গল্প - সেই বিকেলের প্রতীক্ষা, কলমে - এস এম মঈনুল হক
সেই বিকেলের প্রতীক্ষা
এস এম মঈনুল হক
সমরেশ আজ ষাট ছুঁয়েছে। তবু রোজ বিকেলে হেঁটে আসে এই পুরনো পার্কে, যেখানে বসে থাকে নির্জন এক বেঞ্চে। কেউ জানে না কেন সে আসে, বা কী সে খুঁজে ফেরে। সময়ের ঢেউয়ে পার্কের রং ফিকে হয়ে গেছে, বেঞ্চের পেছনের রঙ উঠেছে, গাছগুলোও বদলে গেছে কিছুটা, কিন্তু সমরেশের হৃদয়ে একটি জায়গা আজও একই রকম রয়ে গেছে—শ্রেয়ার জন্য।
বছর বাইশ আগে এই পার্কেই এক সন্ধ্যায় প্রথম দেখা হয়েছিল তাঁদের। তখন সমরেশ ছিল আটত্রিশের তরুণ, সদ্য কলকাতার কাছাকাছি এক লাইব্রেরিতে বদলি হয়ে এসেছিল। শ্রেয়া ছিল ছাব্বিশ বছরের এক স্কুলশিক্ষিকা—চোখে অদ্ভুত এক নিরবতা, যেন কোন গোপন বেদনার ছায়া।
সেদিন বৃষ্টি নামছিল হালকা করে। সমরেশ তার ছাতা মাথায় ধরে পার্কে ঢুকতেই চোখে পড়ে শ্রেয়াকে—একাকী বেঞ্চে বসে বই পড়ছে। আশপাশে কেউ নেই, কেবল পাতা ঝরার শব্দ আর তার চশমার ফ্রেমের নিচে দুটি গভীর চোখ।
সমরেশ একটু দ্বিধা নিয়ে পাশে গিয়ে বসে। কথোপকথন শুরু হয় ধীরে ধীরে—বই থেকে জীবনের গল্পে গড়িয়ে যায়। শ্রেয়া বলেছিল, “আপনার চোখে একটা অদ্ভুত স্নিগ্ধতা আছে… মনে হচ্ছে অনেকদিন ধরেই আপনাকে চিনি।”
সমরেশ একটু হেসে বলেছিল, “আপনাকে দেখেই আমার বুকটা কেঁপে উঠেছিল।”
সেই বিকেলে, বৃষ্টিভেজা আলোছায়ায়, যেন তাঁদের মধ্যে জন্ম নেয় এক মুহূর্তের প্রেম। কোন প্রতিশ্রুতি নয়, কোনো সামাজিক চুক্তি নয়—শুধু আবেগের দোলা। একটিবার বুক মিলেছিল তাঁদের, একটিবার শ্রেয়া তার মাথা রেখেছিল সমরেশের কাঁধে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই সে বলেছিল, “এইটুকুই হোক, এর বেশি কিছু নয়।”
সমরেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “কেন? আমরা কি আবার দেখা করবো না?”
শ্রেয়া চোখ নামিয়ে বলেছিল, “আমার জীবন অন্যরকম… এই মুহূর্তটাই থাক, বাকি সব হারিয়ে যাক।”
তারপর থেকে শ্রেয়া আর দেখা দেয়নি। কোনো নম্বর দেয়নি, ঠিকানাও নয়। সমরেশ প্রতিদিন এসেছিল পার্কে, হয়তো কোনোদিন হঠাৎ এসে দাঁড়াবে সে, এই আশায়।
বছর কাটতে থাকে। চোখের চশমার পাওয়ার বাড়ে, হাঁটার গতি ধীর হয়, শরীরে বার্ধক্যের ছাপ পড়ে, কিন্তু হৃদয়ের সেই জায়গাটা এক বিন্দুও বদলায় না।
আজ, বাইশ বছর পর, হঠাৎ করে এক বিকেলে সমরেশ দেখতে পেলো এক নারী ধীরে ধীরে হাঁটছে তার দিকে। মুখে বয়সের রেখা, শরীরে দুর্বলতা—তবু চোখে সেই চেনা গভীরতা।
“শ্রেয়া?” সমরেশ কাঁপা কণ্ঠে ডাকলো।
শ্রেয়া একটু হাসলো। “চিনতে পেরেছো?”
সমরেশের চোখ ভিজে উঠলো। “এতদিন কোথায় ছিলে?”
শ্রেয়া বসে বলল, “তোমার কাছেই, এই শহরের আরেক কোণে। বেঁচে ছিলাম, কিন্তু প্রতিদিন একটু করে মরছিলাম। তোমাকে মনে পড়ত প্রতিদিন... কিন্তু আমার জীবনটা আমার ছিল না।”
“আজ তাহলে কেন এলে?”
শ্রেয়ার চোখে জল। “ডাক্তার বলেছে আমার সময় শেষ… তাই শেষবার তোমার মুখটা দেখতে এলাম। জানি, কিছুই বদলাবে না… শুধু জানতে চেয়েছিলাম, তুমি কি আজও অপেক্ষা করো?”
সমরেশ মাথা নিচু করলো, বলল, “আমি তো কখনো থামিনি। তোমার জন্যই এই পার্কে এসে বসে থাকি এত বছর ধরে।”
শ্রেয়া হালকা হাসে, কিন্তু সেই হাসির আড়ালে বিষণ্নতা। “আমি এবার যাই সমরেশ। কিন্তু যদি কোনোদিন মনে হয়, আমি তোমার পাশে বসে আছি—জেনো, স্মৃতি কখনো মরে না।”
শ্রেয়া ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যায়। তার পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে যায় সন্ধ্যার ভেতর।
সমরেশ সেই পুরনো বেঞ্চে বসে থাকে। আবার এক বিকেল, আবার এক বিদায়। পার্কের বাতাসে তখনও ভেসে আসে বৃষ্টিভেজা সেই প্রথম দেখা দিনের গন্ধ।