মানব অধিকার: প্রসঙ্গ ইসরায়েল প্যালেস্টাইন বন্দী বিনিময়, লেখক - খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
মানব অধিকার: প্রসঙ্গ ইসরায়েল প্যালেস্টাইন বন্দী বিনিময়
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
সমাজতান্ত্রিক দুনিয়াকে অপদস্ত করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার উচ্ছিষ্টভোগীদের দিয়ে অনেক অপপ্রচারমূলক বই লিখিয়েছে। এঁদের মধ্যে সব চাইতে চর্চিত নাম আলেকজাণ্ডার সলঝৎসিন। মনে রাখতে হবে যে কমরেড লেনিন ছিলেন রুশ বিপ্লবের মহানায়ক। কিন্তু তিনি ছিলেন স্বল্পায়ু। তাঁর মৃত্যুর পর কমরেড যোসেফ স্টালিন সদ্যজাত সমাজ ব্যবস্থার কর্ণধার হন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সোভিয়েত জনগণ তথা গোটা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়ে, মিত্রজোটের অন্যতম কূটিল নায়ক চার্চিলের ঘৃণ্য চক্রান্তকে নস্যাৎ করে দিয়ে তিনি ফ্যাসিবাদ--নাৎসীবাদের সমাধি রচনা করেছিলেন। ভারতবর্ষের তিন মহান সন্তান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, জহরলাল নেহেরু, ডঃ সর্ব্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান তাঁর আমলে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিদর্শন করেছেন এবং অভিভূত হয়েছেন। তাঁর "রাশিয়ার চিঠি"তে রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েত দর্শনকে "তীর্থদর্শন" বলে অভিহিত করেছেন। পণ্ডিত নেহেরু সোভিয়েত সমাজ ব্যবস্থা দেখে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হন এবং ঘোষণা করেন "Socialistic Pattern of Society is our goal"। ডঃ সর্ব্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূত। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় কমরেড স্টালিন সম্পর্কে তথা সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন।
অথচ এহেন সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তথা তার নেতা কমরেড স্টালিন সম্পর্কে বিকৃত ও কুৎসাব্যঞ্জক তথ্য পরিবেশন করার পুরস্কার হিসাবে পশ্চিমী দুনিয়া মার্কিন মদতে রুশ লেখক সলঝৎসিনকে তাঁর "দ্য গুলাগ আর্কিপেলাগো।" বই এর জন্য ১৯৭০ সালে নোবেল পুরস্কার দেয়। এই বই-এর মূল বিষয়বস্তু হোল সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানব অধিকার লঙ্ঘন। উক্ত লেখক শুধু কমরেড স্টালিন বা স্টালিন আমলকেই বিকৃতভাবে চিত্রিত করেননি, তিনি স্টালিনের উত্তরসুরীগণকেও অর্থাৎ ক্রুশ্চেভ, বুলগাণিন, ব্রেজনেভ, কোসিগিন, সবাইকে সব আমলকেই কুৎসাব্যঞ্জকভাবে চিত্রিত করেছেন। সুসলভের মত বরেণ্য সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদরা, আফানাসিয়েভ, ভারলামভ প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য, সোভিয়েত সমাজ বিজ্ঞানী- রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরাও তাঁর লেখনি বাণের শিকার হয়েছেন। সমস্ত বক্তব্যের একটিই রা--"এঁরা সবাই সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানব অধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী।"
কিন্তু বাস্তবে গোটা বিষয়টাই মিথ্যে ভরা। আসলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবক্তরা শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে কঠোরহাতে শোষণের ভিত্তি হোল যে উৎপাদন ও বন্টনক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মালিকানা, তাকে নির্মূল করতে চান। অন্যদিকে প্রতিবিপ্লবীরা মরীয়া হয়ে সমাজতান্ত্রিকদের এই প্রয়াসকে বানচাল করতে চায়। স্বভাবতঃই তাদের উপর সমাজতন্ত্র নির্মাণের স্বার্থে অজস্র নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হয়। কমরেড লেনিন, কমরেড স্টালিন, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্ণধার হিসাবে সেই কাজটিই করেছিলেন। সলঝৎসিন ছিলেন এর বিরোধী। তিনি প্রকাশ্য আসরে নামেন প্রতিবিপ্লবীদের সমর্থনে। স্বভাবতঃই অন্যান্য প্রতিবিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁকে সাইবেরিয়াতে নির্বাসিত করা হয়। আট বছর তাঁকে নির্বাসন ভোগ করতে হয়।
যাইহোক সেই সমস্ত কিছুরই প্রতিক্রিয়া হোল উল্লিখিত গ্রন্থটি। ঐ গ্রন্থে যে তথাকথিত মানব অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রকাশ্যে--অপ্রকাশ্যে করা হয়েছে, সেই মানব অধিকার হোল প্রতিবিপ্লবীদের অধিকার। এবারে আমরা কিছু তথ্য এখানে পরিবেশন কোরবো যে পশ্চিমী দুনিয়াতে, যে দুনিয়া প্রতিনিয়ত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার আদ্যশ্রাদ্ধ করে ,সেই দুনিয়ায় মানব অধিকার রক্ষার রূপরেখাটি কেমন।
অতি সম্প্রতি ইসরায়েল প্যালেস্টাইন বন্দীমুক্তি পর্ব চলছে। গোটা প্রক্রিয়াটি চলছে "আমনেস্টি ইনটারন্যাশনাল"-এর তত্ত্বাবধানে। এই সংস্থা যে প্রতিবেদন ও ছবি প্রকাশ করেছে তাতে করে দেখা যাচ্ছে যে আমেরিকার মদতপুষ্ট ইসরায়েলের তেল আবিভ বন্দী শিবিরে ও জেরুজালেম বন্দী শিবিরে প্যালেস্টাইনী বন্দীরা এক অমানবিক অবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করেছে। আমেরিকার প্রখ্যাত দৈনিক "দি নিউ ইয়র্ক টাইমস্" পত্রিকাও একটি সমীক্ষা চালায়। তাতেও একই ছবি ধরা পড়েছে। এই পত্রিকার সমীক্ষকরা লিখেছেন যে তাঁদের দেশে অর্থাৎ আমেরিকার গুয়ানতানামো বন্দীশালা বন্দীদের উপর অত্যাচারের জন্য বিশ্বব্যাপী কুখ্যাত। কিন্তু, এই কুখ্যাত কারাগারের অত্যাচারকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে ইসরায়েলের কারাগারগুলি বন্দী প্যালেস্টাইনীয়দের উপর অত্যাচারের ক্ষেত্রে। নগ্ন--অর্দ্ধনগ্ন করে বন্দীদের রাখা হত, সপ্তাহে নামমাত্র খাদ্য দেওয়া হত, নিয়ম করে দিনে রাতে তাদেরকে মারা হোত, অল্প বয়স্ক পুরুষ বন্দীদের উপর জোর করে যৌন অত্যাচার করে ইসরাইলী সেনারা তাদের বিকৃত যৌন বাসনা তৃপ্ত করতো। আর বন্দিনীদের তো কথাই নেই। বৃদ্ধা কিশোরী কাউকেই বাদ দেওয়া হোত না।
আমনেস্টী ইনটারনেশানালের পর্যবেক্ষণও তাই। তবে এর পাশাপাশি এই সংস্থা সদ্যমুক্তি প্রাপ্ত কয়েকজন ইসরাইলী বন্দিনীরও সাক্ষাৎকার নিয়েছে ও তা প্রকাশ করেছে। এই সব মুক্তিপ্রাপ্তা বন্দিনীরা বলেছেন যে হামাসের যোদ্ধারা তাঁদের সঙ্গে বোনের মত আচরণ করেছেন। কোন অসম্মান কোন রকম অসৌজন্য তাঁদের প্রতি দেখাননি। তাঁরা বলেছেন যে "আমরা ভাইদের বাড়ী থেকে নিজবাড়ীতে ফিরে যাচ্ছি।"
মনে রাখতে হবে যে বন্দীদের প্রতি কেমন আচরণ করতে হবে সে সম্পর্কে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মানব অধিকার সনদে নির্দিষ্ট করে বলা আছে। উল্লিখিত সংস্থাদ্বয়ের প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট যে মার্কিন মদতপুষ্ট ইসরায়েলের জেলে প্যালেস্টাইনী বন্দীদের উপর যে আচরণ করা হয়েছে তা জাতিপুঞ্জের মানব অধিকার সনদকে লঙ্ঘন করেছে। আর হামাসের হাতে বন্দী--বন্দিনীরা যে আচরণ পেয়েছ, তা মানবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে আফগানিস্থানে তালিবানরা বা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গীরা বন্দী অবন্দী নির্বিশেষে যে অত্যাচার করেছে, বা এখনো করছে ,বন্দী আফগান প্রেসিডেন্ট ডঃ নজিবুল্লাকে পিটিয়ে মেরে তাঁর পুরুষাঙ্গ কেটে তাঁর মুখে পুরে কাবুলের রাজপথে তাঁর শব ল্যাম্পপোষ্টে ঝুলিয়ে দিয়েছে, এসব জঘন্য ধরনের মানব অধিকার লঙ্ঘন। কিন্তু হামাসের যোদ্ধারা বন্দীদেরকে মানুষের সম্মান দিয়েছেন। তাঁদেরকে সেলাম, হাজার সেলাম। সি. আই. এর উচ্ছিষ্ট ভোগীরা বিশ্বজুড়ে প্রচার চালায় মানব অধিকার রক্ষার জন্য, তারা বলে কোন সমাজতান্ত্রিক দেশে মানব অধিকার ছিল না, আজও নেই। তাই সমঝৎসিনের জন্য ছিল তাদের এত দরদ। কিন্তু খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উল্লিখিত গুয়ানতানামো কারাগারে কি ঘটে এবং এখনো কি ঘটছে, তা তো নিউ ইয়র্ক টাইমস্-এর তদন্ত রিপোর্ট ফাঁস করে দিয়েছে। আমেরিকার মুখে মানব অধিকারের কথা মানায় না।
শুধু কি তাই? বাঁচার তাগিদে মেক্সিকো থেকে যেসব মানুষ আমেরিকায় প্রবেশ করেছেন অন্নের সন্ধানে, তাদেরকে হাতকড়া পরিয়ে মারতে মারতে জোর করে ট্রাম্প প্রশাসন স্বদেশে ঠেলে দিচ্ছে। এটা কোন ধরনের মানব অধিকার রক্ষা?
আসলে আমেরিকা মুখে মানব অধিকার রক্ষার কথা বলে তার সাম্রাজ্যবাদী তাগিদে। কিন্তু বাস্তবে সে মানব অধিকারের শত্রু। তাদের মদতে ইসরায়েল নির্বিচারে মানব অধিকার লঙ্ঘন করছে প্যালেস্টাইনবাসীদের, পশ্চিম পাকিস্থান করেছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনগণের, ইউনুস সরকার করছে বাংলাদেশে এখন ধর্মীয় মৌলবাদীদের সাথে হাত মিলিয়ে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের, আমাদের দেশের মোদী সরকারও তার প্রসাদপুষ্ট হয়ে দেশের ধর্ম নিরপেক্ষ ঐতিহ্যকে ভেঙ্গে ধর্মীয় বিভাজনের নীতি নিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন সম্পত্তি ও মানব অধিকার লঙ্ঘনের পথে হাঁটছে। এসবের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে সকল শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদের জোয়ার সৃষ্টি করতে হবে। এটাই সময়ের দাবী।
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

