকে তো সাড়া দিতেই হবে I কদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকবো I  দলের পরিস্থিতি তো আমাকেও জানতে হবে I এইভাবে মাসখানেক দুজনে দুজনার ভয় নিয়েই থাকলো কে কার কথা জেনে ফেলে I

একদিন হঠাৎ পরিণীতা দীপককে বলল চল আজ আমরা নদীর চর থেকে বেড়িয়ে আসি I দীপক আমতা আমতা করতে করতে রাজি হল I মনে মনে বলল আজ আর রেহাই নেই দিদি আমার মিথ্যে ধরে ফেলবে যদি জিজ্ঞাসা করে এই গ্রামে আমি কি নিয়ে রিসার্চ করতে এসেছি I যদি কোন পেপার দেখতে চাই তখন আমি কি বলবো আজ নিশ্চয়ই ধরা খাব দিদির কাছে I খাটের নিচে ব্যাগের ভেতর রাইফেলটাও রাখা আছে I কালই তো জিজ্ঞাসা করছিল কাপড়ের ব্যাগটা আমি খাটের তলায় কেন রেখেছি I খাটের পাশে খালি বেঞ্চিটাতে কেন রাখিস না ? এইসব ভাবতে ভাবতে  দীপক পরিণীতার সাথে পায়ে হেঁটে গ্রাম পার হয়ে নদীর চরে গিয়ে দুজনায় পাশাপাশি বসলো I নদীর দুই কুলে সাদা বকের ডানার মতো কাশফুল,আকাশে অলস মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে  I কয়েকটা জেলে নদীতে মাছ ধরছে,একটু দূরে চোখ গেলে হাসি হা করা বিস্তীর্ণ বালুচর I দীপক I দিদি আজ আবহাওয়াটা ভীষণ ভালো তাই না ? তুমি জোর না করলে আমি হয়তো এই গরমের মধ্যে আসতাম না ভাগ্যিস জোর করলে I” নদীর ওই পারে যাবে চলো জেলেদের একবার জিজ্ঞেস করে দেখি ওপার থেকে আমাদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে না হয়, মজুরি দিয়ে দেব কি বলো ?” পরিণীতা I  যাবি চল যদি বৃষ্টি নামে ভিজে যাব যে I “আগে চলো না জিজ্ঞাসা করে দেখি।

      তাই চল পরিণীতার বেশ কয়েকজন জেলের প্রায় চেনা মুখ সে প্রায় বিকেলের পড়ন্ত বেলায় নিজের একাকীত্ব শেয়ার করে  নদীর  চারপাশের বস্তুদের সাথে কারো সাথে কোনদিন মনের কথা শেয়ার করেনি কারো সাথে কথা হয়নি কখনো সাহস করে এগিয়ে গেল পরিণীতাও Iদীপক একবার বলতেই একজন জেলে রাজি হয়ে গেল দীপক নৌকায় উঠে পরিণীতাকে হাত ধরে নৌকায় তুললো স্রোতের পক্ষে নৌকা   তরতর করে ছুটছে হাওয়াটা  পক্ষে বলে ছইয়ের উপর বাঁশের দন্ডে পাল টাঙিয়ে মাঝি বলল দিদিমণি, বাবু বসে পড়েন হাওয়ার গতি  বাড়তে পারে  বলে সে আপন মনে দাঁড়  বাইতে লাগলো I পরিণীতা বসলো দীপকের হাতটা ধরে নিজের পাশে বসালো I নৌকা ছুটে চলেছে তারা আপন গতিতে একটু মনোরম বাতাস এসে গায়ে লাগছে I পরিণীতা আস্তে করে দীপকের হাতটা চেপে ধরল তার কাঁধে মাথা রাখতেই কেন যেন তার মনে হলো কত যুগ পর চৈত্র মাসের খরায় যেন এক পশলা বৃষ্টি। কাঠফাটা  রোদের মধ্যে একরাশ স্নিগ্ধ বাতাস। যেন কথা বলে হৃদয়ের মাঝে I হৃদয়ের অব্যক্ত সুর উঠে আসছে। পরিণীতার মনে জমে থাকা মেঘ যেন আজ  বৃষ্টি হয়ে ঝরতে চাইছে। সে নিজেও যেন বুঝতে পারছে না তার কি হয়েছে।


     কদিন আগেও দীপক কে সে দু চোখে দেখতে পারত না,  মনের আবেগ সে কিছুতেই আজ যেন ধরে রাখতে পারছে না। জীবনের তাকে গ্রাস করে রেখেছিল, নিজেকে সবার আড়ালে গুটিয়ে রেখেছিল। তাই আজ এই মনোরম পরিবেশে নিজেকে সঁপে দিতে ইচ্ছা করছে দীপকের কাছে আজ সবকিছু ছিন্ন করে ভয়-ভীতি ত্যাগ করে দীপকের শক্ত দুই বাহুর মধ্যে নিজেকে সঁপে দিতে চাইছে তার মন। অসাড় হয়ে আসছে তার দেহ মন এই পরিবেশে এত কাছে থেকেও দীপক তাকে কেন জড়িয়ে ধরছে না সে কি কিছুই বুঝতে পারছে না আমি কি চাইছি তা ভেবে মুহুর্তের মধ্যেই ক্ষিপ্ত হলো তার মন। এক ঝটকায় সরিয়ে নিল তার হাত দীপকের হাত থেকে। দীপক যে পরিণীতার মনের কথা বুঝতে পারেনি তা নয় সে তার থেকে বয়সে বেশ কয়েক বছরের ছোট , কিন্তু হলে কি হবে,? তারও তো মন চাইছিল পরিণীতাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে কিন্তু তার যেকোন উপায় নেই। একটা নয় দু দুটো খুন করে সে লুকিয়ে আছে তাদেরই বাড়িতে। পুলিশ খ্যাপা কুকুরের মত হন্যে হয়ে খুঁজছে তাকে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url