নেতাজি ও নজরুল-- এক বৃন্তে দুটি কুসুম, লেখক - মজিবুর রহমান
নেতাজি ও নজরুল-- এক বৃন্তে দুটি কুসুম
মজিবুর রহমান, প্রধানশিক্ষক, কাবিলপুর হাইস্কুল, মুর্শিদাবাদ
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নের দুই ক্ষণজন্মা বাঙালি হলেন সুভাষচন্দ্র বসু (জন্ম- ২৩.১.১৮৯৭) ও কাজী নজরুল ইসলাম (জন্ম- ২৪.৫-১৮৯৯)। বয়সের দিক থেকে তাঁরা একেবারে সমসাময়িক ছিলেন। মাত্র দুই বছর চার মাসের ছোট বড়। দুজনেরই সক্রিয় কর্মজীবন স্বল্পসময়ের। ২২ থেকে ২৩ বছর। আড়াই দশকের কম সময়ের কর্মজীবনে সাফল্যের সুবাদে তাঁরা আপামর বাঙালির হৃদয়ে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। তাঁদের পরিচিতি অখণ্ড ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। সুভাষচন্দ্রের 'নেতাজি' ও নজরুলের 'বিদ্রোহী কবি' উপাধি তাঁদের প্রতি মানুষের ভালোবাসার স্মৃতি বহন করছে। বাঙালির কাছে এই ভালোবাসাই আবেগে পরিণত হয়েছে। সুভাষপ্রেমী ও নজরুলপ্রেমী কিছু মানুষের মধ্যে তাঁদের নিয়ে যে 'পাগলামি' লক্ষ্য করা যায় তা অন্যান্য প্রাতঃস্মরণীয় বাঙালির ক্ষেত্রে বোধহয় ঘটে না।
রাজনীতির সুভাষচন্দ্র সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন আর সাহিত্যের নজরুল রীতিমতো রাজনীতি সচেতন ছিলেন। এজন্য তাঁরা একে অপরকে ভালোই চিনতেন জানতেন। একে অপরের কার্যক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধাশীলও ছিলেন। সুভাষচন্দ্র কলকাতার মানুষ। ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে সিভিল সার্ভিসেস থেকে পদত্যাগ করে রাজনীতিতে যোগদান করেন। কলকাতাই হয় তাঁর প্রধান কর্মক্ষেত্র। অন্যদিকে, হাবিলদার নজরুল সৈনিক জীবন শেষ করে করাচি থেকে ফিরে সাহিত্যকর্মকেই ধ্যানজ্ঞান করেন। ১৯২০ সালের এপ্রিল থেকে 'বাউণ্ডুলে' নজরুলের অন্যতম বাসস্থান ছিল বাংলার রাজধানী কলকাতা। বিশ-বাইশ বছর নেতাজি ও নজরুল একই শহরে বসবাস করেছেন। তাঁদের মধ্যে একাধিকবার দেখা হয়েছে কথা হয়েছে। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে কংগ্রেসের জাতীয় অধিবেশন বসে কলকাতায়। ওই অধিবেশন উপলক্ষে যে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয় তার কমান্ডিং অফিসার ছিলেন সুভাষচন্দ্র। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী অধিবেশনে গেয়েছিল নজরুলগীতি 'চল চল চল/ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল'। ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার আলবার্ট হলে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নাগরিক সংবর্ধনা জানানো হয়। বক্তৃতা করেন জনপ্রিয় নেতা সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি বলেন, "স্বাধীন দেশে জীবনের সাথে সাহিত্যের স্পষ্ট সম্বন্ধ আছে, আমাদের দেশে তা নেই।... নজরুলকে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। নজরুল জীবনের নানা দিক হতে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। তার মধ্যে একটা আমি উল্লেখ করব। কবি নজরুল যুদ্ধের ঘটনা দিয়ে কবিতা লিখেছেন। কবি নিজে বন্দুক ঘাড়ে করে যুদ্ধ করেছিলেন, কাজেই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সব লিখেছেন তিনি। আমাদের দেশে ঐরূপ ঘটনা কম, অন্য স্বাধীন দেশে খুব বেশি। এতেই বুঝা যায় যে, নজরুল জীয়ন্ত মানুষ।" স্বাধীনতা সংগ্রামে নজরুল রচনার প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে দৃপ্ত কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেন, "আমরা যখন যুদ্ধে যাবো তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাবো তখনও তার গান গাইব।" সুভাষচন্দ্রের অনুরোধে নজরুল গেয়ে শোনান 'কাণ্ডারী হুঁশিয়ার'। তাঁদের পারস্পরিক সখ্যতার সুবাদে নজরুল এলগিন রোড ও উডবার্ন পার্কের বসু পরিবারের আড্ডায় গান শোনাতেন।
কাজী নজরুল ইসলাম 'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতা লিখে রাজদ্রোহের অভিযোগে ১৯২২ সালের নভেম্বরে কারারুদ্ধ হন। বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি হিসেবে আসেন ১৯২৩ সালের ১৮ জুন। মুক্তি পান ১৫ ডিসেম্বর। সুভাষচন্দ্র প্রথমবার কারাবরণ করেন ১৯২৩ সালে। বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলে ছিলেন ৩.১২.১৯২৪ থেকে ২৫.১.১৯২৫ পর্যন্ত। এখনকার মানসিক হাসপাতাল তখন জেলখানা ছিল।
নেতাজি ও নজরুলের মধ্যে চিন্তাগত মিল ছিল লক্ষণীয়।
তাঁরা দুজনেই মনে করতেন অহিংস পথে আবেদন নিবেদন করে কখনও স্বাধীনতা পাওয়া যায় না। নজরুল ভারতের পরাধীনতার ইতিহাস স্মরণ করে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার- "ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!/উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।" স্বাধীনতা সংগ্রামের আপসহীন নেতা সুভাষচন্দ্র দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বীরদর্পে অনুরূপ আহ্বান জানান- "তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।"
সুভাষচন্দ্র স্বাধীন ভারতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। ব্রিটিশদের বিতাড়িত করে বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন তিনি। রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে তিনি ছিলেন বামপন্থী। একইভাবে, নজরুল যেমন বিদ্রোহী কবি তেমনি সাম্যবাদী কবি হিসেবেও পরিচিত। তিনি সকল প্রকার অসাম্য বৈষম্যের বিরুদ্ধে তথা সাম্যের সমর্থনে সোচ্চার ছিলেন। 'সাম্যবাদী' কবিতায় রূপকের আড়ালে নয়, সরাসরি তিনি বলেছেন, "গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান"।
সুভাষচন্দ্র ষোলো আনা ধর্মনিরপেক্ষ নেতা ছিলেন। তিনি হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগের বিভেদকামী রাজনীতির বিরোধিতা করতে কখনও কুণ্ঠাবোধ করেননি। তিনি কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালীন কংগ্রেসের সদস্যদের কোনও ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের মধ্যেও গভীরভাবে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের প্রতিফলন ঘটে। তিনি সৈনিকদের ধর্মভিত্তিক রান্নাঘর বন্ধ করে সকল সৈনিকের এক রন্ধনশালা চালু করেন। তিনি বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। ধর্মকে ব্যক্তিগত পরিসরে রেখে বৃহত্তর ক্ষেত্রে সকলের মিলেমিশে কাজ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বহু ধর্ম সম্প্রদায়ের দেশে এটাই সঠিক ভাবনা। নজরুল এই ভাবনাকেই সাহিত্যে সুদৃঢ় করেছেন। মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করার তীব্র বিরোধিতা করেছেন, "হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার"। তিনি হিন্দু আর মুসলমানকে পৃথক সত্তা হিসেবে দেখতে চাননি। চেয়েছেন অবিচ্ছেদ্য অস্তিত্ব হিসেবে দেখতে, "মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মোসলমান।/মুসলিম তার নয়ন মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।।"
নারী জাতির প্রতি দৃষ্টভঙ্গিতেও নেতাজি ও নজরুলের মধ্যে যথেষ্ট মিল ছিল। 'অর্ধেক আকাশ'-এর অধিকার সুরক্ষিত রাখার পক্ষে ছিল তাঁদের অবস্থান। স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণকে স্বাগত জানান সুভাষচন্দ্র। তিনি মহিলাদের নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের একটি বাহিনী গঠন করেন এবং এর নাম দেন 'ঝাঁসির রানী ব্রিগেড'। নজরুল মনে করতেন মানব সভ্যতার বিকাশে নারীর ভূমিকা পুরুষের চেয়ে কম নয়, "বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।" তিনি তাঁর 'নারী' কবিতায় দেখিয়েছেন, নারী ও পুরুষ একে অপরের পরিপূরক।
বৈবাহিক জীবনেও সুভাষচন্দ্র ও নজরুলের কিছুটা মিল পাওয়া যায়। তাঁরা তাঁদের প্রেমের পাত্রীকে সহধর্মিণী করতে কোনও ধর্মীয় বিধিনিষেধ অথবা সামাজিক সংস্কারের পরওয়া করেননি। সুভাষচন্দ্র তিরিশের দশকে অস্ট্রিয়ায় অবস্থানকালে অস্ট্রীয় খ্রিস্টান তরুণী এমিলি সাঙ্কেলকে তাঁর আপ্ত সহায়ক নিয়োগ করেন। পরে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের একমাত্র কন্যা সন্তানের নাম অনিতা বসু পাফ। নজরুল বিবাহ করেন ময়মনসিংহের আশালতা সেনগুপ্তকে। পরে নাম পাল্টে করা হয় প্রমীলা। কিন্তু তাঁরা কেউ কাউকে ধর্ম পরিবর্তনের জন্য চাপাচাপি করেননি। নজরুল ও প্রমীলার সন্তানদের নাম ছিল: কৃষ্ণ মোহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), সব্যসাচী ইসলাম ও অনিরুদ্ধ ইসলাম। অর্থাৎ, সন্তানদের নামকরণের ক্ষেত্রেও ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেন নজরুল।
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নেতাজি ও নজরুল উভয়ের প্রতিই যথেষ্ট স্নেহশীল ও সহানুভূতিশীল ছিলেন। ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে সুভাষচন্দ্র শান্তিনিকেতন আসেন। ১৯৩৯ সালের আগস্টে সুভাষচন্দ্রের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মহাজাতি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন রবীন্দ্রনাথ। তিনিই ভবনটির নামকরণ করেন। তিনি সুভাষচন্দ্রকে 'দেশনায়ক' আখ্যায় ভূষিত করে তাঁর নেতৃত্বদানের দক্ষতাকে স্বীকৃতি দেন। তিনি তাঁর 'তাসের দেশ' নৃত্যনাট্যটি সুভাষচন্দ্রকে উৎসর্গ করে লেখেন, "স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পূণ্য ব্রত তুমি গ্ৰহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ করে তোমার নামে 'তাসের দেশ' নাটিকা উৎসর্গ করলুম।" তিনি নেতাজির সঙ্গে গান্ধীজির বিরোধ মেটাতেও উদ্যোগ গ্ৰহণ করেছিলেন। ১৯৪১ সালের জানুয়ারিতে কলকাতা থেকে সুভাষচন্দ্রের রহস্যজনক অন্তর্ধানের পর অশীতিপর রবীন্দ্রনাথ খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। সুভাষচন্দ্রের বড় ভাই শরৎচন্দ্র বসুকে একটি টেলিগ্ৰামে তিনি লেখেন, "সুভাষের নিখোঁজ হওয়ার জন্য গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। অনুগ্ৰহ করে আমাকে খবর সম্পর্কে অবহিত করুন।" ১৯২২ সালের আগস্ট মাসে নজরুল প্রকাশ করেন 'ধূমকেতু'। আন্তরিক আশীর্বাণী পাঠান রবীন্দ্রনাথ, "কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু-- আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,/দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।" ১৯২৩ সালে জানুয়ারিতে নজরুল যখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি রয়েছেন তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'বসন্ত' গীতিনাট্যটি তাঁকে উৎসর্গ করেন। বিদ্রোহী কবি যখন হুগলি জেলে অনশন ধর্মঘট করছেন তখন উদ্বিগ্ন বিশ্বকবি তারবার্তা প্রেরণ করেন- "অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহার করো। আমাদের সাহিত্যের তোমাকে প্রয়োজন রয়েছে।" "নজরুল চড়া গলার কবি, তাঁর কাব্যে হৈ চৈ অত্যন্ত বেশি।... শুধুই হৈ চৈ আছে, কবিত্ব নেই" বলে যখন কেউ কেউ নজরুলের সমালোচনা করছেন তখন কবিগুরু তাঁর প্রিয় 'কাজী'র পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, "কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এসব তোমাদের আবদার বটে। সমগ্ৰ জাতির অন্তর যখন যে সুরে বাঁধা, অসির ঝনঝনায় যখন সেখানে ঝংকার তোলে, ঐকতান সৃষ্টি হয়, তখন কাব্যে তাকে প্রকাশ করবে বৈকি! আমি যদি আজ তরুণ হতাম তাহলে আমার কলমেও ঐ সুর বাজত।"
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু গোপনে কলকাতা তথা দেশত্যাগ করেন জানুয়ারি, ১৯৪১। কলকাতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ ঘটে আগস্ট, ১৯৪১। কলকাতাতেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম নির্বাক হয়ে পড়েন জুলাই, ১৯৪২। কলকাতা তথা সমগ্র বাংলার জন্য সময়টা মোটেও ভালো ছিল না। তাঁদের দেখানো পথে বাংলার বর্তমান ও ভবিষ্যত নির্মাণ করার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে।

